১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ডিজিটাল বাজারব্যবস্থায় ভোগান্তি

-

যেখানে পণ্য বেচাকেনার পদ্ধতিটি তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর, তাই ডিজিটাল বাজারব্যবস্থা। অনলাইনে কেনাকাটার যে ধারা ধীরে ধীরে বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে, তা বাড়ছে। বিশ্বে অনলাইন বাজারব্যবস্থা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশেও এটি ক্রমবর্ধমান। ঘরে বসে ইচ্ছেমতো কেনাকাটা, পণ্য পছন্দ করা, সেটি সম্পর্কে সহজে বিস্তারিত জানতে পারা এবং যানজট এড়িয়ে দোকানে দোকানে ঘুরে পণ্য কেনার চেয়ে ঘরে বসে পছন্দের জিনিস সহজে কিনতে পারায় জনপ্রিয়তা বাড়ছে অনলাইন বাজারব্যবস্থার। দেশে বর্তমানে ই-কমার্স বাজারের আকার প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। গড়ে প্রতিদিন ৩০ হাজার ক্রেতা অনলাইনে পণ্যের অর্ডার দেন। ভারতে অনলাইন গ্রাহকের এ সংখ্যা ১০ কোটি, চীনে প্রায় ৪০ কোটি। যেখানে ভারতে মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ অনলাইনে কেনাকাটায় অভ্যস্ত, সেখানে বাংলাদেশে এ সংখ্যা ১ শতাংশেরও কম। আমাদের দেশে এ খাতের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে সঠিক পদক্ষেপ ও নীতিমালা এবং সেবাদানের মানের ওপর।

একটি জরিপে দেখা গেছে, আগামী ২৫ বছরে বাংলাদেশে আনুপাতিক হারে তরুণদের সংখ্যা সর্বাধিক বাড়বে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ই-কমার্স বা অনলাইন খাত বিকাশের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা গেলে দেশের জন্য একটি অপার সম্ভাবনার দুয়ার অবারিত হবে।

গোল্ডডম্যান স্যাকস ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, বাংলাদেশ ‘নেক্সট এলেভেন’ গ্রুপের অন্যতম সদস্য হিসেবে সামর্থ্য ও সম্ভাবনার কারণে ২১ শতকের অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটির ৬৫ শতাংশ মানুষের বয়স ৩৫ বছরের নিচে। সংখ্যার দিক থেকে তাই বাংলাদেশ শুধু নয়, যুব সম্প্রদায়ের দিক থেকেও বৃহৎ একটি দেশ। প্রতি বছর গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ এবং বর্ধিষ্ণু নগরায়ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আয় বাড়িয়ে দিয়েছে। দেশের এ মধ্যবিত্ত শ্রেণীই অনলাইন বা ডিজিটাল বাজারব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি হবে।

দেশে অনলাইনে ক্রয়-বিক্রয়ে ওয়েবসাইট বাড়লেও সুসংগঠিত নয়। নেই কেনাবেচার নীতিমালা। অনলাইনে ব্যবসা শুরু করতে ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হয়। এরপর ডোমেইন রেজিস্ট্রেশন করে ওয়েবসাইট তৈরি করে, প্রয়োজন অনুযায়ী হোস্টিং নিয়ে সাইট চালু করতে হয়। অনেকেই এখন ঘরে বসে সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলোতে নিজস্ব অনলাইন দোকানের বিজ্ঞাপন প্রচার করছেন। এতে নিয়মিতই বিভিন্ন পণ্যের বিবরণ ও মান সম্পর্কে সব ধরনের খবর দেয়া হয়। অনেকে আবার কোনো ওয়েবসাইট তৈরি করে নয়, ফেসবুকের ফ্যান পেজে অনলাইনে ব্যবসা করছেন। এভাবে বিক্রীত পণ্যের ওপর ভ্যাট দিতে হয় না। বাংলাদেশের অনলাইন স্টোরগুলোতে মূলত নিজস্ব পণ্য থাকে না। তাই এ ক্ষেত্রে ভ্যাটের বিষয়টিও খাটে না।

যারা দেশের বাইরে থেকে পণ্যের অর্ডার নেন, তাদের বৈদেশিক মুদ্রা আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৪৭-এর ১৮/এ ধারার অনুমোদন নিতে হয়। অন্য দিকে অন্যান্য দেশে পণ্য বিক্রির সুযোগ পেতেও বিক্রেতাকে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে শুরু করে ঠিকানা, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ আনুষঙ্গিক তথ্য দাখিল করতে হয়। এসব তথ্যের সত্যতা যাচাই-বাছাইয়ের পরই বিক্রেতাকে পণ্য বিক্রির জন্য অনলাইনে বিজ্ঞাপন প্রচারের সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে যে কেউ ইচ্ছে করলেই অনলাইনে পণ্য বিক্রয়ের জন্য বিজ্ঞাপন দিতে পারেন।

বাংলাদেশে ডিজিটাল বাজারব্যবস্থা বিস্তারের পথে তিনটি বাধা চিহ্নিত করা যেতে পারে। প্রথম কারণটি, অনলাইন ভিত্তিক বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো মানুষের পুরোপুরি আস্থা অর্জন করতে পারেনি। দ্বিতীয় কারণটি হলো- বাংলাদেশে নির্ভরযোগ্য ডেলিভারি ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশে ডাক বিভাগ সম্প্রতি চেষ্টা করছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত সারা দেশে ই-কমার্স ডেলিভারির ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি। তৃতীয়, বর্তমানে নির্ভরযোগ্য পেমেন্ট সিস্টেমও নেই। সীমিত পরিসরে ই-কমার্স বা অনলাইন বাজার চালু করা গেলেও দেশের গ্রামের ৭০ শতাংশ মানুষ এর আওতার বাইরে।

ডিজিটাল বাজার বা অনলাইন মার্কেট ব্যবস্থা ধীরে ধীরে যেমন জনপ্রিয় হচ্ছে, ঠিক তেমনই কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর অসদুপায় পন্থা অবলম্বনে এখাতকে কলুষিত করছেন। অনলাইন কেনাকাটার ক্ষেত্রে অনেক ফাঁকফোকর রয়েছে। তাই প্রতিনিয়ত ক্রেতারা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। হচ্ছেন প্রতারিত। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ওয়েবসাইটে প্রচারণার ওপর ভিত্তি করে সাধারণত অনলাইন বাজার গড়ে উঠে। অনলাইনে পণ্যের ধরন, রঙ, গুণগত মান যেভাবে বর্ণনা করা থাকে; ক্রেতার কাছে যখন পণ্যটি পৌঁছে, তখন দেখা যায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আগের সাথে মিল থাকে না। সেসব পণ্য নিতে না চাইলে ক্রেতাকে ডেলিভারি চার্জ বহন করতে হয়। আরেকটি সমস্যা হলো পণ্য পরিবহন। মূলত দেশের বেশির ভাগ ব্যবসা কার্যক্রম ঢাকাকেন্দ্রিক। অনলাইনে পণ্যের অর্ডার করলে ঢাকায় ক্রেতার অবস্থান হলে সেদিন বা পরদিনই পণ্য পৌঁছে দেয়া হয়। ঢাকার বাইরে হলে ৭-১০ দিন পর্যন্ত সময় লাগে। এর প্রধান কারণ, দেশে এখনো পরিবহন কোম্পানি গড়ে ওঠেনি, যা ক্রেতার কাছে পণ্য দ্রুত সময়ে পৌঁছে দিতে পারে। ইন্টারনেটের উচ্চমূল্য ডিজিটাল বাজারের জন্য আরেকটি বাধা। আবার গ্রামে ইন্টারনেটের গতি তুলনামূলক আরো কম। ডিজিটাল বাজারব্যবস্থায় আরেকটি সমস্যা, বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব।

গত কয়েক বছরে হাজারো উদ্যোক্তা অনলাইন মার্কেট তৈরি করে ব্যবসা আরম্ভ করেছেন। কোনো ক্রেতা যদি একবার প্রতারিত হন বা আস্থা হারিয়ে ফেলেন; তাহলে ডিজিটাল বাজারব্যবস্থার ওপর এর প্রভাব পড়ে। দুঃখজনক হলো, অনেকে ফেসবুক পেইজ খুলে স্পন্সর করে সবার কাছে পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করছেন; যাদের অনেকের উদ্দেশ্য থাকে প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নেয়া। আরেকটি গুরুতর সমস্যা হলো, একটি পণ্যের দাম বাজারে যে মূল্যে বিক্রি হয়; তা থেকে বেশি মূল্যে বিক্রি করে থাকে অনলাইনভিত্তিক কোম্পানিগুলো। একই পণ্য বিভিন্ন কোম্পানি অসঙ্গতিপূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন মূল্যে বিক্রি করে থাকে। অনলাইনে কেনাবেচা সংক্রান্ত লেনদেনের অন্যতম মাধ্যম ব্যাংক। আর এ বাবদ ব্যাংক প্রতি লেনদেনে ফি কেটে থাকে ৪ শতাংশ হারে। অথচ ব্রিটেনে প্রতি ২৭টি লেনদেন বাবদ ব্যাংকগুলো ফি রাখে পাঁচ পাউন্ড। দেশে ই-কমার্স বা ডিজিটাল বাজারব্যবস্থা সম্পর্কিত কোনো আইন নেই, সেজন্য জনসচেতনতা তৈরির মাধ্যমে এ সমস্যা থেকে উত্তরণের চেষ্টা করতে হবে। এ বাজারব্যবস্থায় প্রতারণা এড়াতে সরকারের দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া উচিত। এ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভোগান্তি এড়ানো সম্ভব। ডিজিটাল বাজারব্যবস্থায় কারসাজি করলে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে প্রতিকার করতে হবে।

এ খাতে ভোগান্তি এড়াতে অনলাইন বাজারব্যবস্থা অর্থাৎ ই-কমার্স সহায়ক উপযুক্ত জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি। এজন্য চাই সুনির্দিষ্ট পথনকশা। আর্থিক লেনদেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং ইন্টারনেটের গতি বাড়ানো। ডাটার মূল্য সহনীয় পর্যায়ে আনা। আস্থাশীল ই-কমার্স পরিবেশ সৃষ্টি করা। এজন্য সরকার ও অনলাইন বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে। ভোক্তা অসন্তোষ নিরসনে টেকসই কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেনের খরচ পুনর্নির্ধারণ করা। অনলাইনে পণ্য বিক্রয় করতে সরকারের নির্ধারিত অধিদফতর থেকে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা। পণ্য বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের অফিস থাকা বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। ক্রেতা প্রতারিত হলে অভিযোগ করার প্রক্রিয়া সহজ করা। দ্রুততম সময়ে অভিযোগ নিষ্পত্তি করা। কোনো শর্ত ছাড়া পণ্য হাতে পাওয়ার পর মূল্য পরিশোধের ব্যবস্থা করা। সরকারের মনিটরিং সেল গঠন ও নিয়মিত মনিটরিং করা। ইন্টারনেটে ব্যবসাকারী সব কোম্পানির আয়ের হিসাব সরকারের কাছে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা। পণ্য বিক্রয়কারী সব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা চালু করা। বিবরণ অনুযায়ী পণ্য না পেলে কিংবা ত্রুটিপূর্ণ পণ্য পেলে তা ফেরত নিয়ে বদলে দিতে হবে। পণ্য পরিবর্তনের যাবতীয় খরচ বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানকেই বহন করতে হবে। জাতীয় ভোক্তা অধিদফতরের কার্যক্রম উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছে দেয়। অভিযোগ দায়েরের পর দ্রুততম সময়ে বিষয়টির সুরাহা করতে হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া


আরো সংবাদ



premium cement