১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আজকের বাংলাদেশ ও ভবিষ্যতের পথ

-

বরাবরই দেয়াল খাড়া করার বিপক্ষে আমি। দেয়াল খাড়া করলে সেটা ঘর, ভেঙে ফেললেই সুবিশাল পৃথিবী। পৃথিবীর বিশালতাকে স্পর্শ করতে হলে অতি বড় না হলেও চলে। কত ছোট প্রজাপতি, কিন্তু তার বাড়ি সারা পৃথিবী। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষুদ্রতা অতিক্রম করে যদি বৃহত্তম ও মহত্ত্বমে অবগাহন করি, তাহলে আমরা থাকব বিশ্বময়।

বাংলাদেশ এখন আর ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের সীমানায় আবদ্ধ নেই। বাংলাদেশ শ্রমিকরূপে, ছাত্ররূপে, সেনাসদস্যরূপে, অভিবাসীরূপে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ছে। বিশ্বায়নের এই কালে এটা না হলে চলে না। এখন প্রত্যেক রাষ্ট্রকেই বিশ্বের জন্য নিজের মধ্যে জায়গা করে দিতে হচ্ছে এবং বিশ্বের মাটিতে নিজের জায়গা বুঝে নিতে হচ্ছে, নিজেকে দাঁড় করাতে হচ্ছে। বিষয়টা একদিক দিয়ে রাজনৈতিক, অপরদিকে সাংস্কৃতিক।

‘রাজনৈতিক’ এই অর্থে যে, রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌম কর্তৃত্বই এখন সবকিছু নয়। বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক নানা শক্তি-প্রতিষ্ঠান দেশে দেশে অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ ইত্যাদিতে কর্তৃত্ব ফলাচ্ছে। আমরা চাই বা না চাই সেটা ঘটেই চলছে এবং স্বাভাবিকতা পেতে যাচ্ছে। এটি অবাধ প্রবাহের মতো। চোখ বন্ধ করলেও তা থামবে না এবং এর প্রভাব থেকেও কেউ বাঁচবে না। অতএব, একে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হয় এবং ঝড়ের ভেতর দিয়ে হলেও পথ করে নিতে হয়। বিশেষত, যখন সারাবিশ্বকে একটি গ্রামরূপে ভাবা হচ্ছে এবং তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত দুটি গৃহকোণের মতো। অর্থাৎ পৃথিবী ছোট হয়ে গেছে। আকারে বা আয়তনে নয়, ধারণায়। ধারণার এই পরিবর্তনে জড়িত আছে জ্ঞান, পরিবর্তনের চালক মূলত জ্ঞানই। জ্ঞান যখন আসে, হাঁটি হাঁটি পা পা করে সংস্কৃতিও আসতে চায়। বিশ্বায়ন বলি বা না বলি, বিশ্বের এই গ্রাম ধারণায় সংস্কৃতি এসেছে খুবই বলশালীরূপে, জাতিগুলোর সংস্কৃতি এখন আর নিজ নিজ বাড়িতে বসে নেই। দুনিয়া দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। পারস্পরিক জানাশোনা বাড়ছে, বাড়ছে দান গ্রহণও।

কিন্তু এর ফাঁক দিয়ে একটি যুদ্ধও চলমান। বলবান সংস্কৃতিগুলো আধিপত্যবাদী হয়ে উঠছে। তাদের চাপে ও তাপে ক্ষুদ্র সংস্কৃতিগুলোর নাভিশ্বাস উঠেছে। বিশ্বজুড়ে দুয়ারে দুয়ারে তাদের পদধ্বনি। প্রতিটি স্বকীয় সত্তার মাথার ওপর তারা ছড়ি ঘোরাচ্ছে। যোগ্যতার ভিত্তিতে অস্তিত্ব সংরক্ষণের প্রশ্ন বড় হয়ে উঠেছে। এ দিকে অনেকেই হারিয়ে যাচ্ছে।

সাংস্কৃতিক পরাজয় মেনে নিলে আরেকটি পরাজয় অনিবার্য হয়ে ওঠে। সেটা হলো রাজনৈতিক পরাজয়। বিজয়ী সংস্কৃতি বসে থাকে না। সে জাতির জীবনযাত্রাকে কবলিত এবং জনগোষ্ঠীর মনমগজে উপনিবেশ স্থাপন করতে চায়। এটা একটা প্রক্রিয়া। প্রথমেই এ জন্য বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রগুলো আর ব্যক্তিত্বের চেতনালোকে জেঁকে বসাই তার ইচ্ছা। এই ইচ্ছা ঔপনিবেশিক হলেও এখন তা ভিন্নরূপে পৃথিবীতে সক্রিয়। আমরা তাকে সহজে বুঝবো সাম্রাজ্যবাদের খাসলতের প্রতি খেয়াল করলে। তাকে কথা বলতে দিলে গর্জন করে, এক পা এগোলে দশ পা দখল করতে চায়, কোথাও দাঁড়াতে দিলে হাঁটু গেড়ে বসে, শুতে দিলে জায়গার মালিকানা চেয়ে বসে। এই মনোবৃত্তির মদ এখন বোতল বদলিয়েছে মাত্র।

এর উদাহরণ ক্লাইভ। সে যখন একবার উপনিবেশ গেড়ে বসল বাংলায়, তখন দ্বিতীয় উপনিবেশ স্থাপন না করলে আর পারছিল না। সেই সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম উপনিবেশ গড়ল পুঁজির অভিঘাতে, দ্বিতীয় উপনিবেশ গড়ল রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব অধিকারের মাধ্যমে। এখন আর কোনো বাংলা দখলের জন্য হুগলি বা কলকাতায় দুর্গ গড়ার যুগ নেই। মানুষের মানসজগৎ আছে, প্রতিপত্তিশালী সংস্কৃতিগুলো এই রাজধানীটি দখল করতে চায়। এখানে একবার জেঁকে বসতে পারলে রাষ্ট্র বা ক্ষমতা গৃহপালিত জন্তুর মতো হাতের নাগালে হাজির হবে। কেননা, রাষ্ট্র মাটি দিয়ে নয়, জনগণ দিয়ে গড়ে ওঠে। সে মৃন্ময় নয়; বরং চিন্ময়। রাষ্ট্র যেকোনো বিচারেই জনগণের।

জনগণ প্রয়োজন মনে করলে রাষ্ট্র বিলুপ্ত করতে পারে। ১৯৯০ সালে দুই জার্মানি এক হলো, টাটকা উদাহরণ। আবার জনগণ যদি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করে, তাহলে নতুন রাষ্ট্র গড়তেও পারে। এর দৃষ্টান্ত আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র। অতএব রাষ্ট্র রাখতে হলে সংস্কৃতি রাখতে হবে। জনগণকে তাদের সংস্কৃতি বুঝিয়ে দিতে হবে। কিন্তু সংস্কৃতি তো এমন কোনো ট্যাবলেট নয় যে, এক গ্লাস পানি দিয়ে সবাইকে খাইয়ে দেয়া যাবে। বিষয়টা চাপিয়ে দেয়ার নয়; বরং বুদ্ধিবৃত্তিক। এ জন্য দরকার সাংস্কৃতিক প্রস্তুতির। এর ভিত্তিমূলে দাঁড়াবে রাজনীতি, যা অধিকতর উত্তম উপায়ে রাষ্ট্রকে রক্ষা করবে।

অর্থবহ সাংস্কৃতিক প্রস্তুতির ক্ষেত্রে দুটি বিষয় এখন গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত দেয়াল রাখা যাবে না। মানবজাতির জ্ঞানগত উত্তরাধিকার এবং ইতিহাসের সার্বজনীন শিক্ষাকে সঙ্গী করতে না পারলে পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতির গতিকে আত্মস্থ করা যাবে না। পশ্চাৎপদ মানসিকতা একটি দেয়াল। অন্যের অন্ধ অনুকরণ একটি দেয়াল। আরেকটি দেয়াল হলো আত্মপরিচয়হীনতাজনিত কৃত্রিমতার অন্ধকার। এর পরিণতি খুবই ভয়াবহ। একে তাড়ানো যায় না, ক্রমাগত বিস্তৃত হয়। লাথি দিলে সরে না, পা কামড়ে ধরে। প্রতিবাদ করলে উল্টো মুখ ভেঙচায়।

মুখ ভেঙচানো মানে আত্মপরিচয়হীন এস্টাবলিশমেন্টের তৎপরতা। প্রচলিত ব্যবস্থার ওপর সুনির্দিষ্ট কোনো জিজ্ঞাসার পেছনে এস্টাবলিস্টমেন্ট প্রশ্নকারীর সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে পাল্টা প্রশ্ন তোলে এবং অপ্রাসঙ্গিক হট্টগোলের মাধ্যমে প্রশ্নকারীকে দমিয়ে দিতে চায়। তবে আশার কথা হলো- প্রতিটি প্রজন্মের উত্তরহীন প্রশ্ন পরবর্তী প্রজন্মের উত্তর প্রাপ্তির সম্ভাবনা উজ্জ্বল করে। ফলে যতই ঝুঁকিপূর্ণ হোক, আইডেন্টিটি ক্রাইসিসের মোকাবেলায় আত্মপরিচয় আবিষ্কারের তথা অন্ধকারের বিরুদ্ধে এনলাইটেনমেন্টের জন্য গণবুদ্ধিজীবিতা চালিয়ে যেতেই হবে।

এ ক্ষেত্রে জাতীয় সংস্কৃতির প্রতি বিশ্বস্ত বুদ্ধিজীবীর সততা ও সচেতনতার দাবি হলো, ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকা; যদিও তিনি এর সাথে নীতিগতভাবে সহমত পোষণ করেন। কেননা, যেসব কণ্ঠস্বর অশ্রুত, সেগুলোকে সর্বসমক্ষে তুলে আনা, তাকে শ্রুতিগম্য করা এবং প্রবল এক ঘূর্ণির ভেতরে নিজ মাটি ও শিকড়ের স্বকীয়তার দানা কুড়াবার সর্বাত্মক এক সাধনায় তিনি নিজেকে নিবেদিত করেছেন। সামাজিক এনলাইটেনমেন্টের জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রামে লক্ষণীয় দ্বিতীয় ব্যাপার হলো, সবকিছু পণ্যে পরিণত হচ্ছে। সবকিছুই ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যাপার। ফল দাঁড়িয়েছে, মানুষ মুনাফা বোঝে, আর কিছুই বোঝে না।

ফলে আত্মকেন্দ্রিকতা বাড়ছে। মানুষ ভিড়ের মধ্যে বাস করছে, কিন্তু পরস্পর বন্ধু হতে পারছে না। ব্যক্তি ভয়াবহভাবে একাকী হয়ে চলছে। তার একটি জগৎ, সেখানে অন্য কেউই নেই, এখানেই সে ভাববে, বাঁচবে, মরবে। অন্যরা মরবে, সে তুলবে সেলফি। ভোগের সুবিধার জন্য অন্যকে সঙ্গ দেবে। কিন্তু সঙ্গটি, হাসিটি, কথাটিও তখন বিনিময় কামনা করবে। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্য নৈতিক একটি ভিত্তিভূমি লাগবে, মূল্যবোধ লাগবে, বিশ্বাস লাগবে। কিন্তু ভোগবাদ মূল্যবোধগুলোকে ব্যবহারিক জীবন থেকে সরিয়ে দিচ্ছে আর পুঁজিতান্ত্রিক সংস্কৃতি সেগুলোর ওপর বুলডোজার চালাচ্ছে। চতুর্দিকে তার কী যে কাতরানি!

এই পরিস্থিতিতে সাংস্কৃতিক আন্দোলন দাঁড়ানোর ভিতই পায় না। এতে আধিপত্যবাদী সংস্কৃতির পুরোটাই লাভ। সে মানবিক জীবনে ভাঙন ও আত্মকেন্দ্রিকতার বিপদকে আরো উসকিয়ে দেবে। ভোগের আসরকে বেসামাল করে ঈষৎ হাসবে, ভাবখানা এমন যে, প্রমত্ত হও, সেবন করো, তারপর যখন সম্বিৎ হারাবে, তখন সবই আমার। সার্বভৌমত্বসহ পুরো ভূখণ্ড ও মানুষ! এ বিষয়ে আমাদের সচেতনতা পরিপক্ব হয়ে ওঠেনি বলেই ‘উন্নয়ন উন্নয়ন’ বলে খুবই বগল বাজাই, কিন্তু উন্নয়ন কোথা থেকে শুরু করতে হবে- এ প্রশ্নটি থেকে যায় অন্ধকার।

রাস্তাঘাট ভালো হলো, ব্যবসাবাণিজ্য ভালো হলো, একটি সরকার, চলনসই একটি প্রশাসন, শক্ত সামরিক বাহিনী-রাষ্ট্রের জন্য এগুলো অপরিহার্য হলেও রাষ্ট্র রক্ষার জন্য তা যথেষ্ট নয়। রাষ্ট্র রক্ষা, এর বিকাশ ও সামাজিক সংহতির ভিত্তি গড়ে উঠবে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক এনলাইটেনমেন্টের মাধ্যমে। অতএব, আমাদের দেশে একটু প্রবৃদ্ধি, একটু নতুন সেতু-অবকাঠামো, এ নিয়ে আহ্লাদিত হওয়ার বিশেষ কিছু নেই এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক ব্যবস্থায় ইতিবাচক ও গুণগত পরিবর্তন আসবেÑ বড় রকমের আশাবাদী লোকও এটা বলতে পারে না।

তাহলে কী করা যেতে পারে? করা যেতে পারে যে কাজটি তা হলো, এনলাইটেনমেন্টের জন্য গণস্তরে সাংস্কৃতিক সংগ্রামের সূচনা। এ জন্য জ্ঞান, সংস্কৃতি, মানবিক মূল্যবোধ ও মুক্তি আন্দোলনের অভিন্ন সংহতি নিয়ে জনগণের চেতনাবোধকে প্রশিক্ষিত করার কর্তব্য পালন করতে হবে। এটি অবশ্যই জাতি-রাষ্ট্রের নাগরিকদের বোধ-বিশ্বাস, ঐক্যচেতনা, ধর্মীয় প্রত্যয় ও ঐতিহাসিক ধারা-পরিক্রমায় গণচাহিদার গতিমুখের ভিত্তিতে হতে হবে। এই দায়িত্ব পালনে সক্ষম প্রধানত তারাই, যারা জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রতিনিধিত্ব করেন। মুসলিম প্রধান এই জনগোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্যবোধের বুনিয়াদ তৈরি হয়েছে ইসলাম প্রদত্ত আত্মপরিচিতির ভিত্তিতেই।

জাতিসত্তার ঐতিহাসিক বিকাশ, আত্মপরিচয় ও সাংস্কৃতিক স্বকীয়তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন, এমন কারো পক্ষে এ দেশে সাংস্কৃতিক আলোকায়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখা সম্ভব নয়। যে আলোকায়ন ইউরোপে ঘটেছিল সেখানকার সমকালীন পরিস্থিতি বিচারে। অষ্টাদশ শতকের শেষাংশে যাজকশ্রেণী ও সামন্তপ্রভুদের থেকে সমদূরত্বে, একটি প্রশিক্ষিত, মধ্যবিত্ত শ্রেণী বিকাশ লাভ করে। তাদের হাতে ছিল ফরাসি বিপ্লবের রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্বের লাগাম। ভলতেয়ার ছিলেন এর তাত্ত্বিক মুখপাত্র। বিপ্লব হলো, এলো এনলাইটেনমেন্ট। এর পুরোভাগে একদল বুদ্ধিজীবী, যারা তাদের সাংস্কৃতিক প্রস্তুতিকে সামাজিক বাস্তবতার শিখরে উপনীত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে সামাজিক জীবন নতুন গতি, নতুন ভাবধারা ও একক সত্তার প্রতীকী অবয়বে সক্ষম হয়ে উঠল।

সমগ্র ঊনবিংশ শতক পশ্চিম ইউরোপে একটি প্রধানত, মসিজীবী গোষ্ঠীর সঙ্ঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় জাগ্রত ছিল, যে প্রচেষ্টায় নিহিত ছিল ইউরোপের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানস চেতনার উজ্জ্বল প্রকাশ। তা রাজনীতিকে স্বাভাবিকভাবে গুণগতমানে উন্নীত করেছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির সুশীল চর্চা নিশ্চিত করেছে। ফলে ইউরোপ শুধু সম্মুখ দিকেই ছুটেছে, পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বাংলাদেশে ইতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনো গড়ে ওঠেনি। এটি হয়তো এ জন্যই যে, রাজনীতি সাংস্কৃতিক প্রস্তুতির ফলাফলরূপে বিকশিত হয়নি এবং এর পেছনে বুদ্ধিবৃত্তিক কোনো গণভিত্তি তৈরি হয়নি।

এসব কিছুর মূল কারণ হচ্ছে, জাতীয় সংস্কৃতির প্রশ্নে বিরাট এক ভ্রান্তি। নিজেদের ঘরের ভেতরে ঘর দাঁড় করানোর প্রতিবন্ধকতা। সে প্রতিবন্ধকতায় ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকেন্দ্রিক এমন সব অপরিণামদর্শী তৎপরতা আমরা সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে পরিচালনা করছি, যা পরিণতি ব্রাহ্মণ্যবাদের কাছে আমাদের সংস্কৃতির আত্মসমর্পণ যেন নিশ্চিত করতে চায়!

ফলে জাতি-রাষ্ট্র একদিকে মৃত্তিকা ঐতিহ্যের আবদার ও অপরদিকে আগ্রাসী বাস্তবতার চোখ রাঙানির মুখোমুখি। অতএব, বিশ্বায়নের ঝড়ো হাওয়া যখন ঐতিহ্য ও অভিজ্ঞতার শেকড়গুলোকে উপড়ে ফেলতে শুরু করেছে, তখন বাংলাদেশের জন্য আত্মপরিচয়ের ভিত্তিতে গ্রহণ-বর্জনের একটি মানদণ্ড নির্ধারণ করা উচিত, যার মূল লক্ষ্য হবে মাটির আবদারের ভিত্তিতে ঐক্য, জাতীয় সংস্কৃতির সুরক্ষা ও নিরাপদ বিকাশ।

এটি না হলে, বিচিত্র ধরনের সাম্প্রদায়িকতা ও বহুকেন্দ্রিকতা দেখা দেবে। এটাই এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার বহু রাষ্ট্রের টেকসই হওয়ার প্রয়াস ব্যাহত করেছে এবং অনেক রাষ্ট্রকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে। বহুদিন হলো আমরাও তো জাতীয় জীবনে সমস্যার কাদাজল থেকে মাথা তুলতে পারছি না। পারবো না হয়তো আরো বহুদিন, যদি না ভাষা, ধর্ম, নৃতাত্ত্বিক গঠন, ভূখণ্ড, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বন্ধনমুক্তির সংগ্রামের ধারাবাহিক অভিজ্ঞতার যৌথ সামগ্রী দ্বারা জাতিসত্তাকে পরিপুষ্ট করে তুলি। এক অভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুভূতির দিকে এগোতে হবে। এই পর্যায়ে পৌঁছতে জনগোষ্ঠীকে বহু চড়াই-উতরাই পাড়ি দিতে হয়। এ জন্যই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা জাতিকে ultimate community হিসেবে গণ্য করেন। জনগোষ্ঠীর ultimate community হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে তার একক পরিচয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পরিচয়ের এই সত্তাই নির্ধারণ করে দেয় কিভাবে একটি জনগোষ্ঠী অন্য জনগোষ্ঠী থেকে পৃথক। এরপরই সূচিত হয় একক সত্তায় উপনীত জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংহতি ও সহানুভূতিবোধ দৃঢ় করার রাজনৈতিক সংগ্রাম।

তখন জাতি নির্মাণের পরবর্তী পথ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে, সুগম হয়ে ওঠে। এই পথ ধরেই বাংলাদেশের সমৃদ্ধি, জনকল্যাণ এবং বিশ্বসভায় মাথা উঁচিয়ে দাঁড়ানোর প্রেক্ষাপট রচনা করতে হবে। আজকের প্রেক্ষাপটে এর অপরিহার্যতা বৈদ্যুতিক অক্ষরে লেখা নোটিশের মতো ঝলকাচ্ছে জাতীয় জীবনের মাথার ওপর।


আরো সংবাদ



premium cement