১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দেশের স্বার্থে কৃষককে বাঁচাতে হবে

-

দেশে এবার বোরোর ভালো ফলন হওয়ায় মওসুমে ধানের দাম অনেক কম। ফলে কৃষকের উৎপাদন খরচ উঠছে না। কৃষককে সহযোগিতা করতে প্রতি বছরের মতো ২৫ এপ্রিল ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু করেছে সরকার, যা ৩১ আগস্ট শেষ হবে। ২৬ টাকা দরে চলমান বোরো মওসুমে সাড়ে ১২ লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহ করা হবে। এ ছাড়া ৩৬ টাকা দরে ১০ লাখ টন সিদ্ধচাল এবং ৩৫ টাকা দরে দেড় লাখ টন আতপচাল সংগ্রহ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আরো দুই লাখ ৫০ হাজার টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

বিবিএস ও ডিএই তথ্যানুযায়ী, দেশে মোট জমির পরিমাণ এক কোটি ৪৪ লাখ ২২ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে কৃষি উৎপাদনে ফসলি জমি ৮০ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর। এ ছাড়া, নদী এলাকা ৮.২৩৬ বর্গকিলোমিটার আর বনাঞ্চলের আয়তন ১৯.৭১০ বর্গকিলোমিটার। কৃষি খাতে দুই কোটি ২৯ লাখ ৩১ হাজার জনশক্তি নিয়োজিত। প্রতিদিন জনপ্রতি ৪৫৩ দশমিক ৫৩ গ্রাম হিসেবে দেশে খাদ্যশস্যের চাহিদা দুই কোটি ৪৫ লাখ ২০ হাজার টন। কৃষি খাত হতে জিডিপির অবদান ২১ দশমিক ১০ শতাংশ। এর মধ্যে ফসলি খাত হতে ১১ দশমিক ৭২ শতাংশ। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশে দুই কোটি পাঁচ হাজার কার্ডধারী কৃষক আছেন। তাদের মধ্যে এক কোটি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি। সহযোগিতা করতে কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনার যে নীতিমালা সরকার নিয়েছে; তা কিন্তু কৃষকবান্ধব নয়। কারণ, কেনার সময় শর্তের মধ্যে রয়েছে, ধানের আর্দ্রতা হতে হবে ১৪ শতাংশ। এ ছাড়া ধানে বিজাতীয় পদার্থ থাকবে দশমিক পাঁচ শতাংশ, ভিন্ন জাতের ধানের মিশ্রণ সর্বোচ্চ আট শতাংশ, অপুষ্ট ও বিনষ্ট দানা দুই শতাংশ ও চিটা ধান দশমিক ৫ শতাংশ।

কৃষক বাড়িতে ধান শুকিয়ে খাদ্যগুদামে সরবরাহ করতে গেলে বেশির ভাগ সময় তা ফেরত দেয়া হয়। কারণ, ধান যথেষ্ট শুকনো নয়। কৃষকেরা বাড়ির মাটির উঠানে ধান শুকালে তার আর্দ্রতা ১৫ বা ১৬ শতাংশের নিচে সাধারণত নামে না। ধানের আর্দ্রতা ১৫-এর নিচে নামাতে গেলে তা শুকাতে হবে চাতালে অথবা যেকোনো কংক্রিটের চত্বরে। এ সত্য জানা থাকার পরেও, খাদ্যশস্য সংগ্রহ নীতিমালায় এমন শর্ত কিভাবে ঠাঁই পায়? অথচ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহের সময় আর্দ্রতার পরিমাপ করা হয় না। গুদামজাত করার আগে সরকার নিজ দায়িত্বে ধান শুকিয়ে নেয়। পশ্চিমবঙ্গে ২৫ শতাংশ ধান সরকার সংগ্রহ করে। আর আমাদের দেশে সংগ্রহ করা হয় মাত্র পাঁচ শতাংশ।

প্রান্তিক কৃষকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, যদি ‘কৃষক তালিকা’ রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত হয়ও, তবু দেশের খাদ্যশস্য সংগ্রহের নির্দেশনায় যেসব শর্ত রয়েছে; তা প্রান্তিক পূরণ করা প্রান্তিক কৃষকের পক্ষে সম্ভব নয়। নেতা ধরেও সরকারি গুদামে ধান দিতে পারছেন না কৃষক। শুধু সরকারদলীয় প্রভাবশালী নেতারাই ধান সরবরাহ করতে পারছেন। ধান বেচার স্লিপও থাকছে তাদের হাতে। ওই সব নেতা রাতারাতি কৃষক বনে যাচ্ছেন। তারা কৃষকের কাছ থেকে কমে কিনে সরকারি গুদামে বেশি দামে ধান বিক্রি করছেন। তাই সরকারের ধান কেনায় কৃষক নন, দলীয় নেতারাই লাভবান হচ্ছেন। ধান-চাল সংগ্রহ নীতিমালা পরিবর্তন না হলে সরকারের এ সহায়তা কৃষকের কাছে পৌঁছাবে না।

কৃষকের ঘামঝরা ফসল ধান, ভুট্টা, গম, পাটসহ উৎপাদিত শাক-সবজির বাজারে দাম নেই। বাজারে এক মণ ধান বিক্রি করে কৃষকের একটি কামলার দাম হয় না। এক কেজি গরু-খাসির গোশত কিনতে পারেন না। সার, বীজ, কীটনাশকের দাম বাজারে কমতি নেই। ব্যাংকের কৃষিঋণ পরিশোধে ব্যর্থ কৃষকের জমিও নিলামে উঠে। তবু ঋণের সুদ মওকুফ হয় না। কৃষিতে উৎপাদন ব্যয়ের সাথে পণ্যের দাম ও শ্রমবাজারের কোনো সমতা নেই। এ বছর এক বিঘা বোরো জমি চাষ করতে কৃষকের খরচ হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার টাকা। ধান উৎপাদন হয়েছে গড়ে বিঘাপ্রতি ১৫ মণ। ৫০০ টাকা ধরে ধান বিক্রি করতে পারছেন কৃষক। প্রতি বিঘায় লোকসান সাড়ে ৬ হাজার টাকা। এ ছাড়া একজন কৃষিশ্রমিকের পারিশ্রমিক হিসেবে প্রতিদিন ৭০০ থেকে এক হাজার টাকা মজুরি দিতে হচ্ছে।

ঋণ করে ধান ফলিয়ে উৎপাদন খরচ তুলতে পারছেন না কৃষক। সার ও কীটনাশকের মূল্যের তারতম্য অনেক বেশি। দেশের প্রান্তিক চাষিরা সরকারি খাদ্যগুদামে সরাসরি তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি দিতে পারছেন না। ফড়িয়া ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে খাদ্যগুদামে ধান, গম কিনে মজুদ করা হচ্ছে। খাদ্যগুদাম থেকে এ মজুদ করা গম, চাল, ফ্রি সেল, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি, ভিজিডি কার্ড উপকারভোগীদের কাছে বিতরণ করা হলেও তারা সেই গম, চাল খেতে পারেন না। সেগুলো হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগলের খাবারে পরিণত করা হয়। কিন্তু খাদ্য গুদামে খাদ্যশস্য মজুদের অন্যতম উদ্দেশ্য ভবিষ্যতে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন সমস্যায় দেশের খাদ্য ঘাটতি মোকাবেলা করা।

কৃষকের এ অবস্থার উত্তরণে সহায়তার জন্য ১০-১৫ লাখ টন চাল রফতানি, কৃষিযন্ত্রে ভর্তুকি দেয়াসহ নানা পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। রফতানির ওপর ৩০ শতাংশ হারে ভর্তুকিও দেয়া হবে। কিন্তু এসব পদক্ষেপ প্রান্তিক কৃষককে কতটুকু সাহায্য করবে? বেসরকারি খাতে চাল রফতানি করা হলে, চাল ব্যবসায়ী ও মিল মালিকেরা নিজেদের মজুদ খালি করতে পারবেন, তারা উপকৃত হবেন। তাতে করে অবশ্য অভ্যন্তরীণ বাজারে ধানের চাহিদা বাড়বে, দামও বাড়বে। কিন্তু যেসব প্রান্তিক কৃষক ইতোমধ্যে তার উৎপাদিত ধান কম দামে বিক্রি করেছেন; তারা কিভাবে উপকৃত হবেন? সরকার নিজেকে কৃষকবান্ধব হিসেবে দাবি করে।

এমন দাবি করা সরকার কৃষকের মূল্যায়ন করবে এটিই স্বাভাবিক। সরকার কৃষককে উৎপাদন সহযোগিতা করছে সার, বীজ হাতের নাগালে পৌঁছে দিয়ে। সরকারের সহযোগিতার পরও দেশের প্রান্তিক চাষির মুখে হাসি নেই। কারণ দেশের প্রান্তিক কৃষক তাদের উৎপাদিত ফসল খাদ্যগুদামে সহজে বিক্রি করতে পারছেন না। ফসল বাজারে নিলে সঠিক দাম পান না। একশ্রেণীর মধ্যস্বত্বভোগী ও ব্যবসায়ী চক্রের কারণে দাম পান না কৃষক। কিছু রাজনৈতিক নেতার কারণে অনেক এলাকার কৃষক সরাসরি খাদ্যগুদামে ধান সরবরাহ করতে পারেন না।

দেশের প্রান্তিক চাষিদের সার, তেল ও বিদ্যুতে ভর্তুকি দেয়ার নামে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত প্রান্তিক চাষিরা ওই সুবিধা কখনো পাইনি। একশ্রেণীর রাজনৈতিক ব্যক্তি, সরকারি আমলা ও কিছু জমির মালিক নামে-বেনামে সেই ভর্তুকির টাকা নিয়ে লুটেপুটে খাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে প্রান্তিক চাষিরা বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। প্রান্তিক চাষিদের ব্যাংকে কৃষিঋণ নিতে দালালচক্রের সহযোগিতা লাগে। ঘুষ না দিলে সঠিক সময়ে ব্যাংকের ঋণ সুবিধা পান না কৃষক। বরং ঋণের জন্য তাকে মাসের পর মাস সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে কিংবা ব্যাংকে গিয়ে ধরণা দিতে হয়।

যে কৃষক ঋণ পরিশোধ করতে পারেন না; তাদের নামে মামলা হামলা হচ্ছে। কিন্তু দেশের একশ্রেণীর জনপ্রতিনিধি আর আর খাদ্য বিভাগের অসাধু কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে গোটা দেশ ও জাতির জন্য মজুদ করা খাদ্যশস্য ভবিষ্যতে গোখাদ্যে পরিণত হয়। দেশের ১৫টি চিনি কলের উৎপাদিত চিনি সঠিক সময়ে বিক্রি হয় না। লাখ লাখ টন চিনি মজুদ থাকার পরও দেশে নিম্নমানের চিনি আমদানি করা হয়। জনসাধারণ দেশের পণ্যসামগ্রী নিতে চান, খেতে চান, ব্যবহার করতে চান। কিন্তু দেশ পরিচালনার সাথে জড়িতদের সৎ ইচ্ছার অভাবে দেশীয় কলকারখানার উৎপাদিত পণ্য নাগরিকেরা সহজ মূল্যে হাতের নাগালে পান না।

দেশ স্বাধীনের পর অন্যান্য ক্ষেত্রের চেয়ে কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে। বুয়েট স্ট্যাডি রিপোর্র্ট/২০০৮ তথ্য মতে; কৃষি থেকে ২২ শতাংশ জিডিপি এবং ৬০ শতাংশ মানুষের জীবিকা নির্বাহ করে। কৃষি অধিদফতরের তথ্য মতে, দেশের গ্রামাঞ্চলে জনসংখ্যার ৮৪ শতাংশ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এদিকে ১৯৯০ সাল হতে ২০০০-২০০১ অর্থবছর থেকে খাদ্যশস্যে আমরা কিছুটা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি।

এ মুহূর্তে কৃষিজমি ও কৃষককে বাঁচাতে না পারলে কৃষিব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। দেশে অদূর ভবিষ্যতে দেখা দিতে পারে তীব্র খাদ্যসঙ্কট। কৃষিনির্ভরশীল বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এ তথ্য ভয়াবহ। ভালো ফলন পেয়েও বাজারে দাম না পেয়ে চাষিদের মুখে হাসি নেই। দেশের প্রান্তিক চাষিদের ভাগ্য উন্নয়নে যত্তসব কথার ফুলঝুরি শোনা যায় বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন নেই।

bcetetulia @gamil.com


আরো সংবাদ



premium cement