২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

জাতীয়করণের প্রত্যাশা ও প্রাথমিক বিদ্যালয়

-

আমরা জানি, যেকোনো বিল্ডিংয়ের ভিত মজবুত না হলে সেটিকে বহুতল ভবনে রূপান্তর করা যায় না। প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয় শিক্ষার ভিত। সে কারণে উন্নত দেশে প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়ে থাকে। কারণ, প্রাথমিক শিক্ষা শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান সোপান। অথচ আমাদের দেশে ব্রিটিশ আমল থেকে প্রাথমিক শিক্ষার করুণ দশা বিরাজিত ছিল। পাকিস্তান আমলেও সরকারিভাবে প্রাথমিক শিক্ষার পেছনে খুব কম অর্থ ব্যয় করা হতো। মূলত প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা দুর্বল থাকার কারণে দেশের জনসংখ্যার শিক্ষার হার ছিল অত্যন্ত স্বল্প। প্রাথমিক শিক্ষকেরা সমাজে মর্যাদার আসনে আসীন ছিলেন না। বর্তমানে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে।

তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষাকে মর্যাদা দেয়ার পেছনে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান স্মরণীয়। তিনি ১৯৭৩ সালে ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে শিক্ষাক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু-তনয়া শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে প্রায় ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে প্রাথমিক শিক্ষার দৃঢ়করণে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। দেশে ৬৩ হাজার ৬০১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। প্রাথমিক শিক্ষাকে সার্বজনীন করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়বিহীন কোনো গ্রাম থাকবে না। বাংলাদেশে ৮৭ হাজার ৩১৯টি গ্রাম আছে। দেশে বিদ্যালয়বিহীন গ্রামের সংখ্যা এখনো অনেক। এমন অনেক অঞ্চল আছে, যেসব এলাকায় প্রতি গ্রাম তো দূরের কথা, দু-তিন গ্রামের মধ্যেও কোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই।

বাস্তবতা হলো প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পর্যন্ত যথাযথভাবে অনেক ক্ষেত্রে পালিত হয় না। এ কারণে বাংলাদেশে এমন অনেক গ্রাম আছে, যেসব গ্রামে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে একাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে অতীব প্রয়োজনীয় এলাকা ও সরকারি বিদ্যালয়বিহীন অবস্থায় পড়ে আছে। বর্তমানে দেশে প্রায় পাঁচ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের অপেক্ষায়। এসব বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান থেকে বঞ্চিত। কারণ বর্তমানে সরকার প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে বিনা মূল্যে বই প্রদান ও উপবৃত্তি প্রদান, কোথাও বা দুপুরে টিফিনের ব্যবস্থা করেছে। বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের এসব সুযোগ-সুবিধা পূর্ণাঙ্গভাবে প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অনেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয় ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। অনেকে শিক্ষাক্ষেত্র থেকে ঝরে পড়ছে।

এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও দীর্ঘ দিন বিনা বেতনে শিক্ষকতা করে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। গত ১৬ জুন থেকে জাতীয়করণ থেকে বাদ পড়া প্রায় পাঁচ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারীকরণের দাবিতে বেসরকারি শিক্ষক সমিতির ব্যানারে ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান ধর্মঘট করা হচ্ছে। এ শিক্ষকেরা গত ৩ জুলাই থেকে সেখানে আমরণ অনশন শুরু করেছেন। এবারের আন্দোলনে মোট ১৮১ জন শিক্ষক অসুস্থ হয়েছেন বলে দাবি করেছেন অনশনরত শিক্ষকেরা। বেসরকারি শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো: মামুনুর রশীদ বলেছেন, কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান ধর্মঘট চলছে। আমরণ অনশনরত ৩৫ জন শিক্ষক গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি আরো জানান, প্রায় পাঁচ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরকারি ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত আমরণ অনশন কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের ন্যায্য আন্দোলনের পক্ষে অদ্যাবধি অনুকূল মতামত প্রদান করা হয়নি।

এসব আন্দোলনরত শিক্ষক দীর্ঘ দিন ধরে বিনা বেতনে হাজার হাজার শিশুকে শিক্ষা দান করে চলেছেন। এসব আত্মত্যাগী শিক্ষকের নতুন করে কোনো কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। সরকার শিক্ষিত জাতি গঠনের মাধ্যমে দেশের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে দেশের শিক্ষার হার শতভাগ উন্নীত করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। তদুপরি কোনো শিক্ষার্থী যেন শিক্ষাক্রম থেকে ঝরে না পড়ে সে দিকে বিশেষ নজরদারির নির্দেশ প্রদান করেছে। মানবিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর উক্তি বাস্তবায়ন করতে হলে এবং শতভাগ শিক্ষিত জাতি গড়তে হলে, শিক্ষাকার্যক্রম থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের গতি রোধ করতে হলে আন্দোলনরত শিক্ষকদের ন্যায্য দাবিকে সরকার গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করবে, সুধী মহলের এটাই প্রত্যাশা।

দীর্ঘ দিনের অবহেলিত কওমি মাদরাসার দাওরা হাদিসের সনদকে এই সরকার মাস্টার্সের সমমানের মর্যাদা প্রদান করেছে। বেসরকারি প্রায় সাড়ে চার হাজার স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসাকে এমপিও আওতাভুক্ত করছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের মানসম্মত এবং এমপিওভুক্তি থেকে বাদ পড়া স্কুল, কলেজ ও মাদরাসাকে এমপিওভুক্তির আওতাভুক্ত করছে। শিক্ষাক্ষেত্রে এসব হচ্ছে যুগান্তকারী পদক্ষেপ। মানবিক কারণে এবং প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতির লক্ষ্যে সরকার আন্দোলনরত শিক্ষকদের ন্যায্য দাবিকে মূল্যায়ন করাই সময়ের দাবি। কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুরাও যেন প্রাথমিক শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না হয়, সে বিষয়েও সরকারের সজাগ দৃষ্টি রাখা একটি বড় কর্তব্য।


আরো সংবাদ



premium cement