২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

এই কাহিনী লিখব আর কতকাল?

তাবরেজ আনসারি -

গণপিটুনিতে ঝাড়খন্ডের ২৪ বছর বয়সী যুবক তাবরেজ আনসারির ভয়ঙ্কর মৃত্যু পুরো জাতিকে ঝাঁকিয়ে দিয়েছে। এ হিংস্রতা ও বর্বরতার বিরুদ্ধে পুরো দেশজুড়ে বিক্ষোভ করা হচ্ছে। এমনিতেই, গত পাঁচ বছরে গণপিটুনির নিকৃষ্ট অনেক ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু আনসারির মৃত্যুর বিরুদ্ধে দেশজুড়ে যে কঠোর প্রতিবাদ দেখা যাচ্ছে, তার দ্বিতীয় নজির আর দেখা যায় না। এ বিষয়ে সবাই ব্যথিত যে, একজন নিরপরাধ যুবককে শুধু এ জন্য হিংস্রতা ও পাশবিকতার লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছে, কারণ সে মুসলমান ছিল এবং তার নাম ‘তাবরেজ আনসারি’।

যে সময় তাকে চুরির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়, তখন তিনি আঘাতজনিত ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন, কিন্তু পুুলিশ চিকিৎসার ব্যবস্থার পরিবর্তে তাকে চার দিন কয়েদখানায় ফেলে রাখে। উপর্যুপরি পিটুনির আঘাত সহ্য করতে না পেরে তিনি মারা যান। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, পুলিশ বন্দী অবস্থায় তাবরেজ আনসারির কাছ থেকে অপরাধের ‘স্বীকারোক্তি’ আদায় করেছে বটে; কিন্তু তাদের রিপোর্টে ওই হিংস্র পশুদের কোনো কথা উল্লেখ করা সমীচীন মনে করেনি, যারা আনসারিকে বিদ্যুতের খুঁটিতে বেঁধে নির্দয়ভাবে মেরেছিল। তাবরেজ পুনেতে কাজ করতেন। তিনি ঈদের ছুটি কাটাতে বাড়ি এসেছিলেন। তার বিয়েও হয়েছে কয়েক মাস আগে। এ নিকৃষ্ট ঘটনার চার দিন পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাবরেজ আনসারির মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তবে তিনি যে বিষয়টি নিয়ে বেশি দুঃখপ্রকাশ করেছেন, তা হলোÑ এ ঘটনার কারণে পুরো ঝাড়খন্ডের বদনাম কেন করা হচ্ছে?

প্রধানমন্ত্রী রাজ্যসভায় বিরোধী দলের নেতা গোলাম নবী আজাদের এ বক্তব্যের জবাব দেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন; যেখানে আজাদ বলেছিলেন, ঝাড়খন্ড গণপিটুনির কেন্দ্রে পরিণত হতে যাচ্ছে। যদি প্রধানমন্ত্রী মোদি গোলাম নবী আজাদের বক্তব্য তলিয়ে দেখতেন, তাহলে তিনি জানতে পারতেন, ঝাড়খন্ডে বিজেপির ক্ষমতায় আসার পর গণপিটুনির যত ঘটনা ঘটেছে, তা পুরো দেশেও ঘটেনি। নির্ভরযোগ্য তথ্য মোতাবেক, ঝাড়খন্ডে এখন পর্যন্ত ১৮ জন্য নিরোপরাধ ব্যক্তিকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর মতো আমাদেরও এটা দুঃখ যে, গণপিটুনির ঘটনায় ঝাড়খন্ড নয়, পুরো ভারতেরই বদনাম হচ্ছে। আমরাও প্রধানমন্ত্রীর মতো ভারতের কপাল থেকে এ কলঙ্কের দাগ মেটাতে চাই, কিন্তু এ কলঙ্ক শুধু মুখের কথায় মিটবে না, বরং এর জন্য প্রধানমন্ত্রীকে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি, তার হিতাকাক্সক্ষী ও সমর্থকদের এ বার্তা দিতে হবে যে, তিনি সংখ্যালঘুদের মন থেকে ভয় দূরীকরণ সম্পর্কে পার্লামেন্টে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, তা নিছক লোক দেখানো ছিল না এবং তিনি বাস্তবিকই মুসলমানদের অন্তর থেকে ভয়-ভীতি দূর করতে চাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীকে এ কথা সার্বিকভাবে অন্তরে গেঁথে রাখতে হবে, গণপিটুনির অব্যাহত ঘটনার কারণে শুধু ঝাড়খন্ডই নয়, বরং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গোটা ভারতের বদনাম হচ্ছে।

এর টাটকা প্রমাণ ধর্মীয় স্বাধীনতা সম্পর্কে আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের রিপোর্ট, যাতে ভারতকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষ থেকে জারি করা রিপোর্টে ২০১৮ সালের বিভিন্ন দেশের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে গিয়ে ভারত সম্পর্কিত অধ্যায়ে বিস্তারিতভাবে গণপিটুনি ও অন্যান্য সমস্যার বিশ্লেষণ করা হয়েছে। রিপোর্টে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি এ কথাও বলা হয়েছে, ভারতে সাম্প্রদায়িকতাকে ভিত্তি করে হত্যা, হামলা, দাঙ্গা-ফাসাদ, পক্ষপাতিত্ব ও উগ্রতা এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, শাসকদল বিজেপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান করে থাকেন। কিছু বেসরকারি সংস্থার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, বেশির ভাগ বিচারক অপরাধীদের আইনি কার্যক্রম থেকে খালাস করে দিয়েছেন।

পক্ষান্তরে ভারত সরকার আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের উল্লিখিত রিপোর্টকে এ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে যে, দেশের সংবিধান সংখ্যালঘুসহ সব নাগরিকের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করেছে। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রবীশ কুমার নতুন দিল্লিতে বলেন, ‘ভারতের সেকুলারিজমের ওপর আস্থা, সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র ও দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা উদারতা এবং ঐক্যবদ্ধ সমাজব্যবস্থার কারণে গর্ব রয়েছে।’ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আমেরিকার রিপোর্টকে প্রত্যাখ্যান করতে গিয়ে যে বাক্য চয়ন করেছেন, তা নিশ্চিতরূপে খুব সুন্দর ও চিত্তাকর্ষক। কিন্তু ওই বাক্যাবলির প্রতিধ্বনি বিগত পাঁচ বছরে ভারতে একেবারো শোনা যায়নি।

দুঃখের কথা, গত মেয়াদে যেখানে মুসলমানদের ওপর গো-হত্যার মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করে তাদের প্রাণে মারা হয়েছে, এখন সেখানেই মুসলমানদের ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে বাধ্য করা হচ্ছে এবং তাদের মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। জুনের শেষ সপ্তাহে দিল্লি, কলকাতা, ঝাড়খন্ড, বিহার প্রভৃতি এলাকায় এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যেখানে দাড়ি-টুপিধারী মুসলমানদের মারধর এবং তাদের ‘জয় শ্রীরাম’ ঘোষণা দিতে বাধ্য করা হয়েছে। ‘জয় শ্রীরাম’ সেøাগান এতটাই ব্যাপকতা অর্জন করেছে, প্রধানমন্ত্রী জাপান পৌঁছলে সেখানে বসবাসরত ভারতীয়রাও ‘জয় শ্রীরাম’ সেøাগান দিয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানান। এর আগে পার্লামেন্টেও এ সেøাগান দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সেকুলার গণতান্ত্রিক দেশের ভেতর ধর্মীয় সেøাগানের অবস্থান কী? আর তাকে এতটা সুযোগ কেন দেয়া হচ্ছে যে, সীমানার ওপারে বসবাসরত ভারতীয়রাও ‘জয় হিন্দ’ বলার পরিবর্তে ‘জয় শ্রীরাম’ বলছে! এটা ভারতের সেকুলার গণতান্ত্রিক চেহারাকে বিকৃত করার পরিকল্পিত ছক নয় তো? গণপিটুনির শিকার মুসলমানদের সবচেয়ে বড় কষ্ট হচ্ছে, তাদের হত্যা ও আক্রমণে জড়িত ব্যক্তিদের ব্যাপারে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দৃষ্টিভঙ্গি চরম নমনীয় ও ভ্রাতৃসুলভ।

এর টাটকা প্রমাণ তাবরেজ আনসারির ঘটনাতেও পাওয়া যায়, যেখানে পুলিশ হামলাকারীদের গ্রেফতারের পরিবর্তে সমস্ত কার্যক্রম আনসারি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রেখেছে। এ অবস্থায় তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হলেন। গণপিটুনির সর্বপ্রথম ঘটনা ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে উত্তরপ্রদেশে দাদরি শহরে ঘটেছিল, যেখানে মুহাম্মদ আখলাক নামের এক ব্যক্তিকে গো-হত্যার মিথ্যা অভিযোগে নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়েছিল। ওই ঘটনায় যতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, তারা সবাই জামিনে ছাড়া পেয়ে গেছে। আর এ মামলা এতটাই শম্ভুক গতিতে চলছে যে, মনে হয় না- কারো শাস্তি হবে। গণপিটুনির অপর মামলাগুলোরও একই অবস্থা। আর এসব কিছু সুপ্রিম কোর্টের ওই নির্দেশনা সত্ত্বেও হচ্ছে, যেখানে অপরাধীদের সাথে অত্যন্ত কঠোর আচরণের কথা বলা হয়েছে। গণপিটুনির ঘটনাগুলোর বিরুদ্ধে এমনিতেই পুরো ভারতে উদ্বেগ ও ক্ষোভ বিরাজ করছিল, তাবরেজ আনসারির মর্মান্তিক মৃত্যু তাকে চূড়ান্তপর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে। দেশের প্রতিটি শহরে মানুষ তার হৃদয়বিদারক ছবিসমেত সর্বাত্মক প্রতিবাদ করছে।

তবে এ বিষয়ে মুসলিম নেতারা ও মুসলিম সংগঠনগুলোর ভেতর যে যৌথ কর্মসূচি নেয়া উচিত ছিল, তা কিন্তু নজরে পড়ছে না। মুসলিম সংগঠনগুলো নিজ নিজ প্লাটফর্ম থেকে বিবৃতি প্রদান করছেন এবং নিজেদের পতাকাতলে প্রতিবাদও করছেন। কিন্তু পরিস্থিতি যেভাবে খারাপের দিকে মোড় নিচ্ছে, তার প্রেক্ষাপটে কোনো সম্মিলিত পদক্ষেপ নজরে পড়ছে না। উচিত ছিল, সকল মুসলিম দল সেকুলার ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে সাথে নিয়ে এমন হত্যাযজ্ঞ প্রতিহত করার জন্য কার্যকর কর্মসূচি হাতে নেয়া। কিন্তু এমনটি হতে দেখা যাচ্ছে না। একই অবস্থা রাজনৈতিক নেতাদেরও। পার্লামেন্টেও বিভিন্ন দলের মুসলিম সদস্যরা ব্যক্তিগতভাবে সোচ্চার হয়েছেন।

যদি পার্লামেন্টের সব মুসলিম সদস্য সেকুলার দলগুলোর সদস্যদের সাথে যৌথভাবে কোনো বড় ধরনের বিক্ষোভের ব্যবস্থা করতেন, তাহলে তাদের শুভাকাক্সক্ষীরা প্রস্তুত হতো। এত নাজুক পরিস্থিতিতেও মুসলিম নেতারা ও মুসলিম দলগুলোর মধ্যে বিক্ষিপ্ততা দেখে কোনো উৎসাহমূলক দৃশ্যের অবতারণা হচ্ছে না। জুলুম ও বর্বরতার অব্যাহত ঘটনা নিয়ে লিখতে লিখতে আমাদের কলমও জবাব দিতে শুরু করেছে, আমরা কতকাল মাতম করতে থাকব? আমাদের নিজেদের ওই কবিতার মতো মনে হচ্ছে, যেখানে বলা হয়েছে- বহায়েঁ আশক কব তক, কারেঁ আহো ফুগান কব তক/ জিগার কে খুন সে লিখেঁ সেতাম কী দাস্তাঁ কব তক- অশ্র“ ঝরাব কতকাল, আহাজারি করব কতকাল/ কলিজার রক্তে জুলুমের কাহিনী লিখব আর কতকাল?

লেখক: ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট

মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক উর্দুটাইমস ৩০ জুন,
২০১৯ থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement