২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

কৃষিপণ্যের জাকাত দিন

-

অনেকেই ভাবতে পারেন, কৃষিপণ্যের জাকাত আবার কী? কৃষিপণ্য হয়ইবা কতটুকু, তার জাকাত কিভাবে দেবো? আর জাকাত যদি দিতে হয় তাহলে কতটুকু এবং কী পরিমাণ দিতে হবে? মহান আল্লাহ পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, তাঁর নির্দেশ মতো সবকিছু সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। কৃষিজমির খাজনা সরকারকে দিতে হয় এবং উৎপাদিত কৃষিপণ্যের হক (জাকাত) আদায় করতে হয়। মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত- অর্থাৎ সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। মানুষের জন্য পৃথিবীকে করেছেন বসবাসের উপযোগী আর মানুষের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস করেছেন জমিনকে। মহান আল্লাহ জমিন থেকে উৎপাদিত ফসলের ওপর জাকাত ফরজ করেছেন। মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা বাকারা, আয়াত ২৬৭ তে বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা যা উপার্জন করো এবং আমি যা ভূমি থেকে তোমাদের জন্য উৎপাদন করে দেই, এর মধ্যে যা উৎকৃষ্ট তা ব্যয় করো এবং তার নিকৃষ্ট বস্তু ব্যয় করার সঙ্কল্প করো না; অথচ তোমরা তা গ্রহণ করবে না, যদি না তোমরা বক্ষ বন্ধ করে থাকো। আর জেনে রেখো, নিশ্চয়ই আল্লাহ অভাবমুক্ত, প্রশংসিত।’

কৃষিজাত দ্রব্যাদি, সবজি মহান আল্লাহ মানুষের জন্যই সৃষ্টি করেছেন এবং তা থেকে হক আদায়ের জন্য বলেছেন। সূরা আবাসার ২৪ থেকে ৩২ নম্বর আয়াতে তিনি বলেন, ‘মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ করুক, আমি প্রচুর পানি বর্ষণ করেছি, এরপর ভূমিকে বিদীর্ণ করেছি, অতঃপর তাতে উৎপন্ন করেছি শস্য, আঙ্গুর, শাক-সবজি, জয়তুন, খেজুর, ঘন উদ্যান, ফল আর ঘাস তোমাদের ও তোমাদের চতুষ্পদ জন্তুগুলোর উপকারার্থে।’

মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা আন’আম, আয়াত ১৪ তে বলেন, ‘তিনিই লতা ও বৃক্ষ-উদ্যানসমূহ সৃষ্টি করেছেন এবং খেজুর গাছ, বিভিন্ন স্বাদবিশিষ্ট খাদ্যশস্য, জয়তুন ও ডালিমও সৃষ্টি করেছেন; এগুলো একে অপরের সদৃশ এবং বিসদৃশও। যখন তা ফলবান হয় তখন তার ফল আহার করবে আর ফসল কাটার দিনে তার হক (জাকাত) দিবে এবং অপচয় করবে না; নিশ্চয়ই তিনি অপচয়কারীকে ভালোবাসেন না।’

আমরা বলতে পারি, কৃষিপণ্যের ওপর মহান আল্লাহ জাকাত ফরজ করেছেন; তবে, একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ উৎপাদনের পরে। কৃষিপণ্যের জাকাতের নিছাব ও পরিমাণ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘পাঁচ ওয়াসাকের কম উৎপন্ন ফসলের জাকাত নেই।’ (বুখারি হামিদ/১৪৮৪, ‘জাকাত’ অধ্যায়)

কিভাবে ওয়াসাক পরিমাপ করতে হবে? আসুন তা জেনে নেয়া যাক। এক ওয়াসাক সমান ষাট ছা। অতএব পাঁচ ওয়াসাক সমান (৬০ী৫) =৩০০ ছা। এক ‘ছা’ সমান দুই কেজি ৫০০ গ্রাম হলে ৩০০ ছা সমান ৭৫০ কেজি (মাসিক আত-তাহরিক)। অর্থাৎ, ১৮ মণ ৩০ কেজির বেশি হলে উৎপাদিত পণ্যের জাকাত দিতে হবে। এর কম পরিমাণে উৎপাদিত পণ্যের ওপর জাকাত ফরজ নয় (এক ছা সমান কত কেজি তা নির্ধারণ করতে হলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাথে যোগাযোগ করতে হবে, এখানে সম্ভাব্য ধারণা দেয়া হয়েছে)। এই পরিমাণ শস্য শুধু বৃষ্টির পানিতে উৎপাদিত হলে দশ ভাগের এক ভাগ জাকাত দেয়া ফরজ। আর নিজ ব্যবস্থাপনায় পানি দিয়ে উৎপাদন করা হলে ২০ ভাগের এক ভাগ জাকাত ফরজ। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘বৃষ্টি ও ঝরনার পানি দ্বারা সিক্ত ভূমিতে উৎপাদিত ফসল বা নালার পানিতে উৎপন্ন ফসলের ওপর ওশর (দশ ভাগের একভাগ) জাকাত ওয়াজিব। আর সেচ দিয়ে উৎপাদিত ফসলের ওপর অর্ধ ওশর (বিশ ভাগের একভাগ) জাকাত ওয়াজিব (বুখারি হাদিস/১৪৮৩, জাকাত অধ্যায়)।

আবার, কিছু পণ্য আছে যেগুলো বৃষ্টির পানি ও ব্যক্তিগত সেচ, উভয়ের মাধ্যমে উৎপন্ন হয়ে থাকে। যে শস্য শুধু বৃষ্টির পানি অথবা শুধু কৃত্রিম সেচের মাধ্যমে উৎপন্ন হয় না এবং কিছু অংশ বৃষ্টির পানিতে এবং কিছু অংশ কৃত্রিম সেচের মাধ্যমে উৎপন্ন হয়, সে শস্যের দশ ভাগের তিন-চতুর্থাংশ জাকাত দিতে হবে। কারো কুড়ি মণ ধান সম্পূর্ণরূপে বৃষ্টির পানিতে উৎপন্ন হলে তার দশ ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ দুই মণ জাকাত দিতে হবে। আর নিজে সেচ দিয়ে উৎপন্ন করলে তার কুড়ি ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ এক মণ জাকাত দিতে হবে। আর কিছু অংশ বৃষ্টির পানি ও কিছু অংশ নিজের সেচের মাধ্যমে উৎপন্ন হলে ৬০ কেজি অর্থাৎ এক মণ কুড়ি কেজি জাকাত দিতে হবে। ইবনু কুদামা রহ: বলেন, এ ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামের মধ্যে কোনো মতভেদ আছে বলে আমার জানা নেই (ইবনু কুদামা, শারহুল কাবীর ২/৫৬৩ পৃ.)

এখন প্রশ্ন হলো কয়েক ধরনের উৎপাদিত কৃষিপণ্য মিলে যদি পাঁচ ওয়াসাক পরিমাণের বেশি হয়, তবে জাকাত ফরজ হবে কি না। কোনো ব্যক্তির দশ মণ ধান ও দশ মণ গম উৎপন্ন হলে তিনি কি উভয় শস্য একত্র করে জাকাত আদায় করবেন নাকি পৃথকভাবে কোনোটি নিছাব পরিমাণ না হওয়ায় জাকাত আদায় করা থেকে বিরত থাকবেন এ ব্যাপারে সহিহ মত হলো- গম, যব, ধান ইত্যাদি প্রত্যেকটি পৃথক শস্য। অতএব শস্যগুলো পৃথকভাবেই নিছাব পরিমাণ হলে জাকাত ফরজ হবে, অন্যথায় নয়। তবে একই শস্যের বিভিন্ন শ্রেণী একই নিছাবের অন্তর্ভুক্ত। যেমন : বিভিন্ন শ্রেণীর ধান একই নিছাবের অন্তর্ভুক্ত (সহিহ ফিকহুস সুন্নাত ২/৪৫ পৃ:)।

অর্থাৎ একই ধরনের কৃষিপণ্য কিন্তু বিভিন্ন জাতের (ধান বিভিন্ন জাতের মিলে) যদি পাঁচ ওয়াসাক পরিমাণ হয়, তবে জাকাত ফরজ হয়ে যাবে। বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্য মিলে পাঁচ ওয়াসাক পরিমাণ হলেও সে ক্ষেত্রে জাকাত দেয়া ফরজ নয়। শর্ত হলো, ফসল যদি বিক্রি করে টাকায় রূপান্তর করা হয়, তখন তা টাকা হিসাব করে জাকাত আদায় করতে হবে। আর, এই ফসল এক বছরের বেশি সময় ধরে ঘরে থাকলেই জাকাত ফরজ হবে।

আসুন, ইসলামের জীবনবিধান মেনে চলি; জীবনকে সহজ করে তুলি এবং কৃষিপণ্যের জাকাত আদায় করে মহান আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভ করি।


আরো সংবাদ



premium cement