১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বগুড়ার উপনির্বাচন : ইসির আত্মতুষ্টি

-

ভারত উপমহাদেশ ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে বের হয়ে ভারত এবং পাকিস্তান নামে আলাদা দু’টি রাষ্ট্র গঠিত হয়। প্রায় ১২ শ’ মাইল দূরের দু’টি প্রদেশ অর্থাৎ তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশ) নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। জন্মলগ্ন থেকেই পাকিস্তানের পশ্চিমাংশের লোকেরা পূর্বাংশের লোকদের ওপর কর্তৃত্ববাদী শাসন চালুর চেষ্টা করে। প্রথমে ভাষা, এরপর সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক এমনকি গণতান্ত্রিক সব অধিকারে বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে পূর্ব পাকিস্তানিদের মনে অধিকার রক্ষার চেতনা উজ্জীবিত হয়। যার তৎকালীন ফল ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে পরাজিত করে যুক্তফ্রন্টের বিজয়। এ নির্বাচনে ৩০৯টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট পেয়েছিল ২২৮টি আসন। পশ্চিম পাকিস্তানের কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা কিংবা নির্বাচন কমিশন মানুষের ভোটের অধিকার বাধাগ্রস্ত করেনি।

যদিও এ নির্বাচনে বিজয়ী যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করে বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। কিন্তু ভোট কারচুপি হয়েছে, ভোটারেরা ভোট দিতে পারেননি বা আগের রাতেই ভোট হয়ে গেছে এমন কোনো তথ্য নেই। কাজেই বলা যায়, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমেই যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হয়েছিল। সময়ের বিভিন্ন পরিক্রমায় অনেক ইতিহাসের জন্ম দিয়ে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনেও পুরো পাকিস্তানের ৩১৩ আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসন পায়। আইয়ুব খানের পর ইয়াহিয়া খানের কঠিন স্বৈরশাসনও এ নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলেছে; এমন দৃষ্টান্ত কোনো গবেষণা কিংবা বইয়ে পাওয়া যায় না। ১৯৭০ সালের এমন একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যানের কারণে পাকিস্তান ভেঙে দুই টুকরো হয়ে যায়। অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। একটি নির্বাচনই যে স্বাধীনতার ম্যান্ডেট সুস্পষ্টভাবে দিতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন। মানুষের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে অস্বীকার করার কারণে বহু ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদের মতো এমন বিতর্কিত নির্বাচন হয়েছে বলে মনে হয় না।

গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে নির্বাচনই একমাত্র শর্ত নয়। তবে অন্যতম প্রধান শর্ত। একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও জনগণের অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে গণতন্ত্রের বাকি শর্তগুলো পূরণ করা সহজ। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেয়ার দায়িত্ব আমাদের দেশের সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী গঠিত নির্বাচন কমিশনের। ১১৮ (৪) অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন। আমাদের বর্তমান নির্বাচন কমিশন যে এ অনুচ্ছেদের দেয়া ক্ষমতাবলে কতটা শক্তিশালী এবং স্বাধীন, শৌর্যবীর্যে তাদের ধারে-কাছেও যে কেউ নেই; তা দেখিয়ে দিয়েছেন ৩০ তারিখের ভোট ২৯ তারিখ রাতে শেষ করে! নির্বাচন কমিশনের হুঙ্কারে পুলিশ বাহিনী থেকে শুরু করে নির্বাচন উপলক্ষে নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সব সদস্যই বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের মাঠছাড়া করার মতো গুরুদায়িত্ব অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে।

৩০ তারিখে কষ্ট করে কাউকে ভোটকেন্দ্রে যেতে হয়নি, অনিয়মের প্রতিবাদ করলে কত মানুষের রক্ত ঝরত তা-ও হয়নি। বেশির ভাগ ভোটার ভোট দিতে না পারলেও ৮০ শতাংশ ভোট কাস্ট হয়েছে; এমন চিত্র দেখানোও তো নুরুল হুদা কমিশনের কম বাহাদুরি নয়! তবে সিইসির এ বাহাদুরি দেশের ১০ কোটি ৪০ লাখ ভোটারের অধিকারকে কেড়ে নিয়েছে। একই সাথে এই দেশের সাংবাদিকদের ভোটকেন্দ্রের ছবি তোলা নিষেধ থাকলেও বিবিসির বেরসিক ফটোসাংবাদিক আগের রাতের ব্যালট বোঝাই বাক্সের ছবি তুলে সারা বিশ্বকে জানিয়ে দেন বাংলাদেশের ৩০ তারিখের ভোট আগের দিন রাতেই হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ এবং নির্বাচন কমিশন এতে ন্যূনতম লজ্জা না পেলেও লজ্জা পেয়েছেন দেশের ১৮ কোটি মানুষ। তাই জনগণ এ সরকারের নাম দিয়েছে ‘মিডনাইট সরকার’ এবং নির্বাচন কমিশনকে উপাধি দিয়েছে সরকারের আজ্ঞাবহ দাস।

ইতোমধ্যেই নির্বাচন কমিশনের সামনে সুযোগ চলে আসে তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত বদনাম ঘুচানোর। এই নির্বাচনে বিএনপি থেকে নির্বাচিত সব এমপি শপথ নিলেও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শপথ নেননি। এটিকেই সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে নির্বাচন কমিশন দেখিয়ে দিয়েছে, তারা কতটা নিরপেক্ষ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন করার সক্ষমতা রাখে।

গত ২৪ জুন বগুড়া-৬ আসনের উপনির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ ৫৭ হাজার ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে পরাজিত করে বিজয়ী হয়েছেন। নির্বাচন কমিশন এখন আত্মতুষ্টিতে ভুগতে পারে; কারণ এ নির্বাচনে ভোটের আগের দিন ভোটের বাক্স কেউ বোঝাই করেননি, কমিশন ভোটের হার অবিশ্বাস্য রকম বাড়িয়ে দেখায়নি। ভোটের আগের দিন বিরোধীদলীয় প্রার্থীর এজেন্টদের ভয়ভীতি দেখানো হয়নি। ভোটের দিন সকালে সরকারি দলের প্রার্থীর পক্ষে কাউকে সশস্ত্র মহড়া দিতেও দেখা যায়নি। ভোটারের উপস্থিতি ছিল ৩৪ শতাংশ, যা ৩০ ডিসেম্বরের অর্ধেকের কিছু বেশি। ৩০ ডিসেম্বর ভোট পড়েছিল ৬৫.৮ শতাংশ।

এমন একটি সুন্দর নির্বাচন উপহার দিয়ে সিইসি তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে পারেন। কারণ, এখন একটি উপমা দেয়ার ক্ষেত্র তৈরি হলো। আমরা কি বগুড়ার উপনির্বাচন সুষ্ঠু করিনি? এক ছাত্রনেতাকে বিবিসির এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি তো ছাত্র না; তাহলে ছাত্রসংগঠনের সভাপতি হলেন কিভাবে? জবাবে ওই ছাত্রনেতা বলেছিলেন, কেন আমি জাগন্নাথ থেকে মাস্টার্স করেছি না। তিনি আদৌ জগন্নাথে পড়েছিলেন কি না সে ইতিহাস কেউ জানেন না। আমাদের নুরুল হুদা কমিশনও ইউনিয়ন, সিটি এবং উপজেলা নির্বাচনের বারোটা বাজিয়ে ছাড়লেও উপমা দিতে ঠিকই ভুলবেন না, ‘কেন আমরা বগুড়ার উপনির্বাচন কি সুষ্ঠু করি নাই? সেখানে কি বিএনপি জিতে নাই?’

৩০ ডিসেম্বরের মতো একটি নির্বাচন করার কারণে ভোটারা ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। যে দেশের মানুষ ভোটের দিনকে উৎসব হিসেবে নিতেন এবং দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ভোট দিতেন, সেই দেশের ভোটারদের মাইকিং করেও এখন ভোটকেন্দ্রে নেয়া যাচ্ছে না। এর জন্য দায়ী নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের একনায়কতান্ত্রিক মনোভাব। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সিইসি নুরুল হুদা একবার খেদের সাথে বলেছিলেন, ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে না এলে তাদের কিছু করার নেই। শতভাগ সত্য কথা! নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নয় ভোটারদের বাড়ি থেকে খুঁজে খুঁজে ভোটকেন্দ্রে আনা। তবে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে না আসা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন যে প্রায় সব ক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য ভোটের হার দেখিয়েছে, সেটি কি এক ধরনের জালিয়াতি নয়?

৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে শতকরা ৮০ ভাগ ভোট পড়েছে, অনেক সেন্টারের শতভাগের ওপরে ভোট পড়েছে, অনেকে ব্যঙ্গ করে বলেন, মৃত ব্যক্তি ও প্রবাসী ভোটাররাও ভোট দিয়ে গেছেন। এতে কি নির্বাচন কমিশনের লজ্জাবোধ হয় না? তাদের বিবেক কি এ প্রতারণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে না? নাকি তাদের বিবেক বলে কিছু নেই?

যা হোক, বগুড়া-৬ আসনের উপনির্বাচনে কোন দলের প্রার্থী জিতেছেন বা কোন দলের প্রার্থী হেরেছেন, তার চেয়েও বড় কথা হলো নির্বাচনটি পরাজিত হয়নি। আশার দিক হলো, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের যৌথ অত্যাচারে বিরোধীদলীয় কোনো নেতাকর্মী এলাকায় থাকতে পারেনি; বগুড়া-৬ আসনের উপনির্বাচনে কিন্তু এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। এ আসনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ছাড়াও মোট ছয়জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। সব দলের প্রার্থীই বলেছেন, বগুড়ার এ আসনে এবার ভোটের চিত্র ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। স্থানীয় প্রশাসন এবং পুলিশ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেছে। সব প্রার্থীকে প্রচার-প্রচারণায় সমানভাবে সহযোগিতা করেছে। এটি ভালো দিক। এখন নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার এ ক্রেডিট কার সরকারের নাকি নির্বাচন কমিশনের? নাকি সরকার নির্বাচন কমিশনের ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি না করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করে দেখতে চেয়েছে, ৩০ ডিসেম্বরের পরে জনগণের প্রতিক্রিয়া কী? নাকি সরকারকে এই বলে ইসি বুঝিয়েছে যে, এই দেশের মানুষ অতীতের কথা মনে রাখে না। সামনে যা আসে তাই নিয়ে ব্যস্ত থাকে তাই এই সুযোগ হাতছাড়া না করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করে জনগণের সামনে উপমা দাঁড় করানো যায়। এতে সরকারের গ্লানি কমে নির্বাচন কমিশনও হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।

উদ্দেশ্য যাই থাক, বগুড়া-৬ আসনের উপনির্বাচনের পর নির্বাচন কমিশন কি দেশবাসীকে এ নিশ্চয়তা দিতে পারবে, ভবিষ্যতে প্রতিটি নির্বাচন বগুড়ার উপনির্বাচনের মতো সুষ্ঠু হবে। পরাজিত প্রার্থীও সেই নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলতে পারবেন না? এটি করতে পারলে অতীত ভোলা জাতি হয়তো আবারো নির্বাচন নিয়ে উৎসবমুখর হয়ে উঠবে।

লেখক : জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় নেতা


আরো সংবাদ



premium cement