২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি ও গরিবের নাভিশ্বাস

-

এবারের ‘মহা উচ্চাভিলাষী’ বাজেটকে (২০১৯-২০) অনেকেই বলছেন, ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। হুড়মুড় করে আকস্মিকভাবেই বোঝার উপর শাকের আঁটি হয়ে চেপে বসেছে নানামাত্রিক করারোপ ও অনভিপ্রেত মূল্যবৃদ্ধির অভিশাপ। সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির শেল মারাত্মক আঘাত হেনেছে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত মানুষের জীবন-জীবিকায়। বেতন কিংবা আয় বাড়েনি কারোই। কিন্তু ইতোমধ্যেই গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। এই জগদ্দল পাথরের অভিশাপ থেকে মুক্তির পথ কোথায়?

অবসরভোগী, গৃহিণীদের আয়-রোজগার যে অবস্থায় ছিল, তাতে অবাঞ্ছিত অনভিপ্রেত হাত পড়েছে। সঞ্চয়পত্রে উৎসে কর কর্তন দ্বিগুণ করা হয়েছে। সেই চাপ সামলানো সম্ভব হবে না। জনদুর্ভোগ আরো বাড়বে। গ্যাসের বাড়তি যে দাম, তা চুকাতে হবে ভোক্তা ও যাত্রীর পকেট থেকে। সামগ্রিকভাবেই মূল্যবৃদ্ধির কবলে পড়তে হবে। জ্বালানির দাম বাড়লে তার প্রভাব পড়ে সর্বব্যাপী। সব নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যায় এর প্রত্যক্ষ প্রভাবে। এ এক অনিবার্য পরিণতি। কনজুমার অ্যাসোসিয়েশনের (ক্যাব) হিসাব মতে, বিগত ২০১৮ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ছয় শতাংশের মতো। পণ্য ও সেবামূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৫ শতাংশ। ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেছেন, সীমিত ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ এবং বয়স্ক অবসরপ্রাপ্ত এবং গৃহিণীদের জন্য এবারের বাজেট অনুকূল নয়। ভ্যাটের পরিধি যেভাবে বাড়ানো হয়েছে, তাতে বেশ কিছু পণ্যের দাম বাড়তে পারে।

গত ১০ বছরে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলো সপ্তমবারের মতো। বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম যখন শতকরা ৫০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, তখন বাংলাদেশে অবিশ্বাস্য হারে দাম বৃদ্ধি করা হলো। এক অর্থবছরেই প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে গ্যাস ব্যবহার করা বিদ্যুৎ খাতের গ্যাসের দাম বাড়ল ৪১ শতাংশ। ক্যাপটিভ পাওয়ারের গ্যাসের দাম বৃদ্ধি শতকরা ৪৪ ভাগ। বাংলাদেশের হতভাগ্য কৃষকসমাজ যখন উচ্চ উৎপাদন ব্যয়ের বিপরীতে অসহনীয় মূল্য বিপর্যয়ের শিকার, সেখানে সার উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে সর্Ÿোচ্চ ৬৪ শতাংশ। এ কারণেই আমাদের পড়শি দেশ ভারতের কৃষককুল ধান চাষ করে লাভবান হতে পারেন। আর আমাদের দেশের কৃষক হন ক্ষতিগ্রস্ত। ধানের উপযুক্ত দাম না পেয়ে নিকট অতীতে ধান পুড়িয়ে দেয়ার মতো ভয়ানক ঘটনার স্মৃতি এখনো মøান হয়নি। সত্যি সেলুকাস, বড় বিচিত্র এই দেশ!

দেশে এখন ৫৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস ব্যবহার করা হয়। এক লাফে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি পাবে। তার বহুমুখী কুফলে জনগণের ভোগান্তি বৃদ্ধি পাবে বহুলাংশে। গাড়িতে ব্যবহৃত জ্বালানি সিএনজি প্রতি ঘনমিটারে ৪০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৩ টাকা করা হয়েছে। গ্যাসের এই উচ্চ মূল্যবৃদ্ধির ফলে সব শ্রেণীর গ্রাহকের পকেট থেকে বছরে অতিরিক্ত খরচ হবে আট হাজার ৬২০ কোটি টাকা। গৃহস্থালি, শিল্পসহ সব শ্রেণীর গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে সরকার। প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম সাত টাকা ৩৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৯ টাকা ৮০ পয়সা করা হয়েছে। দেশের ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে বড় হারের মূল্যবৃদ্ধি।

আচমকা গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিবাদ নিন্দার ঝড় বিস্তৃত হয়েছে রাজপথেও। বিএনপি বিক্ষোভ মিছিল প্রতিবাদ করেছে। বাম দলগুলো হরতাল পর্যন্ত ডেকেছে। কিন্তু সরকারের কানে তালা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও নিন্দা সমালোচনা হচ্ছে নিত্যদিনই। জাতীয় সংসদেও এই মূল্যবৃদ্ধি কমানোর দাবি উঠেছিল। কিন্তু ফল হয়নি কোনো। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ক্ষীণকণ্ঠে বলেছেন যে, গ্যাসের দাম বৃদ্ধি নিয়ে সরকার কিছুটা অস্বস্তিতে পড়েছে। একই সাথে তিনি গ্যাসের দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা আছে বলেও দাবি করেছেন। গ্যাসের বর্ধিত মূল্য পুনর্বিবেচনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ১৪ দল। গত ২ জুলাই ২০১৯ এক বৈঠক হয়েছিল ১৪ দলের। বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে জোটের মুখপাত্র এবং আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম এ আহ্বান জানান। তিনি বলেন, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির বিষয় বিবেচনা করে যদি সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায়, সেই ব্যবস্থা করুন। জনগণের দুঃখ দুর্দশার যাতে লাঘব হয়।

মহাজোটীয় সরকারের সাবেক মন্ত্রী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি এবারের বাজেটের কঠোর সমালোচনা করেছেন। গত ১৪ জুন নারায়ণগঞ্জে ওয়ার্কার্স পার্টির এক সভায় তিনি বলেছেন, ‘মধ্যবিত্তকে চাপে রেখে বাজেটে ধনীদের প্রতি পক্ষপাত দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির সমৃদ্ধির পেছনে যার মূল শক্তি সেই কৃষক-শ্রমিক-নারী উদ্যোক্তারা বাজেটে অবহেলিতই রয়ে গেছেন। বর্তমানে ব্যাংকগুলো লুটেরা ও খেলাপিদের হাতে বন্দী। গত এক মাসে ঋণখেলাপের পরিমাণ ১৭ হাজার কোটি টাকা বেড়ে এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, যা ঘোষিত বাজেটের এক-পঞ্চমাংশ।’

গ্যাসের দাম গড়ে ৩২ দশমিক আট শতাংশ বাড়ানো হয় গত ৩০ জুন। পরদিনই ১ জুলাই থেকে সেটি কার্যকর করা হয়। এখন এক চুলার জন্য দিতে হবে ৯২৫ টাকা। দুই চুলার জন্য ৯৭৫ টাকা। আগে এক চুলার বিল ছিল ৭৫০ এবং দুই চুলার জন্য ছিল ৮০০ টাকা। গত ২০১৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গ্যাসের দাম ২২ দশমিক ৭০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল। সম্প্রতি এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত বলেছেন, পেট্রোবাংলা ও তিতাসের দুর্নীতি ৫০ শতাংশ কমানো গেলে এনএলজি আমদানির কারণ দেখিয়ে গ্যাসের দাম বাড়াতে হবে না।

আকস্মিক এই মূল্যবৃদ্ধির কুফল আমরা ইতোমধ্যেই টের পাচ্ছি। নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। আরো বাড়বে। এই যে দাম বাড়ানো হলো, এর ফলে ৩৮ লাখ চুলার গ্রাহকের ওপর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের অভিমত- গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানিগুলো লাভে থাকলে বিইআরসি আইন অনুযায়ী গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিতে পারে না। দেশে গ্যাস সঞ্চালন কোম্পানি একটি। বিতরণ কোম্পানি ছয়টি। এর মধ্যে রয়েছে তিতাস, বাখরাবাদ, কর্ণফুলী প্রভৃতি। সুন্দরবন ছাড়া অন্য সব ক’টি কোম্পানিই লাভজনক। একমাত্র সঞ্চালন কোম্পানি জিটিসিএলও লাভে আছে, সুতরাং এখন গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কোনো যৌক্তিকতা নেই। বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক বলেছেন, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে পণ্যের উৎপাদন খরচ কমপক্ষে ১ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়ে যাবে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি আপাতদৃষ্টে বড় মনে না হলেও প্রকৃতপক্ষে শিল্পকারখানায় বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। সংগ্রাম করে টিকে থাকা একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য এটি আরেকটি আঘাত।

বাংলাদেশে যখন এ অবস্থা, তখন প্রতিবেশী দেশ ভারতে কী ঘটছে? ভারতে রান্নার গ্যাসের দাম সিলিন্ডারপ্রতি ১০০ টাকা ৫০ পয়সা কমানো হয়েছে। এটি কার্যকর করা হয়েছে গত ১ জুলাই থেকে।

গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদ নানা স্তরে, নানা উপায়ে হচ্ছে। ফেসবুকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া আমরা লক্ষ করছি। বিড়ম্বিত একজন লিখেছেনÑ ‘৯৭৫ টাকা দিতে পারলে আরো ২৫ টাকাও দিতে পারব। গ্যাসবিল এক হাজার টাকা করেন। বাঁশ দিলে পুরাটা দেন।’ অনেক কমেন্টস হয়েছে তার এই বক্তব্যে। সেসব কমেন্টে আছে হতাশা, দুঃখ-কষ্ট, শ্লেষ-ব্যঙ্গ, প্রতিবাদ ও ক্ষোভ।

এবারে সঞ্চয়পত্রের প্রসঙ্গ। উৎসে কর কর্তন আগে ছিল ৫ শতাংশ। এখন সেটা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১০ শতাংশ। অবসরভোগী, নিঃসহায় মানুষের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়ার জন্য এই পদক্ষেপ কি যথেষ্ট নয়? তাদের যৎসামান্য ক্যাপিটালেই হাত পড়বে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হলো, বাজার থেকে বর্ধিত মূল্যে তাদের নিত্যপণ্য কিনতে হবে। তাদের আয় তো কমলই- বোঝার উপর শাকের আঁটি হয়ে দুর্ভোগ আরো বাড়ল। ক্ষমতাসীন দলের সিনিয়র নেত্রী ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বাজেট পাসের আগে সংসদে এই কর বাড়ানোর কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। এই জুলুম প্রত্যাহারের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন তিনি। কিন্তু হায়! চোর না শোনে ধর্মের কাহিনী। তার কথা অরণ্যে রোদন হলো। বিপরীতে আমরা কী দেখছি? ঋণখেলাপিরা, যারা জাতীয় কুলাঙ্গার, তারা মস্ত ও অন্যায় সুবিধা পেতে যাচ্ছে। কিছু দিন আগে হাইকোর্ট এতে বাধা দিয়েছিল। হাইকোর্টের সেই পদক্ষেপ বহুল প্রশংসিত হয়েছিল। সেই বাধা বোধহয় অদূর ভবিষ্যতে অপসারিত হতে চলেছে। ৩ জুলাই সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর- ঋণখেলাপিদের নিয়মিত হওয়ার সুযোগ আপাতত বহাল রইল। বিশেষ সুবিধাসংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের জারিকৃত প্রজ্ঞাপনের ওপর হাইকোর্টের দেয়া স্থিতাবস্থা গত ২ জুলাই স্থগিত করে দিয়েছেন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত। ৮ জুলাই পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে এই স্থগিত আবেদনের ওপর পরবর্তী শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।

একে যদি আমরা বলি ‘তেলা মাথায় তেল দেয়া’- বেশি বলা হয় না নিশ্চয়ই।


আরো সংবাদ



premium cement
জাতীয় দলে যোগ দিয়েছেন সাকিব, বললেন কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই কারওয়ান বাজার থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে ডিএনসিসির আঞ্চলিক কার্যালয় এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে কার্যকর পদক্ষেপ নিন : প্রধানমন্ত্রী নারায়ণগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ ওসি আহসান উল্লাহ ‘ট্রি অব পিস’ পুরস্কার বিষয়ে ইউনূস সেন্টারের বিবৃতি আনোয়ারায় বর্তমান স্বামীর হাতে সাবেক স্বামী খুন, গ্রেফতার ৩ ফতুল্লা প্রেস ক্লাবের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত বদরের শিক্ষায় ন্যায়-ইনসাফের সমাজ প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে : সেলিম উদ্দিন ইসলামের বিজয়ই বদরের মূল চেতনা : ছাত্রশিবির পরিবেশ দূষণে বাংলাদেশে বছরে ২ লাখ ৭২ হাজার মানুষের মৃত্যু : বিশ্বব্যাংক নোয়াখালীতে ল’ইয়ার্স কাউন্সিলের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত

সকল