২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হিটলার ও হোটেল ড্রেসেন

-

ইউরোপের লৌহমানব স্বৈরশাসক অ্যাডলফ হিটলার সম্বন্ধে বহু কাহিনী রচনা হয়েছে। তাকে নিয়ে রঙিন চলচ্চিত্রও নির্মাণ হয়েছে। আবার অনেক কাহিনী অজানা রয়েছে।

হিটলারের জন্ম কিন্তু জার্মানিতে নয়, তিনি অস্ট্রিয়ার সীমান্তসংলগ্ন ব্রাউনাও আম ইন শহরে ১৮৮৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। হিটলারের বাবা ছিলেন অস্ট্রিয়ার শুল্ক অফিসার। হিটলারের শৈশব খুব একটা সুখকর ছিল না। অল্প বয়সে বাবা-মাকে হারান এবং শিল্পী হওয়ার প্রচেষ্টা তার সফল হয়নি। অস্ট্রিয়া ও জার্মানির ভাষা কিন্তু জার্মান। সুতরাং ভাষাগত দিক থেকে এদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।

বাবা-মা মারা যাওয়ার পর হিটলার অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় চলে যান। হিটলার শৈশবকালে খুব লাজুক এবং অপ্রস্তুত থাকতেন। ভিয়েনায় কয়েক বছর অবস্থানকালে রাষ্ট্রীয় পেনশনে সংসার চালিয়েছেন। ওই সময়কালে ইহুদি, মার্কসবাদ ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে তার তীব্র ঘৃণার সৃষ্টি হয়। প্যান জার্মান ও উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রতি তার দৃঢ়বিশ্বাস ওই সময়কালে জন্মে। অস্ট্রিয়ার সেনাবাহিনীতে যোগদান এড়ানোর জন্য ১৯১৩ সালে হিটলার জার্মানির মিউনিখ শহরে চলে যান। সম্ভবত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে দেশাত্মবোধের অনুপ্রেরণায় জার্মানির বেভারিয়ান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। যুদ্ধ চলাকালীন চার বছর সময়ে মনের শান্তি খুঁজে পান এবং ওই সময়ে তিনি করপোরাল পদে উন্নীত হন। পরবর্তীকালে যুদ্ধে সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য তাকে সম্মান দেয়া হয়। যুদ্ধের সময় গ্যাসে আহত হন এবং পমেরিয়ান হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে বেভারিয়াতে আবার ফিরে আসেন।

ফিরে আসার পর কী করবেন কোনো কিছু স্থির করতে পারেননি। ওই সময় তাকে শিক্ষা অফিসার হিসেবে নিয়োগ করা হয়। সেনাবাহিনী ও কিছু চরমপন্থী সংস্থার সাথে সংযোগকারী হিসেবে কাজ করছিলেন। উল্লেখ্য, মিউনিখ ও তার আশপাশে চরমপন্থী কিছু দলের সৃষ্টি হয়েছিল সে সময়। ঠিক ওই সময় জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি সম্বন্ধে হিটলারকে অনুসন্ধানের কাজ দেয়া হয়। অনুসন্ধানকালীন হিটলারকে ওয়ার্কার্স পার্টি আমন্ত্রণ জানায় দলে যোগ দেয়ার জন্য। হিটলার আমন্ত্রণ গ্রহণ ও কার্যকরী কমিটিতে যোগ দেন। সভা-সমিতিতে তিনি বক্তৃতা দিতে শুরু করেন। বাগ্মিতার দিক থেকে তিনি অত্যন্ত সফল হন। ১৯২১ সালের মধ্যে তিনি জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টির একজন নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯২৩ সালে ব্যর্থ ক্যুর সাথে জড়িত থাকার কারণে এক বছর হিটলার কারাগারে ছিলেন। ওই সময়ে হিটলার তার বিখ্যাত রাজনৈতিক দিকদর্শন সংবলিত ‘মেইন ক্যাম্প’ বই লেখেন।

ওই বই প্রচুর কাটতি হয়, এর জন্য তার বেশ পয়সা হয় এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভবান হন। ১৯২৪ সালে জেল থেকে ফিরে মিউনিখে বসবাস শুরু করেন এবং রাজনৈতিক দলকে আবারো সঙ্ঘবদ্ধ করতে শুরু করেন। ওই সময় জার্মানির নাজি দল অর্থাৎ ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট পার্টি (সংক্ষেপে নাজি) পুনর্গঠন করা হয়। অত্যন্ত ধৈর্য ও দক্ষতার সাথে হিটলার ওই দলকে গড়ে তোলেন। ১৯২৬ সালের মধ্যে উত্তর জার্মানিতে এই পার্টি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। জোসেফ গোয়েবলসের অবদান ছিল এ ব্যাপারে। পরবর্তী সময়ে গোয়েবলসকে প্রচারমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। ১৯২৮ সালে থেকে গোয়েবলস হিটলারের প্রচারকাজে নিযুক্ত ছিলেন। চেহারার দিক থেকে হিটলার মোটেও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। খুব খামখেয়ালি ও গর্বিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। অথচ নিজেকে নিজে অনেক উচ্চমানের মানুষ ভাবতেন। এ ছাড়া তার চিন্তা-চেতনা বা বিচার-বিবেচনা ছিল অগভীর ও অবাস্তব। খিটখিটে মেজাজ ও গলার স্বর কর্কশ ছিল।

হিটলার এক অদ্ভুত ধরনের মানুষ ছিলেন। মনুষ্যত্ববোধের অভাব ছিল। হিটলারের ডিকশনারিতে ‘মানবতা’ বলে কোনো শব্দ ছিল না। অহঙ্কারী, জেদি, একগুঁয়ে ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক ছিলেন অ্যাডলফ হিটলার। তিনি খুব একাকী ছিলেন। কাউকে বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু রাজনীতির ক্ষেত্রে অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন। তখনকার সময়ের মানুষের মনের কথা হিটলারের বক্তৃতায় প্রকাশ পেত। সাধারণ জনগণ হিটলারের বক্তৃতায় সম্মোহিত হতো। সাধারণ মানুষের সমস্যা নিয়ে তিনি রাজনীতি করতেন। সমসাময়িককালে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে হিটলারের সমকক্ষ কেউ ছিল না। হিটলারের বক্তৃতা অনেক সময় এক ঘণ্টার বা অধিক স্থায়ী হতো, কিন্তু বক্তৃতায় একই কথা বারবার প্রতিধ্বনিত হতো। অর্ধসত্য, অর্ধমিথ্যায় ও কথার অলঙ্কারে ভরপুর থাকত হিটলারের বক্তৃতা। জাতীয় সমাজতন্ত্রের আন্দোলন কিন্তু ধীরে ধীরে বেশ জোরালো হতে শুরু করে এবং ১৯৩২ সালের মধ্যে তার রাজনৈতিক দল বেশ শক্তিশালী হয়। ১৯৩৩ সালের ৩০ জানুয়ারি জার্মানির চ্যান্সেলর নিযুক্ত হন অ্যাডলফ হিটলার। শুরু হয় জার্মানির আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা। তখনো কেউ ভাবেনি হিটলার এমন নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক।

রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখলের পর হিটলার অন্যান্য ছোটখাটো রাজনৈতিক দলের মতামত নিয়ে দেশে একনায়কত্ব কায়েম করেন। ন্যাশনাল সোস্যালিস্ট পার্টি ছাড়া অন্য রাজনৈতিক দলগুলো ভেঙে দিলেন। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করলেন। মিল-কারখানার শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন বন্ধ করে দিলেন।

হাজার হাজার নাগরিককে হত্যা করা হলো। গণতন্ত্রমনা কোনো সংগঠন জার্মানিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারল না হিটলারের রাজত্বকালে। সারা ইউরোপ দখল করার বাসনা লালন করতেন হিটলার। ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে একের পর এক দেশ জয় করছিলেন ইউরোপের ওই লৌহমানব। পোল্যান্ড, ডেনমার্ক, নরওয়ে, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, ফ্রান্স, যুগোস্লাভিয়া এবং গ্রিস দখল করা ছাড়াও সোভিয়েট ইউনিয়নের মস্কোর কাছাকাছি হিটলারের সেনাবাহিনী পৌঁছে গিয়েছিল। ওই যুদ্ধজয়ের ফলে ৫৫ মিলিয়ন অর্থাৎ ৫৫০ লাখ লোককে হত্যা করা হয়েছিল। ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম কাজ হিটলার করেছিলেন। সেটা হলো ইহুদি সম্প্রদায়কে ইউরোপ থেকে নিশ্চিহ্ন করা।

ইতঃপূর্বে ইহুদিদের গুলি করে হত্যা করা হতো। এ পদ্ধতি পরবর্তীকালে ‘সংশোধন’ করা হয়। বিশেষ ক্যাম্প তৈরি হলো চেলেমনো, বেলসিক, ছোবিরোর, ত্রেবলিংকা, নাইডানেক ও আউসভিতস শহরে। সেনাবাহিনী প্রধান হিটলারের আদেশে ১৯৪১ সালে গ্যাস চেম্বার তৈরি করা হয়। ওইসব গ্যাস চেম্বারে ঠাণ্ডা মাথায় এক পরিসংখ্যান মতে, প্রায় তিন মিলিয়ন ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছে। পূর্ব ইউরোপে স্লাভিক বংশোদ্ভূতদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ১৯৩৯ সালে হিটলারের বিশেষ নির্দেশে পোল্যান্ডের শাসক শ্রেণীর সব সদস্যদের নিশ্চিহ্ন করা হয় অত্যন্ত নির্দয়ভাবে, আধুনিক ইতিহাসে নজিরবিহীন ওই ঘটনাগুলো।

মজার ব্যাপার হলো, হিটলারের মতেÑ জার্মান জাতি একমাত্র আর্য সমাজের প্রতিভূ এবং জার্মান জাতি সব জাতি থেকে স্বতন্ত্র ও শ্রেষ্ঠ জাতি। হিটলারের রাজত্বকালকে তৃতীয় রাইখ বলা হয়। জার্মান জাতির সংখ্যা বৃদ্ধির এক পরিকল্পনা হিটলার করেছিলেন।

হিটলার সরকারি ও দ্বিপক্ষীয় আলোচনার জন্য অনেক সময় বন সফর করতেন। ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বন জার্মানির অস্থায়ী রাজধানী ছিল। বনের বাডগডেসবার্গের রাইনস্ট্রাসে অবস্থিত রাইন নদীর ধারে রাইন হোটেল ড্রেসেনে অ্যাডলফ হিটলার থাকতেন। কোলন এয়ারপোর্ট থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে ড্রেসেন হোটেল অবস্থিত। হোটেল থেকে ঐতিহাসিক পিটার্সবার্গ ও সাত পাহাড়ের চূড়ার দৃশ্য অবলোকন করা যায়। হোটেলটি ১৭৭০ সালে চালু হয়। ওই হোটেলে বড় মহারথীদের পদধূলি পড়েছে। ইতালির স্বৈরশাসক মুসোলিনি, আমেরিকার জেনারেল আইসেন হাওয়ার, অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন ও অভিনেত্রী গ্রেটা গারবো প্রমুখ হোটেল ড্রেসেনে থেকেছেন।

ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে ওই হোটেলে জার্মানির অ্যাডলফ হিটলার ও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী নেভাইল চেম্বারলেনের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক উল্লেখযোগ্য। জার্মানির সাথে চেকোশ্লোভাকিয়ার স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল। অনেক সময় বাজারে গুজব ছিল, হিটলার চেকেশ্লোভাকিয়া আক্রমণ করবেন। ভিয়েনায় থাকাকালে হিটলারের চেক সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ মনোভাব গড়ে উঠেছিল। চেকদের হিটলার Sub-pepole হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। ১৯৩৮ সালের ১২ মার্চ হিটলার অস্ট্রিয়া দখল করলেন এবং জার্মানির ভূখণ্ডের সাথে একীভূত ঘোষণা করলেন। এর ফলে সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে হিটলার মধ্য-দানুবিয়ান এলাকার শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে জার্মানিকে দাঁড় করিয়েছিলেন।

এর ফলে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো বিশেষ করে চেকোশ্লোভাকিয়া জার্মানির ওপর নির্ভরশীল ছিল। চেকোশ্লোভাকিয়ার অন্তর্গত সুদেনটেনে জার্মান বংশোদ্ভূত নাগরিকেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ এলাকায় চেক সরকারি কর্মচারীদের বৈষম্যমূলক আচরণের কথা নাজি সরকার জোরেশোরে প্রচার করে চেকোশ্লোভাকিয়া আক্রমণের একটা অজুহাত খুঁজছিলেন। এমনিতে চেকরা হিটলারের চক্ষুশূল। তারপর ব্রিটেন ও ফ্রান্সের দোসর চেকোশ্লোভাকিয়া। তবুও হিটলার ধৈর্য রেখেছেন এবং বলেছেন উসকানিমূলক কোনো কিছু না করলে এবং চেকোশ্লোভাকিয়ার অভ্যন্তরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেসামাল না হলে তিনি চেকোশ্লোভাকিয়া আক্রমণ থেকে বিরত থাকবেন।

১৯৩৮ সালের মে মাসে চেকোশ্লোভাকিয়ার প্রেসিডেন্ট গুজব শুনে চেক সেনাবাহিনীকে সীমান্তে মোতায়েনের আদেশ দিলেন। এই খবর শুনে হিটলার ভীষণ রেগে গেলেন। তার মতামত বদলে ফেললেন এবং বললেন, ‘সামরিক বাহিনী আক্রমণ করে চেকোশ্লোভাকিয়াকে ভেঙে গুঁড়ো করবে। এই ভাষণের অব্যবহতি পরে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী নেভাইল চেম্বারলেন বনে এসেছিলেন হিটলারের সাথে আলাপ করতে। এই বৈঠক হোটেল ড্রেসেনে ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৩৮ সালে অনুষ্ঠিত হয়। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ফ্রান্স ও ব্রিটিশ মন্ত্রিসভায় অনুমোদন নিয়েছিলেন যে, সুদেনটেন এলাকা এবং যেসব এলাকায় ৫০ শতাংশের অধিক জার্মান অধিবাসী বসবাস করছে, সমস্ত ভূখণ্ড চেকোশ্লোভাকিয়া জার্মানিকে প্রত্যর্পণ করবে এবং এ ব্যাপারে গণভোটের প্রয়োজন নেই। চেম্বারলেন ভেবেছিলেন, এই প্রস্তাবে হিটলার রাজি হবেন এবং যুদ্ধ এড়ানো যাবে। কিন্তু হিটলার এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন এবং দুই দিনের মধ্যে সুদেনটেন এলাকা দখল করবেন বলে হুমকি দিলেন।

১৮৯৩ সালের দিকে হোটেলটি জার্মান অভিজাত শ্রেণীর লোকদের গ্রীষ্মকালীন আবাস ছিল। মৃদু আবহাওয়া, মনোরম দৃশ্য এবং সুন্দর অপেক্ষাকৃত ভালো স্থানে অবস্থানের ফলে হোটেলটি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণে সম্ভব হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান জেনারেল স্টাফের বাসস্থান ছিল এই হোটেলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রারম্ভে সেনাবাহিনীর জেনারেল স্টাফের আরামস্থল ছিল। যুদ্ধের সময় বিভিন্ন কূটনীতিবিদ এখানে থাকতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষভাগে জেনারেল আইসেন হাওয়ার এ হোটেলটি ব্যবহার করেছেন। জেনারেল আইসেন হাওয়ার প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের পর ১৯৫৩ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হন।

হিটলারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ অনুচর প্রচারমন্ত্রী গোয়েবলস (মিথ্যা প্রচারে যার কোনো তুলনা হয় না) বেশ কয়েকবার এ হোটেলে অবস্থান করেছিলেন। কূটনীতির কাজে বনে অবস্থানকালে এই প্রবন্ধের লেখক নিজেও একাধিকবার হোটেল ড্রেসেনে গেছেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, হোটেল কর্তৃপক্ষ অতীতের ইতিহাস দেখাতেও কার্পণ্য করেন। বহু কষ্টে ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত (জার্মান ভাষায়) হোটেলের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বইটি কিনতে পেরেছি। হোটেলের কোন রুমে কে বসবাস করতেন, তার একটা ফিরিস্তি দেয়া আছে। এ ছাড়া ১৯৯৯ সালের আগস্ট মাসে বনে বাংলাদেশ ও জার্মানির মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আমার অনুরোধে জার্মানির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হোটেল ড্রেসেনে বাংলাদেশ ও জার্মানদলের প্রতিনিধিদের সম্মানার্থে মধ্যাহ্নভোজনের আয়োজন করেছিল। ইতিহাসের আমোঘ বিধান। ১৯৪৫ সালের ৭ মে পরাক্রমশালী হিটলারের সেনাবাহিনী মিত্রশক্তির কাছে শর্তহীনভাবে আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু যুদ্ধে পরাজয়ের আশু সম্ভাবনার মুখে হিটলার অ্যাডমিরাল দোয়েনিটসের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।

মজার ব্যাপার হলো, মিত্রশক্তি চার দিক থেকে যখন জার্মানিকে ঘিরে রয়েছে ঠিক তখনই অ্যাডলফ হিটলার তার বান্ধবী ইভা ব্রাউনকে আইনগতভাবে বিয়ে করেন এবং উইল করলেন। একটি রাজনৈতিক বক্তব্যও রেখেছিলেন। এতে তিনি যুদ্ধের জন্য ইহুদিদের দোষারোপ এবং জার্মানির যুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানি বহন করার জন্য জার্মানির সেনাধ্যক্ষদের দায়ী করলেন। জার্মানির যুদ্ধে পরাজয়ের ব্যাপারে হিটলার কিন্তু নিজেই দায়ী।

৩০ এপ্রিল হিটলার নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন। ইভা ব্রাউন সম্ভবত বিষপানে আত্মহত্যা করেন। অ্যাডলফ হিটলার চ্যান্সারির সামনে একটা পরিখা খুঁড়ে রেখেছিলেন। এ পরিখা থেকে উভয়ের মৃতদেহ রাশিয়ার সেনারা উদ্ধার করেন। হিটলারের প্রচারমন্ত্রী গোয়েবলস ইতোমধ্যে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সাথে সমঝোতায় আসার চেষ্টা করেন, কিন্তু এতে তিনি বিফল হন। আর কোনো উপায় না দেখে গোয়েবলস নিজ হাতে ছেলেদের বিষ খাইয়ে মারেন এবং নিজে ও তার স্ত্রী উভয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এ ধরনের কার্যকলাপে হিটলার ও গোয়েবলসের নিষ্ঠুর প্রকৃতির ছবি ফুটে ওঠে। অবশ্য এটাও সত্য, হিটলার কিংবা গোয়েবলস শত্রুর হাতে বন্দী হতে নারাজ ছিলেন।
লেখক : সাবেক কূটনীতিক


আরো সংবাদ



premium cement