১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কর্ণফুলীর দক্ষিণে নগরায়ন

-

পৃথিবীর যেকোনো বড় শহরের ভেতর নদী বা নদীর দু’পারে শহর থাকলে তার সেতু পারাপারে টোল প্রথা নেই। নগরায়নের স্বার্থেই তা রহিত করা হয়ে থাকে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সিটির বাকলিয়া ও কর্ণফুলী থানার মাঝখানে বহমান পাহাড়ি কন্যা কর্ণফুলী নদীর ওপর নির্মিত শাহ আমানত সেতু পারাপারে প্রতিবারই দিতে হয় উচ্চ হারে টোল নামের বেআইনি ও অযৌক্তিক অর্থ। ফলে নদীর দক্ষিণ পারে নগরায়ন স্থবির হয়ে পড়েছে।

অথচ মহানগরীর তীব্র আবাসনসঙ্কট নিরসনে কর্ণফুলীর দক্ষিণ পারই এখন একমাত্র ভরসা। কেননা পরিকল্পিতভাবে শহর বাড়ানোর জন্য অন্য দিকে তেমন জায়গা আর নেই। চট্টগ্রাম শহরের তীব্র আবাসনসঙ্কট নিরসনে কর্ণফুলীর দক্ষিণ তীরে দুই যুগেরও বহু আগে গড়ে তোলা হয় ৫১৯টি প্লট-সংবলিত সিডিএ কর্ণফুলী আবাসন প্রকল্প। কিন্তু ওয়াসার পানি সরবরাহ না থাকা ও কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতু পারাপারে উচ্চ হারে টোলের কারণে দক্ষিণ তীরে নগরায়ন মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নগরায়ন ও আবাসনসঙ্কট নিরসনে দক্ষিণ পারের বাসিন্দাদের জন্য টোল তুলে দিতে হবে।

পৃথিবীর অনেক বড় শহরের মাঝখানে নদী বা নদীর উভয় পারে শহর থাকলে ওই নদীর সেতুর ওপর টোল থাকে না। যেমন- কলকাতার হুগলি নদীর ওপর ঐতিহ্যবাহী হাওড়া ব্রিজের উভয় দিক থেকে পারাপার টোল ফ্রি। তেমনি বিলেতে টেমস নদীর ওপর লন্ডন ব্রিজও যান চলাচলে টোল ফ্রি। জ্বালানি ক্রয়ের সময় এবং গাড়ি রেজিস্ট্রেশনের সময় ট্যাক্স নেয়ার পরও আবার সেতু পারাপারে টোল আদায় এমনিতেই অনৈতিক। কর্ণফুলীর উভয় পারে নগরায়নের সুবিধার্থে টোল তুলে দেয়া অত্যন্ত জরুরি। সাধারণত ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকা যেখানে গাড়ি বা যানবাহন বেশি চলাচল করে সেখানে সেতু পারাপারে টোল নেয়া হয় না। টোল নেয়া হয় দূর-দূরান্তে যেখানে যানচলাচল তুলনামূলকভাবে কম। কর্ণফুলীর এপার-ওপারের বাসিন্দাদের দিনে রাতে অসংখ্যবার সেতু পারাপার করতে হয়। তারা উচ্চহারে টোল দিতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন। এটা একধরনের জুলুম।

এ ব্যাপারে দক্ষিণ পারের বাসিন্দা অ্যাডভোকেট এস এম ফোরকান জানান, ‘আমি শিকলবাহার বাসিন্দা হয়েও কর্ণফুলী সেতুর অযৌক্তিক টোলের জন্য নিজ বাড়িতে বসবাস করার সাহস পাচ্ছি না। কারণ পরিবার নিয়ে শিকলবাহায় বসবাস করলে চট্টগ্রাম সিটিতে আমার নিজ প্রয়োজনে চারবার যাতায়াত করতে হবে, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য মূল সিটিতে দৈনিক একাধিকবার যাতায়াত করতে হবে, বিভিন্ন পারিবারিক কাজে বা কেনাকাটার জন্য মিসেসকে দিনে একবার হলেও যেতে হবে, প্রাইভেট গাড়ি ব্যবহার করলে দৈনিক অনেক টাকা টোল দিতে হবে, এসব চিন্তা করে নিজ এলাকায় বসবাস করা সম্ভব হচ্ছে না। তা ছাড়া গাড়ি ছাড়া ওপারে বসবাস করাও সম্ভব নয়, টোলের কারণে সমগ্র দক্ষিণ চট্টগ্রামের উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে টোলের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে বা হাইকোর্টে রিট করে এর সমাধান করা উচিত। তা না হলে পরবর্তী প্রজন্মসহ আমাদের যুগ যুগ ধরে ভোগান্তি পোহাতে হবে।’

মেট্রোপলিটন সিটি চট্টগ্রামের মধ্য দিয়ে বহমান খরস্রোতা নদী পাহাড়ি কন্যা কর্ণফুলী। নদীর ওপর নির্মিত শাহ আমানত সেতুর টোলের কারণে ওপারে গড়ে উঠছে না আধুনিক উপশহর। একটি প্রাইভেট কারে ব্রিজ পার হতে আসা-যাওয়া বাবদ আগে লাগত ৪০ টাকা এখন লাগে ৭৫ টাকা। প্রাইভেট গাড়িতে দিনে তিন-চার বার যাওয়া-আসায় মোটা অঙ্কের টোল দিতে হলে কর্ণফুলীর বাম তীরে নগরীর ক্রমবর্ধমান আবাসন সমস্যা দূরীকরণের মাধ্যমে নতুন আবাসিক প্রকল্প গড়ে তোলা সম্ভব নয়। নগরায়নের স্বার্থে কর্ণফুলী শাহ আমানত রহ: সেতুর টোল তুলে দিতে হবে। নতুন সেতু নির্মাণে পদ্মা বা যমুনা সেতুর মতো সারা দেশ থেকে সারচার্জ আদায় করা যেতে পারে।

অথবা বিল্ড অ্যান্ড অপারেট ভিত্তিতে দেশী-বিদেশী কোম্পানির অর্থায়নে তা নির্মাণ করা যেতে পারে। কিন্তু কর্ণফুলীর ওপারে নগরায়নের স্বার্থে শাহ আমানত সেতুর টোল অপ্রযোজ্য। চউক বাম তীর প্রকল্প বাস্তবায়নসহ কর্ণফুলীর বাম তীরে নগর সম্প্রসারণের জন্য ওই টোল প্রথা বন্ধে সরকারি পর্যায়ে অদ্যাবধি কোনো উদ্যোগ নেয় হয়নি। মহানগরীর আবাসিক সঙ্কট নিরসনে বাম তীর প্রকল্প সিডিএ আড়াই যুগ আগে গ্রহণ করলেও অদ্যাবধি তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এ ছাড়াও ওই প্রকল্পে এখনো পর্যন্ত পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধা সরবরাহের অবকাঠামো নির্মাণ না হওয়ায় প্লট মালিকেরা সেখানে বাড়ি নির্মাণে আগ্রহী হচ্ছেন না। এটা সিডিএ ও ওয়াসা এবং কর্তৃপক্ষের চরম ব্যর্থতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পিপি বা প্রজেক্ট প্রোফাইলে সব ইউটিলিটি দেয়ার অঙ্গীকার থাকলেও সিডিএ তাতে ব্যর্থ হয়। চট্টগ্রামের ৯০ লাখ নগরবাসীর জন্য একটা সুখকর ব্যাপার ছিল কর্ণফুলীর ওপর নির্মিত শাহ আমানত সেতুর প্রতিষ্ঠা।

চট্টগ্রামের অবহেলিত জনতার হাজারো আকুতির ফলে অন্তত একটি দুর্বল-ভঙ্গুর প্রকৃতির ব্রিজ পরিবর্তন করে নির্মিত হয়েছিল বর্তমান আধুনিক সেতুটি। উল্লেখ্য, নেদারল্যান্ডস সরকারের দান করা সেকেন্ড হ্যান্ড পুরনো ব্রিজটি বাংলাদেশের খরচে আনা হয় ও সংযোজিত হয়। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ঙ্করি ঘূর্ণিঝড়ে বন্দর থেকে ছুটে যাওয়া জাহাজের ধাক্কায় এই দুর্বল ব্রিজটি খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যায়, যা দীর্ঘ দিন পর মেরামত করা হয়। পরে বুড়িগঙ্গা, দাউদকান্দি, প্রভৃতির মতো আধুনিক নতুন সেতু নির্মিত হলে এ দুরবস্থা দূর হয়। সেতুটি নির্মিত হওয়ার পর কর্ণফুলীর বাম তীরে নগর সম্প্রসারণের এক ব্যাপক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়। মহানগরীর তীব্র আবাসন সঙ্কট থেকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে, একটু দূরে নিরিবিলিতে ও নৈসর্গিক শোভামণ্ডিত এলাকায় একটি সুখের নীড় গড়তে মধ্যবিত্তরা ছুটতে থাকে নদীর ওপারের বিস্তীর্ণ এলাকায়।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আবাসিক সঙ্কট ও নগর সম্প্রসারণের কথা বিবেচনা করে কর্ণফুলীর নদীর বাম তীরে ওই আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার কাজ শুরু করে দেয়। সিডিএ দুই যুগ আগে সেখানে ৫১৯টির মতো প্লট বরাদ্দ দিয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু করেছিল। ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত উদ্যোগেও কর্ণফুলীর দক্ষিণ পারে বহু হাউজিং, ক্ষুদ্র শিল্প ও ভারী শিল্প গড়ে তোলার পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হতে থাকে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এখন সবচেয়ে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে শাহ আমানত সেতুর টোল।

উল্লেখ্য, এ সেতু যখন চালু হয় তখন সেতু পারাপারে কোনো ট্যাক্স দিতে হতো না। এ ছাড়া সড়ক ও জনপথ বিভাগের কোনো সেতুতেই ট্যাক্স প্রথা নেই। কিন্তু তদানীন্তন সরকার যমুনা সেতু ও কর্ণফুলী সেতুতে ট্যাক্স বসিয়ে কালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

চট্টগ্রাম জেলা জজ আদালতের জেলা পিপি এ কে এম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘দীর্ঘ ২৬ বছর আগে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে সিডিএ থেকে প্লট কিনেছি। ওয়াসা পানি সরবরাহ না করায় আর শাহ্ আমানত সেতুর টোলের কারণে স্বপ্নের ঠিকানা রচনা করতে পারলাম না।’ পৃথিবীর প্রায় সব কসমোপলিটন সিটি কোনো-না-কোনো নদীর তীরে গড়ে উঠেছে। নগর উন্নয়নের স্বার্থে ওই সব শহরে নদী পারাপারে কোনো টোল আদায় করা হয় না। নগর সম্প্রসারণের কথা না হয় বাদই দিলাম, আইনের দৃষ্টিকোণ থেকেও এটা কতটুকু বিধিসম্মত? কেননা প্রতিটি মোটরগাড়ি আমদানি, রেজিস্ট্রেশন, রোড টেস্টিং থেকে শুরু করে প্রতি বছর বিপুল অঙ্কের মোটরযান কর সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগে (বিআরটিএ) দিতে হয়। জ্বালানির সাথেও ট্যাক্স আদায় করা হয়।

এর পরও আবার ব্রিজ পারাপারে টোল আদায়টা একই বিষয়ে একাধিকবার টোল আদায়ের সমতুল্য বিধায় এটা বেআইনি, বাতিলযোগ্য, অমানবিক ও বৈসাদৃশ্যপূর্ণ। চট্টগ্রাম বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট কফিল উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘নগর সম্প্রসারণের স্বার্থেই অন্তত শাহ আমানত সেতুর ক্ষেত্রে টোল আদায় বাদ দিতে হবে। বর্তমান সরকার দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিদিন কোনো-না- কোনো সেতু উদ্বোধন করছেন। কিন্তু মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ব্যাংকক-এর সাথে বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়ে নির্মাণের মাধ্যমে দক্ষিণের দরজা খুলে দেয়ার স্লোগান তুললেও তা কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতুর টোলের কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
আশা রাখি, সরকার জাতীয় স্বার্থে, নগরায়নের স্বার্থে কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতুর টোল তুলে দেবে।

লেখক : আইনজীবী, মানবাধিকার ও সুশাসন কর্মী


আরো সংবাদ



premium cement