১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দখল-দূষণে রাজধানীর খালগুলো

-

‘খালের উপর ছোট্ট নাও, ছোট্ট নাওয়ে পাড়ি দাও।’ খালের ওপর এখন আর নাও বা নৌকা চলে না। চলবে কেমন করে? খালই তো নাই। ভরাট, দখল আর দূষণে নিঃস্ব হয়ে গেছে রাজধানীর খালগুলো।

রাজধানীজুড়ে প্রবহমান খালগুলোর করুণ মৃত্যুর গল্প এখন পুরনো মানুষের মুখে মুখে। যেখানে এখন আর খালের কোনো অস্তিত্ব নেই, কিন্তু মন থেকে সরে যায়নি সেই স্মৃতিচিহ্ন। যদিও বারবার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে সিটি করপোরেশন ও ঢাকা জেলা প্রশাসনসহ ওয়াসা কর্তৃপক্ষ এসব খাল উদ্ধারের আশ^াস দিয়েছে। গত ১০ বছরে খাল উদ্ধারে ইতিবাচক কোনো পদক্ষেপ নজরে আসেনি।

রাজধানীতে খালের সংখ্যা কত এ নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। ওয়াসা, সিটি করপোরেশন, ঢাকা জেলা প্রশাসন ও মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান একেক রকম। রাজধানীর খাল সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা ঢাকা ওয়াসা বলছে, নগরীতে খালের সংখ্যা ২৬। অন্য দিকে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খালের সংখ্যা ৫০। ঢাকা ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ) ঢাকায় খালের সংখ্যা ৪৩ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ওয়াসার হিসাবে ১২টি এবং জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের প্রতিবেদনে ২৪টি খাল আংশিক প্রবহমান বলা হয়েছে। বাকিগুলোর বেশির ভাগ অবৈধ দখলে বিলুপ্ত, কয়েকটি ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। সিটি করপোরেশনের ভাষ্যমতে, ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সম্প্রতি তৈরি করা ম্যাপটি অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য। ওয়াসা সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর ২৬ খাল ঢাকা ওয়াসাকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১২টির সংস্কারকাজ চলছে।

রাজধানীর মুগদা থানার একটু সামনে মান্ডা ব্রিজ। রাস্তার দুই পাশে সরু ড্রেন। আছে কালো বিবর্ণ পানির কম-বেশি প্রবাহ। দুর্গন্ধে নাকে রুমাল চেপে চলেন পথচারীরা। এটি মাণ্ডা খাল। একসময় এর পরিধি ছিল অনেক বড়। দখল, ময়লা-আবর্জনায় খালটি এখন ড্রেনে পরিণত হয়েছে। একসময় এ খাল দিয়ে চলত ছোট-বড় নৌযান। পণ্য পরিবহনেও এ খালের গুরুত্ব ছিল বেশ। এখন খালের জমিতে গড়ে উঠেছে অসংখ্য স্থাপনা। রাজধানীর ড্রেনগুলোও এর চেয়ে বড়। এ তো গেল একটি খালের করুণ গল্প। রাজধানীর খিলগাঁও রেলগেট ফ্লাইওভারসংলগ্ন ফার্নিচার দোকানগুলোর সামনে ‘খিলগাঁও-বাসাবো’ খালের নাম সংবলিত ঢাকা ওয়াসার একটি ফলক রয়েছে। এতে খাল দখলমুক্ত রাখতে সচেতনতামূলক বিভিন্ন কথা লেখা রয়েছে। তবে ফলকটির আশপাশের কোথাও খালের কোনো অস্তিত্ব নেই।

রাজধানীর সন্নিকটে বালু নদীর কোল ঘেঁষে ত্রিমোহিনী খাল। খালপাড় ঘেঁষে সারি সারি স্থাপনা। কাঁচা-পাকা দোকানঘর নির্মাণ করা হয়েছে খালের ওপর। রয়েছে আবাসিক ভবনও। রাজধানীর খিলগাঁওয়ের ত্রিমোহনীর গুদারাঘাটের এ চিত্রই বলে দেয় কতটা লাগামহীনভাবে চলছে খাল দখলের মহোৎসব। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ প্রক্রিয়া চলেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিদায় নেয়ার পর থেকে ঢের দখল কার্যক্রম শুরু হয়। সরকার আসে, সরকার যায়। কিন্তু খাল দখল বন্ধ হয় না। ভূমি দখলকারীরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। গত তিন দশকে খালগুলোর দু’পার ভূমি দখলকারীদের আগ্রাসনে গড়ে উঠেছে একের পর এক অবৈধ স্থাপনা। রাজধানীতে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ৫০ খালের অস্তিত্ব ছিল। এর আগে ছিল ৬৫। ২৯ বছরে ৩৬টির বেশি বিলীন হয়ে গেছে। বাদ বাকি ২৬টির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেলেও দখল ও দূষণের হুমকিতে রয়েছে এসব জলাশয়।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিবের প্রদত্ত তথ্য মতে, ওয়াসার পক্ষ থেকে ১২ খাল প্রবহমান বলা হলেও বর্তমানে ২১ খাল বর্ষা মওসুমে প্রবহমান থাকে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নিলে এ খালগুলো সারা বছর প্রবহমান রাখা সম্ভব। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে বক্স-কালভার্টগুলো ভেঙে হলেও খাল উদ্ধার করতে হবে। ওয়াসার গাফিলতির কারণে খালগুলো নালায় পরিণত হয়ে অস্তিত্ব হারাচ্ছে। ঢাকার জলাশয় রক্ষায় কঠিন পদক্ষেপ না নেয়া হলে আগামী ২০ বছরের মধ্যে রাজধানীতে কোনো খালের আর অস্তিত্ব থাকবে না। দখলে যাওয়া ৪৩ খাল উচ্ছেদ অভিযানে নামার কথা ছিল দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের। এখনো তা ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ।

ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বলছে, রাজধানীর ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা একসময় প্রাকৃতিকভাবেই নিয়ন্ত্রিত হতো। তখন নগরীতেই ৬৫ খাল ছিল। বর্তমানে প্রবহমান খালের সংখ্যা ২৬। এর মধ্যে সাতটি খাল পড়েছে ডিএসসিসি এলাকায়। বাকি খালগুলো পড়েছে উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায়। ঢাকার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ধোলাইখাল, নন্দীপাড়া খাল, ত্রিমোহিনী খাল ও ডিএনডি বাঁধ বন্যা নিয়ন্ত্রণ খালে বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। এসব অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করলে খালগুলো আগের মতো সচল হতে পারে। তাছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন খালের মালিকানা ব্যক্তির নামেও রেকর্ড হয়ে গেছে। এসব জটিলতাও নিরসন জরুরি হয়ে পড়েছে।

রাজধানীর জলাবদ্ধতার মূল কারণ নিয়ে সম্প্রতি ঢাকার খালগুলো নিয়ে একটি সচিত্র প্রতিবেদন তৈরি করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। এতে দেখা গেছে, ঢাকা মহানগরীতে খালের সংখ্যা ৪৩। এর মধ্যে ঢাকা ওয়াসা রক্ষণাবেক্ষণ করে ২৬টি। নয়টি খাল রাস্তা, বক্সকালভার্ট ও ব্রিক স্যুয়ারেজ লাইনে পরিবর্তন করা হয়েছে। বাকি আটটি খাল রয়েছে জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে।

২০১৭ সালের ১৬ জুলাই নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ডিএনসিসির আন্তঃবিভাগীয় সমন্বয় সভায় ‘ঢাকায় জলাবদ্ধতার কারণ এবং রাজধানীর খালগুলোর বর্তমান অবস্থা’ নিয়ে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়। ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিদ্যমান খালগুলোর মধ্যে রামচন্দ্রপুর খাল ১০০ ফুটের জায়গায় ৬০ ফুট, মহাখালী খাল ৬০ ফুটের জায়গায় ৩০ ফুট, প্যারিস খাল ২০ ফুটের স্থলে ১০-১২ ফুট, বাইশটেকি খাল ৩০ ফুটের স্থলে ১৮-২০ ফুট, বাউনিয়া খাল ৬০ ফুটের বদলে ৩৫-৪০ ফুট, দ্বিগুণ খাল ২০০ ফুটের বদলে ১৭০ ফুট, আবদুল্লাহপুর খাল ১০০ ফুটের বদলে ৬৫ ফুট, কল্যাণপুর প্রধান খাল ১২০ ফুটের স্থলে স্থানভেদে ৬০ থেকে ৭০ ফুুট, কল্যাণপুর ‘ক’ খালের বিশাল অংশে এখন সরু ড্রেন, রূপনগর খাল ৬০ ফুটের স্থলে ২৫ থেকে ৩০ ফুট, কাটাসুর খাল ২০ মিটারের বদলে ১৪ মিটার, ইব্রাহিমপুর খালের কচুক্ষেতসংলগ্ন মাঝামাঝি স্থানে ৩০ ফুটের স্থলে ১৮ ফুট রয়েছে। এসব খালের বেশির ভাগ স্থানে প্রভাবশালীরা দখল করে বহুতল ভবন, দোকানপাট ও ময়লা আবর্জনায় ভরাট করে রেখেছে। ফলে খালে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক জায়গায় বিলীন হয়ে গেছে অস্তিত্ব।

সিটি করপোরেশনের প্রতিবেদনে জলাবদ্ধতা দূর করতে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, জলাবদ্ধতা নিরসনে খালের ওপর নির্মিত অবৈধ স্থাপনা অপসারণ, প্রকৃত সীমানা নির্ধারণ, বিলীন হওয়া খাল উদ্ধার, পুনর্খনন ও বর্ষা মওসুমের আগে খাল স্বাভাবিক পর্যায়ে আনতে হবে।

ই-মেইল : likhonalife@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement