১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বাংলাদেশের মানুষ ও শিক্ষার্থী

- ফাইল ছবি

সমাজবিজ্ঞানে ‘সামাজিকীকরণ’ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অর্থাৎ এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সমাজের শিশু, মানুষ, সমাজস্বীকৃত সংস্কৃতি বা মূল্যবোধকে রপ্ত করে আচরণ বা ক্রিয়া করে। সামাজিকীকরণ বিষয়টি ব্যক্তিকে তার পরিবার থেকে শুরু করে বিশ্বব্যাপী পরিবেশের সাথে সংহত রেখে তার ভূমিকাকে উপস্থাপন করতে হয়। সব সমাজের ‘সামাজিকীকরণ’ সদৃশ নয়। বিষয়টি পুরোপুরি সমাজস্বীকৃত সংস্কৃতি বা মূল্যবোধের সাথে সঙ্গতি রেখে আত্মস্থ করতে হয়। সেজন্য সংস্কৃতি ‘সামাজিকীকরণ’ বিষয়টিকে নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাবিত করে। আবার কখনো ব্যক্তির আত্মস্থ ‘সামাজিকীকরণ’ (Charismatic/Rational Leadership/ Authority) কোনো অফিস, সমাজ, সম্প্রদায়, রাষ্ট্রের বিদ্যমান সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করতে পারে।

সে বিষয়টি লক্ষ্য রেখেই বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী আয়ান রবার্টসন তার Sociology (১৯৭৭) গ্রন্থে চার প্রকার সামাজিকীকরণের (Primary socialization, Anticipatory socialization, Developmental socialization and Re-socialization) কথা উল্লেখ করেছেন। মানুষকে সারা জীবনই এ চার প্রকার সামাজিকীকরণের ছায়ায় জীবন পরিচালনা করতে হয়। আবার এগুলো আত্মস্থকরণে সহায়তা করে সমাজের কিছু ইউনিট, যাদের ‘সামাজিকীকরণের’ এজেন্ট বা বাহন বলা হয়। গুরুত্বপূর্ণ সামাজিকীকরণের কিছু মৌলিক বাহন হলো, পরিবার (ঋধসরষু), শিক্ষক বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (ঞবধপযবৎং/ঊফঁপধঃরড়হধষ রহংঃরঃঁঃবং), সমবয়সী (চববৎ মৎড়ঁঢ়), ধর্ম (জবষরমরড়হ), গণমাধ্যম (গধংং-সবফরধ), রাষ্ট্র (ঝঃধঃব) ও আইন (খধ)ি। সমাজের মানুষকে উল্লিখিত বাহনগুলোর দিয়ে চার প্রকারের সামাজিকীকরণের মাধ্যমেই তাদের জীবনকে পরিচালিত করতে হয়। আমার মূল বিষয় ধরন বা বাহন না হলেও সমসাময়িক সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মানুষের, ছাত্র-ছাত্রীদের ‘সামাজিকীকরণ’ আলোচনার বিষয় বলেই সংক্ষিপ্ত করে প্রকরণ বা বাহন আলোচনা করেছি।

কয়েক দিন আগে দৈনিক নয়া দিগন্তে নবম-দশম শ্রেণীর গ্রন্থে ‘সামাজিকীকরণের সংজ্ঞা নিয়ে ভুল ব্যাখ্যার বিষয়ে একটি প্রতিবেদন পাই। যেখানে ‘খাপ খাওয়ানোকে’ সামাজিকীকরণের সংজ্ঞা হিসেবে তুলে ধরা হয়। ‘খাপ খাওয়ানোকে’ সামাজিকীকরণের কোনো সংজ্ঞার মধ্যেই রাখা যাবে না। যদি ‘খাপ খাওয়ানোকে’ ইতিবাচক অর্থে বিবেচনা করা হয় তাহলে ‘সামাজিকীকরণের’ সংজ্ঞার অত্যন্ত ক্ষুদ্র অংশে তা বিবেচ্য হতে পারে।

এবার আসুন বাংলাদেশের সমাজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলগুলোতে মানুষ ও ছাত্র-ছাত্রীদের সমসাময়িক ‘সামাজিকীকরণের’ দৃশ্যপট। ২০ বছর আগের আমাদের সমাজের মানুষের সংস্কৃতি বা মূল্যবোধ (আচরণ, জীবনপদ্ধতি, পারিবারিক/ জ্ঞাতি সম্পর্কের বন্ধন/মূল্যবোধ, পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া, বোঝা-পড়া, যোগাযোগ, সৌজন্য আচরণ, স্বার্থ ত্যাগ/ত্যাগ, পারস্পরিক সম্মান শ্রদ্ধাবোধ, পারস্পরিক শোক-দুঃখে কাতরতা/পরঃকাতরতা) আজ প্রায় হারাতে বসেছে। বড়দের দেখলে এখন আর ছোটরা সটকে পড়ে না বরং ছোটদের ভয়াবহ আস্ফালন ও বেয়াদবির ভয়াবহতা বড়দের মুখ লুকাতে বাধ্য করে। আমাদের সময় বড়দের চোখ রাঙানির ভয়ে বা বাঁকা চোখে তাকানোর ভয়ে আমরা খুব কদাচিৎ রাস্তায় বের হতাম। বিশেষ করে বিকাল ও সন্ধ্যার সময়টুকু কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে যাওয়া পুরোপুরি নিষেধ ছিল। আর এখন ছোটদের ভয়ে বড়রা, সম্মানিতরা সন্ধ্যার পরে ঘর থেকে বের হয় না। রাস্তায় বিশেষ করে চার দোকানগুলোতে, মূল রাস্তার মোড়ে, বাড়ির রাস্তার সামনে, জনাকীর্ণ রাস্তাগুলোতে অবিচ্ছিন্নভাবে চলে জুনিয়র ছেলেদের গলাবাজি ও অশ্লীল বাক্যপ্রয়োগ। কখনো এলাকার প্রভাব বিস্তার নিয়ে চলে এসব জুনিয়র ছেলেদের মধ্যে খুনাখুনির ঘটনাও ঘটে। যাকে একাডেমিক ভাষায় Gang culture feud/conflict, Gang culture বলে অভিহিত করা হয়। এর দৌরাত্ম্য শুধু এখন নগরকেন্দ্রিক নয়, সারা বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে এদের আধিপত্যে মানুষ অতিষ্ঠ। পারিবারিক, সহচর বা সহপাঠী মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে তাদের এ আধিপত্য।

পারিবারিক দায়িত্বহীনতা, শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা, স্নেহের অভাবেই আবহমান বাংলার সংস্কৃতি, মূল্যবোধ আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে। ঘর, স্কুল, মসজিদ, কলেজ থেকে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বা মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে কিশোরদের হাতে জ্বলন্ত সিগারেটের ধোঁয়া বাতাসে ভেসে বেড়াতে দেখি বা দেখছি। ২৫-৩০ বছর আগে এমন দৃশ্য কল্পনা তো দূরের কথা, ভাবাই যেত না। আধুনিকায়ন বা আধুনিকোত্তর সমাজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আকাশচুম্বী প্রভাব ও স্মার্ট ফোনের সহজলভ্যতা কিশোর-কিশোরীদের বেপরোয়া করে দিচ্ছে। এর সাথে স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর সরব উপস্থিতি গৃহাভ্যন্তরে মহিলা ও কিশোরীদের পারিবারিক দায়িত্বহীনতা শুধু বাড়িয়েই দিচ্ছে না পারিবারিক দ্বন্দ্ব, পরকীয়া, বিয়েবিচ্ছেদ, প্রেম-ভালোবাসা ইত্যাদিকে ত্বরান্বিত করছে। যার ফলে পরিবারের মধ্যে আগের মতো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ, সম্মান চলমান নয় বরং হ্রাস পাচ্ছে। বাবা-মা’র পারিবারিক দ্বন্দ্বের প্রভাবে সন্তান বিপথগামী হচ্ছে।

পরিবারের দ্বান্দ্বিক অবস্থা সন্তানটিকে স্কুলেও নিয়মিত হতে দিচ্ছে না। ফলে শ্রেণী কক্ষে ছাত্রটি নিয়মিত হতে না পারায় ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ক্যাম্পাসে বন্ধুদের সাথে, সহপাঠীদের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সিগারেট ফুঁকে চলছে। এ ছেলেটিই বা ছেলেরাই সিগারেট থেকে বড় নেশার দিকে পা বাড়াচ্ছে। আন-অফিসিয়াল জরিপে দেখা যাচ্ছে, সরকারি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বেসরকারি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরাই বেশি বিপথগামী হচ্ছে। কারণ বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রশাসনের কম জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হয়। আর্থিক বাণিজ্য, সরকারের কম নজরদারি, রাজনৈতিক বা দলীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মানসে বেসরকারি এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসন তাদের ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যাপারে বরাবরই উদাসীন থাকে। ফলে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী হওয়া সত্ত্বেও তারা বিপথগামী হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণভাবে।

এসব ছাত্রছাত্রী যেমন পরিবার থেকে ‘সামাজিকীকরণে’ ভালোভাবে প্রশিক্ষিত হচ্ছে না, তেমনি বেসরকারি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তারা ‘সামাজিকীকরণে’ চরমভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে। অথচ সামাজিকীকরণে প্রধান ও মৌলিক বাহন হচ্ছে পরিবার এবং এর সাথে শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দ্বিতীয় মৌলিক বাহন বললে অত্যুক্তি হবে না। ফলে সমসাময়িককালে সামাজিকীকরণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বাহন সমবয়সী পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চরম অসহযোগিতার দরুন এটিও অসফল হচ্ছে বা কিশোর-কিশোরীদের, ছাত্রছাত্রীদের সামাজিকীকরণে অভ্যস্ত করতে চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। যার ফলে একজন সন্তান, ছাত্রছাত্রী তাদের পিতা বা শিক্ষকদের সাথে কিভাবে আচরণ করবে তা আত্মস্থ করতে অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে ব্যর্থ হচ্ছে।

বাবা-মাকে আদেশ দেয়া, শিক্ষককে নেন/দেন, ফেসবুকে শিক্ষককে ‘বুড়ো অঙ্গুলি’ দিয়ে থাম্ব ইত্যাদি আদেশ দেয়ার মতো নেতিবাচক সামাজিকীকরণে পরিচালিত হচ্ছেন। সুসঙ্গত ‘সামাজিকীকরণে’ আমাদের সন্তানদের শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হলে পরিবার ও শিক্ষক বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আরো সচেতন হতে হবে। সন্তান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কার সাথে সময় অতিবাহিত করে, কাকে বেশি সঙ্গ দেয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে কার সাথে আড্ডা দেয়, কার সাথে তার গতিবিধি, চলাফেরা এগুলো অভিভাবকদের নজরদারি ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত ও বাধ্যতামূলক করে দিতে হবে।

লেখক : শিক্ষক, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ ও পিএইচডি গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement