২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

একতাই বল

-

রমজানুল মুবারকের শেষ দশকে মক্কা মুকাররমায় হজের মতো ভিড় জমে। এ ভিড়ের কারণে মাগরিবের নামাজের পর সাধারণ জিয়ারতকারীদের মসজিদে হারামে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। অবশ্য মহিলারা প্রবেশ করতে পারেন। পুরুষরা ইহরাম ছাড়া থাকলে তাদের মসজিদে হারামের বাইরে নামাজ আদায় করতে হয়। দিনের বেলাতে ওমরাহ আদায় করে ক্লান্তিতে নেতিয়ে পড়েছিলাম। তবে মরহুমা মাতার নামে ওমরাহ আদায় করার ইচ্ছা তখনো বিদ্যমান। মসজিদে হারামে আল্লাহ তায়ালার ঘরের সামনে রোজা রেখে ইফতার করার আকাক্সক্ষাও ছিল। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, বাড়তি ওমরাহর নিয়ত মসজিদে আয়েশা রা. (মিকাত) থেকে করব। ইহরামের কারণে হারাম শরিফে প্রবেশ করতে পারলেও ইফতারের সামগ্রী ক্রয় করতে পারলাম না।

ইফতারের কয়েক মিনিট আগে হারাম শরিফে প্রবেশ করতেই বোরকাবৃতা এক মহিলা কয়েকটি খেজুর আমার হাতে দিলেন, কেউ পানি দিলেন, কেউ ধরিয়ে দিলেন জুসের বোতল। মানুষ আসরের পর মাগরিবের নামাজের জন্য কাতারে গিয়ে বসে পড়েন, যাতে কাবা শরিফের সামনে নামাজ আদায় করার সৌভাগ্য হয়। একটি কাতারে আমারও জায়গা হয়ে গেল।

এ পর্যন্ত যারা পৌঁছেন, তারা নিজেদের আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা:-এর মেহমান মনে করেন। আর ইফতারের সময় নিজের জন্য কম চিন্তা করেন, অন্যের জন্য চিন্তা করেন বেশি। এ বছর রমজানুল মুবারক শুরু হওয়ার আগে ইচ্ছা জাগল যে, ওমরাহ পালন করব। তথ্য
সংগ্রহ করতে গেলে বলা হলো, অনেক দেরি হয়ে গেছে।

রমজানে খুব ভিড় হয়, এ জন্য সার্বিক ব্যবস্থাপনা দু-তিন মাস আগেই করা হয়ে থাকে। ভাবলাম, আগামী বছর রমজানের আগে থেকেই চেষ্টা করব। কিন্তু রমজানের মাঝামাঝি সময়ে একদিন সৌদি তথ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করে জানানো হলো, মে মাসের শেষে সৌদি আরবে ইসলামী দেশগুলোর নেতাদের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। আমাকে ওই বৈঠকে পর্যবেক্ষক হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হলো। বৈঠকের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ইসলামী দেশগুলোর নেতাদের মক্কা মুকাররমায় সমবেত করা হচ্ছে। আমার এমন অনুভূতি হলো যে, এ আমন্ত্রণ অন্য কোথাও থেকে এলো। আর, কয়েক দিন পরে আল্লাহর ঘরের সামনে বসে রোজার ইফতার করছি।

ইফতারের পর নামাজ শুরু হলে ক্লান্তি ও নিদ্রাহীনতা সত্ত্বেও শরীরে প্রশান্তি ও স্থিরতা যথেষ্ট ছিল। আমার আশপাশে বহু মহিলা পুরুষের পাশে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছেন। কেউ হাত সিনার ওপর বেঁধেছেন, কারো হাত খোলা। কেউ সাদা, কেউ কালো। ভাষা, বর্ণ ও বংশের তারতম্য না করে সব মুসলমান আল্লাহর দরবারে অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার একেবারে সামনে এক মহিলা তার দুধের শিশুসহ নামাজ আদায় করছিলেন। শিশুটি কাঁদছিল। এ মহিলা ক্রন্দনরত শিশুটিকে নিয়ে রুকুতে যাচ্ছিলেন। সেজদার সময় শিশুটিকে জায়নামাজে বসিয়ে দিচ্ছিলেন। শিশুটিকে উঠানোর সময় কষ্ট হলে পাশে দাঁড়ানো মুসল্লি শিশুটিকে উঠাতে সাহায্যও করছিলেন। নামাজ শেষ হলে আশপাশের নামাজিরা মুচকি হেসে ওই শিশুটিকে বিস্কুট ও জুস এগিয়ে দিলেন। মসজিদে হারামে আদায়কৃত এ নামাজে না কোনো সুন্নি ছিল, না ছিল শিয়া। না ছিল কোনো সৌদি, না ছিল কোনো ইরানি, না ছিল পাকিস্তানি, না ছিল কোনো আফগান। বরং সবাই ছিলেন শুধুই মুসলমান।

এক আল্লাহ, এক কুরআন, এক রাসূল সা:-এর অনুসারী মসজিদে হারামে ও মসজিদে নববীতে তো একীভূত হয়ে যান, কিন্তু এ দুই মসজিদের বাইরে তাদের এক দেখা যায় না কেন? এটা এমন এক প্রশ্ন, যা সর্বদা মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববীতে চিন্তাভাবনা করার আহ্বান জানায়।

এবার কাবার তাওয়াফ এবং সাফা-মারওয়াতে সাঈ করার সময় আমার নজরে বৃদ্ধের চেয়ে যুবক বেশি পড়েছে। একটা সময় ছিল, যখন বেশির ভাগ বৃদ্ধ হজ এবং ওমরাহ পালন করতেন। আর বলা হতো, মানুষ সওয়াব অর্জনের জন্য এমন সময় বের হয়, যখন তার পাপ করার ক্ষমতা নেই। তবে সময় বদলাচ্ছে। হজ ও ওমরাহতে যুবকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় বৃদ্ধ মানুষের অনেক উপকার হচ্ছে। কেননা তারা পদে পদে স্বেচ্ছাসেবক পাচ্ছেন। ওমরাহ-এর পর রাসূলুল্লাহ সা:-এর রওজায় হাজিরা দেয়ার জন্য মদিনা মুনাওয়ারায় পৌঁছতেই মনে হলো, আমি পাকিস্তানের কোনো মসজিদে এলাম। আসরের কিছুক্ষণ আগে মসজিদে নববীতে যেতেই দেখলাম, সালোয়ার-পাঞ্জাবি পরা পাকিস্তানিদের এক বিরাট অংশ বাইরের কার্পেটে শুয়ে আছেন।

মসজিদের ভেতরে উপস্থিত পাকিস্তানিরা কুরআন তেলাওয়াত অথবা নফল নামাজ আদায় করছেন। আমাকে দেখে অনেকে দৌড়ে এলেন। মুসাফাহা করলেন। জড়িয়ে ধরলেন। এমনও কিছু ব্যক্তি ছিলেন, যারা চুপিচুপি দেশের পরিস্থিতি নিয়ে অস্থিরতা প্রকাশ করলেন। তবে সবারই আশা, দেশের জন্য তাদের দোয়া সুফল বয়ে আনবে।

রিয়াজুল জান্নাতও পাকিস্তানিতে ভরা ছিল। পাকিস্তানিদের পরে এখানে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় বাংলাদেশী ও তুর্কি নজরে পড়ল। বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের বিশাল অংশই সঙ্কটাপন্ন। আর সঙ্কটের বড় কারণ মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য না থাকা। ইসলামী দেশগুলোর সংগঠন ওআইসি ১৯৬৯ সালে মসজিদে আকসায় অগ্নিসংযোগের পর মুসলমানদের এক করার জন্য গঠন করা হয়েছিল; কিন্তু এ সংগঠন মুসলমানদের আক্ষরিক অর্থে এক করতে পারেনি। এমন পরিস্থিতিতে মক্কা মুকাররমায় ওআইসির নেতাদের এ বৈঠকের আয়োজন বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ফলে মুসলমান ঐক্যবদ্ধ হলে এটা হবে ওআইসির অনেক বড় সফলতা। তবে বৈঠকের ফলাফল যদি আরো ভুল বুঝাবুঝি ছড়ানোর কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে ইসলামী দেশগুলোর নেতাদের মনে রাখা উচিত, আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তারা কঠিন শাস্তি পাবেন। এ নেতারা শুধু বিগত দশ-পনেরো বছরের মধ্যে শিক্ষার উদাহরণে পরিণত হওয়া কয়েকজন মুসলমান শাসকের পরিণতির প্রতি লক্ষ করুন।

যে শাসক আজ শক্তিধর ও ক্ষমতাবান, তারা যদি তাদের ক্ষমতা মুসলমানদের পক্ষে ব্যবহার না করেন, তাহলে তাদের পরিণতিও সাদ্দাম হোসেন, মুয়াম্মার গাদ্দাফি, হোসনি মোবারক ও পারভেজ মোশাররফের চেয়ে ভিন্ন হবে না। মক্কায় জড়ো হওয়া মুসলমান শাসকদের মনে রাখা উচিত, এ শহরে জন্মগ্রহণকারী আল্লাহর শেষ নবী সা: দরিদ্র ও মজলুম ব্যক্তিদের মুক্তিদাতা ছিলেন। তাঁর জীবন সাদাসিধা চলার নমুনা ছিল। তিনি বাদশাহদের মতো জীবনযাপন করেননি। তাঁর ঘরে কয়েক দিন ধরে অনাহার চলত। তিনি নিজে খেতেন না, অন্যকে খাওয়াতেন। যে কাপড়ে আমাদের প্রিয়নবী সা: এ জগত থেকে বিদায় নিয়েছেন, তাতেও তালি মারা ছিল। অনেক আমিরই আজ প্রিয়নবী সা:-এর উম্মতের শাসক, অথচ এ উম্মতের ইজ্জত ছিন্নভিন্ন। উম্মতের ‘কাপড়ে তালি লাগানো’ প্রয়োজন।

ওআইসির বৈঠকে অংশগ্রহণকারী শাসকেরা বায়তুল্লাহর মাহাত্ম্যকে ভয় করুন এবং নিজের জন্য কাবার রবের সৌন্দর্য প্রার্থনা করুন। এ সৌন্দর্য তিনিই পাবেন, যিনি প্রটোকল ছাড়া আল্লাহর ঘরের তাওয়াফ করেন। ভিখারির মতো নিজে ধাক্কা খান এবং অন্যকে সামলিয়ে চলেন। এ শাসকেরা নিজেরা নিজেদের শুধু ওই মুসলমান বানিয়ে নিন, যারা বর্ণ, বংশ, ভাষা ও গোত্রের তারতম্য ব্যতিরেকে মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববীতে একসাথে নামাজ আদায় করেন। আর একে অন্যের মাঝে কল্যাণ বিতরণ করেন। যখন শাসক ও জনগণের মাঝে দূরত্ব শেষ হয়ে যাবে, তখন অবশ্যই বদলে যাবে আমাদের ভাগ্য।

হামিদ মীর : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট, পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক

২০১৯ সংখ্যা থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব


আরো সংবাদ



premium cement
গফরগাঁওয়ে পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ দিশেহারা : আমিনুল লিবিয়ায় নিয়ে সালথার যুবককে নির্যাতনের ঘটনায় মামলা, গ্রেফতার ১ মনুষ্য চামড়ায় তৈরি বইয়ের মলাট সরানো হলো হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আওয়ামী লীগকে বর্জন করতে হবে : ডা: ইরান আমরা একটা পরাধীন জাতিতে পরিণত হয়েছি : মেজর হাফিজ তরুণীর লাশ উদ্ধারের পর প্রেমিকসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা ভিয়েনায় মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রদূতদের ইফতারে ইসলামিক রিলিজিয়াস অথোরিটি আমন্ত্রিত এবার বাজারে এলো শাওমির তৈরি বৈদ্যুতিক গাড়ি সকল কাজের জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার অনুভূতি থাকতে হবে : মাওলানা হালিম বিএনপি জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি করে : ড. মঈন খান

সকল