২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মুসলিম লীগ ও লাহোর প্রস্তাব

-

গত ২৪ মার্চ নয়া দিগন্তের তৃতীয় পৃষ্ঠায় ‘ভারত বিভক্তির প্রস্তাবক শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক- মুসলিম লীগ’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ২৩ মার্চ উপলক্ষে আলোচকদের বক্তব্যের এই সংবাদে বলা হয়েছে, “লাহোরে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এতে অখণ্ড বাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ‘শেরেবাংলা’ খ্যাত এ কে ফজলুল হকের উত্থাপিত, ব্রিটিশ ভারতের ভৌগোলিক নৈকট্য সমন্বিত একক অঞ্চলগুলোর প্রয়োজন অনুসারে স্থানিক রদবদলপূর্বক সীমান্ত চিহ্নিত করে অঞ্চল গঠন এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল যেমন ভারত বর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চল সমন্বয়ে অবশ্যই স্বাধীন রাষ্ট্রগুলো গঠন করতে হবে, সেখানে অন্তর্ভুক্ত ইউনিটগুলো থাকবে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম। ঐতিহাসিক এই প্রস্তাবটি কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে সম্মেলনে সর্বসম্মতি ক্রমে সমর্থন করা হয়। ফলে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারত বিভক্ত করে পাকিস্তান এবং ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ঘটনাটি ঐতিহাসিকভাবে লাহোর প্রস্তাবের ফসল।”

সম্প্রতি এই প্রস্তাব ও প্রাসঙ্গিক, অজানা বেশ কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়েছে দেবেশ রায়ের লেখা ২০১০ সালে কলকাতায় প্রকাশিত ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’ নামক বইয়ের ৮৩৯ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘লাহোরে হক সাহেবকে দিয়ে জিন্নাহ পাকিস্তান প্রস্তাব তোলালেন। এই প্রস্তাব যুক্ত প্রদেশের মুসলিম নেতা খালেকুজ্জামান প্রথম খসড়া করেন। সেই খসড়া অংশ সংশোধন ও সম্পাদনা করেন পাঞ্জাবের প্রধানমন্ত্রী সিকেন্দার হায়াৎ খান। সেই খসড়া জিন্নাহ কখন দেখেছেন ও কী সংশোধন করেছেন সেটা বলা যায় না। সম্মেলনের সভাপতি হিসেবে জিন্নাহই একমাত্র পারেন- কাকে দিয়ে প্রস্তাবটি তোলা হবে তা স্থির করতে। তিনি ফজলুল হককে এ দায়িত্ব দেন। হক সাহেব আবার সেই খসড়াতে কিছু কাটেন ও কিছু যোগ করেন ও তারপর হক সাহেব সেটা উত্থাপন করেন।’

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার আবাসিক সম্পাদক রাজমোহন গান্ধীর "UNDERSTANDING THE MUSLIM MIND" নামক বইয়ের ২০২ পৃষ্ঠায় আছে, প্রস্তাবটি উত্থাপনের পূর্বে বক্তৃতার শেষাংশে শেরেবাংলা বলেন, ‘আমি প্রথমে মুসলমান ও পরে বাঙালি। এটা বাংলা, সেখানে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের পতাকা বিস্তৃত হয়েছে এবং বাংলার নেতা হিসেবে সেই একই মুসলিম লীগের মঞ্চ হতে মুসলমানের জন্য আবাস ভূমির দাবি উত্থাপন করা এখন আমার বিশেষ অধিকার।’

আমেরিকার একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর স্টিফেন ফিলিপ কোহেন তার "THE IDEA OF PAKISTAN" নামক বইয়ের ২০৬ পৃষ্ঠায় বলেছেন, “পাকিস্তানের জাতীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘুরা প্রায়ই তাদের সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসন দাবির যৌক্তিকতায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে লাহোর প্রস্তাবের উল্লেখ করেন যদিও ওই প্রস্তাবে ‘যুক্তরাষ্ট্র’ (Federation) শব্দটির অন্তর্ভুক্তি নাই। বরং এটা স্বাধীন বলছে গঠিত রাষ্ট্রের সমবায়কে, যা স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম। একই অবস্থার বিচ্ছিন্নতাবাদ ভারতকেও মোকাবিলা করতে হচ্ছে কাশ্মির ও নাগাল্যান্ডে।” ১৯৬৯ সালে দিল্লিতে প্রথম প্রকাশিত, লতিফ আহমদ শেরওয়ানির "PAKISTAN RESOLUTION TO PAKISTAN" নামক বইয়ের ৭৬ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত হয়েছে জিন্নাহকে ১৫টি প্রশ্ন করে ১৯৪৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর লেখা গান্ধীর চিঠি। এর ৬ নম্বরে লাহোর প্রস্তাবে গঠিতব্য দুটি অঞ্চলের প্রত্যেকটিতে অনিরূপিত স্বাধীন রাষ্ট্রের সংখ্যার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়। বইটির ৭৮ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত, ১৭ সেপ্টেম্বর দেয়া উত্তরে জিন্নাহ জানান- ‘না, তারা পাকিস্তানের অঞ্চল বলে গঠিত হবে।’

১৯৪৬ সালের ৯-১০ এপ্রিল দিল্লি সম্মেলনে জিন্নাহর অনুরোধেই সোহরাওয়ার্দীকে দিয়ে লাহোর প্রস্তাবের STATES-এর S টি বাদ দেয়া হয়। তখন তার ভাষণ প্রসঙ্গে ইতিহাসের প্রফেসর স্ট্যানলি ওলপার্ট Jinnah of Pakistan নামক বইয়ের ২৬১ পৃষ্ঠায় বলেছেন, ‘বাংলার সোহরাওয়ার্দী ওই রাতে প্রতিশ্রুতির সেই প্রস্তাব উত্থাপন করে এর পরে কী, প্রশ্ন করে বলেন, আমরা শান্তিতে বাস করতে চাই। আমরা গৃহযুদ্ধ শুরুর কথা ভাবছি না, কিন্তু আমরা একটা ভূমি চাই, যেখানে আমরা শান্তিতে বাস করতে পারি... মুসলমানরা যুদ্ধ করতে প্রস্তুত কি না তা অনেক ভেবেছি। তাই অকপটে বলতে পারি যে, বাংলার প্রত্যেক মুসলমানই তার জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। জিন্নাহর দিকে ফিরে এ জন্য তার পরীক্ষার দাবি করেন।’

Larry Collins Dominique Labierre-Mountbatten and the partition of India নামক বইয়ের ৯৮ ও ১৪৫ পৃষ্ঠা মতে, বাংলার স্বাধীনতার প্রশ্নে সোহরাওয়ার্দীর প্রতি জিন্নাহর ছিল সমর্থন। কিন্তু প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সভাপতি সুরেন্দ্রমোহন ঘোষের ‘খণ্ডিত ভারতে অখণ্ড বাংলা এক অসাধ্যতা’- এই উক্তিকে সব হিন্দু নেতা ছাড়াও, এমনকি বাংলার কংগ্রেস নেতা কিরণ সরকার রায়ের সমর্থনক্রমে শেষপর্যন্ত নেহরুর সম্মতিতে বাংলা ভাগ করা হয়।

বাংলা ভাগকে কেন্দ্র করে ঢাকায় ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার কারণের ফসল বলে যতটা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে বলা যায়, ততটা লাহোর প্রস্তাবের (অখণ্ড বাংলা) নয়।


আরো সংবাদ



premium cement