২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

উন্নয়ন-ভাবনার স্বরূপ

-

দেশের ব্যাংক খাতে অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন চলছে। ঋণের নামে লুট হচ্ছে অর্থ। বাংলাদেশের ব্যাংক খাত একসময় বিশ্বমানের ছিল। প্রধানত তিনটি কারণে এখন তা পিছিয়ে গেছে। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণহীন এবং ব্যাংক খাত নাজুক। অযাচিত হস্তক্ষেপে ব্যাংক খাত পিছিয়ে গেছে। বড়রাই বেশি ঋণখেলাপি। শেয়ারবাজার পতন থামছে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা নেই। এ খাতে রাজনৈতিক প্রভাবের দীর্ঘ ছায়া (প্রথম আলো, ২৮ এপ্রিল)। শিক্ষার মানে নজর কম, লাভে ঝোঁক বেশি (প্রথম আলো, ৩০ এপ্রিল)। কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। প্রায় সাড়ে ৩৪ লাখ নারী বেকার।

এ উন্নয়ন ঝুঁকি তৈরি করছে (বিআইডিএস সম্মেলন ২৯-৩০ এপ্রিল)। বাংলাদেশে এখন বৈষম্যপূর্ণ দুই অর্থনীতি। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি নিয়ে সম্মেলনে বক্তারা বৈষম্য প্রসঙ্গে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন বলেছেন, দেশে এখন লুটেরাদের রাজত্ব (প্রথম আলো, ২৯ এপ্রিল)। বিশিষ্টজনের মতে, দেশে পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্য চলছে। এসডিজির তিনটি লক্ষ্য বাস্তবায়নে অগ্রগতি অনেক কম। দুর্বলতার জায়গাগুলো হলো : বৈষম্য হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং শান্তি, ন্যায়বিচার ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান- এই তিন লক্ষ্যের দুর্বল অগ্রগতি (প্রথম আলো, ২৮ এপ্রিল)। এসডিজির লক্ষ্য তিনটি হলো : মানসম্পন্ন শিক্ষা; শোভন কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি; টেকসই উন্নয়নে বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব।

এবার রোজা আসার আগেই বাজার টালমাটাল। নতুন করে বেড়েছে চিনি, পেঁয়াজ, রসুন, আদা ও ডালের দাম। সবজি ও মাছের দরও চড়া (প্রথম আলো, ২৭ এপ্রিল)। মুক্তবাজারের নামে চলছে সিন্ডিকেটেড মার্কেট। বাজারে জিনিসপত্রের অভাব না থাকলেও দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। ফলে মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও নিম্ন শ্রেণী ভোগ কমিয়ে দিয়েছে, যা তাদের পুষ্টিহীনতার কারণ হতে পারে। রোজা উপলক্ষে কেউ মজুদদারি করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব সরকারের। এ দিকে, বাংলাদেশের এখনকার উন্নয়নের ধরনটি ভবিষ্যতের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না। বরং একটা শ্রেণী ধনী হচ্ছে। তদুপরি, তারা সম্পদ বিদেশে পাচার করছে। অন্য দিকে, উন্নয়নের নামে পরিবেশ ধ্বংস করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) দুই দিনের সম্মেলনে ক্রিটিক্যাল কনভারসেশনের সমাপনী অধিবেশনে বাংলাদেশের বিষয়ে রাজনৈতিক আলোচনায় বক্তারা উন্নয়নের ধরন পুনর্বিবেচনা করা দরকার বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। আলোচনা অনুষ্ঠানের সমাপনী অধিবেশনের সভাপতির বক্তব্যে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বলেন, ঋণখেলাপি হওয়া এখন ব্যবসায়িক কৌশলের মধ্যে ঢুকে গেছে। আইন যখন সমানভাবে প্রয়োগ করা না হয়, তখন কারো ক্ষেত্রে ন্যায্য প্রয়োগ হলেও প্রশ্ন ওঠে (প্রথম আলো, ৩০ এপ্রিল)।

দেশে ধর্ষণের যেন মহোৎসব চলছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার চরিতার্থতার কারণে অনেকে এর শিকার হচ্ছেন। অনেক ধর্ষণ ঘটনার সাথে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা জড়িত। এসব ক্ষেত্রে আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়ায় দায়মুক্তি তথা বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি চালু হয়েছে। ফলে এ জঘন্য অপরাধের কমতি দেখা যাচ্ছে না। আর সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এত বড় আন্দোলন এর বিরুদ্ধে হলো, নিরাপদ সড়ক আইনও হলো। কিন্তু সরকার আইন কার্যকর করতে টালবাহানা করছে। এর নেপথ্যে বিশেষ রাজনীতি কাজ করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা কমছে না, বরং বাড়ছে, ঘটছে প্রতিদিন। অন্য দিকে মানবাধিকার লঙ্ঘন, বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, কোচিং বাণিজ্য বন্ধ ও শিক্ষার মানোন্নয়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যাপক ব্যর্থতা এসব কি উন্নয়নের ডামাডোলে চাপা পড়ে যাবে? যথাযথ প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত না হওয়ায় অথবা রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে ভোট ডাকাতির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা ও থাকার কারণে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে জবাবদিহির অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর ফলে সর্বত্র ও সবক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে।

এই হলো কথিত উন্নয়নের স্বরূপ। সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এ ধরনের উন্নয়ন-ভাবনা উৎসারিত। এহেন অবস্থা নিছক ইট-বালু-সিমেন্টনির্ভর ‘উন্নয়ন-ভাবনা’কে ব্যাপ্ত পরিসরে তথা সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দেখার আবশ্যকতা ও যৌক্তিকতাকেই তুলে ধরে। আর এ কারণে আইনের শাসনের উন্নয়ন, আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড তথা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অবসান, দলীয়করণমুক্ত প্রশাসনের পুনরুজ্জীবন, রাষ্ট্রীয় বিশেষ করে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করে এগুলোর শক্তিশালীকরণ এবং সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থার চর্চা, প্রতিহিংসার রাজনীতির পরিবর্তে সহিষ্ণুতার চর্চা এবং সর্বোপরি একটি জনমুখী ও মানবিক সরকার টেকসই ও সামগ্রিক জাতীয় উন্নয়নের আবশ্যিক শর্ত বলে বিবেচনা করা ও স্বীকৃতি দেয়াই সময়ের দাবি।

লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার


আরো সংবাদ



premium cement