২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিনিয়োগবান্ধব বাজেট চাই

-

প্রতি বছর বাজেট আসে বাজেট যায়, নানামুখী আর্থিক পরিকল্পনার বিশাল ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়। তুলে ধরা হয় জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের ভবিষ্যৎ চিত্র, বলা হয় দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা হবে, অবকাঠামো উন্নয়ন, দরিদ্রবান্ধব, কৃষি উন্নয়ন, বেকারত্ব কমানো, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বিনিয়োগবান্ধব করা এবং সর্বোপরি প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর কথা।

নতুন অর্থবছরের হিসাব-নিকাশ শুরু হবে ১ জুলাই থেকে। ১৩ জুন জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এটি হবে তার প্রথম বাজেট। আমরা আশা করব, তিনি একটি ব্যতিক্রমী বাজেট দেবেন। তার পূর্বসূরির মতো গতানুগতিক বাজেট নয়। একটি ভারসাম্যপূর্ণ বিনিয়োগবান্ধব কর্মমুখী শিল্পবান্ধব, সংস্কারমুখী কার্যকর কর কাঠামোভিত্তিক বাজেট দেশের অর্থনীতিকে ক্রমান্বয়ে গতিশীল ও টেকসই করতে ভূমিকা রাখে। এবারের বাজেটকেও আমরা কর্মমুখী, বৈষম্যহীন, বিনিয়োগবান্ধব বাজেট হিসেবে দেখতে চাই।

বাজেট আগামী অর্থবছরের সম্ভাব্য ব্যয় ও আয়ের হিসাব-নিকাশের দলিল। সরকার সম্ভাব্য রাজস্ব ও উন্নয়ন ব্যয়ের খাতসমূহ চিহ্নিত করে এবং এই ব্যয়সঙ্কুলানের জন্য সম্ভাব্য আয়ের উৎসসমূহের চিত্র জনগণের কাছে তুলে ধরেন। তাই জনগণের দাবি হলো এ বাজেটের মাধ্যমে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানো, শিক্ষার মান উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ উৎপাদনমুখী খাতসমূহে গতি সঞ্চয় হবে। বাজেট বাস্তবায়ন করতে হলে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। করের হার বাড়ানো ঠিক হবে না বরং করের আওতা বাড়াতে হবে। শিল্পায়নই দেশের ভবিষ্যৎ। কারণ, শিল্পায়নেরই মাধ্যমে দেশে কর্মসংস্থানের বিরাট সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের পাশাপাশি সরকারি খাতকেও এগিয়ে আসতে হবে।

দেশের আয় বৈষম্য বাড়ছে। সামাজিক নিরাপত্তার বিভিন্ন কর্মসূচিতে অনেক দুর্নীতি হচ্ছে। ব্যাংক খাতের কী সমস্যা, কারা সমস্যা সৃষ্টি করছে, তার সমাধান কী তা বের করতে হবে। অর্থনীতির স্বার্থে ব্যাংক ও আর্থিক খাত সংস্কার করতে হবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ঠিক না থাকলে ভবিষ্যৎ অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা আসতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া উচিত। আমদানি-রফতানিতে কতটা ওভার ইনভয়েসিং আর কতটা আন্ডার ইনভয়েসিং হয় তা দেখার ব্যবস্থা করা উচিত। আমাদের সম্ভাবনাময় কাগজ, বস্ত্র, পাটশিল্প ধ্বংস হওয়ার উপক্রম। এসব শিল্পকে বাঁচাতে বাজেটে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে।

সরকারের ব্যয়ের আরেকটি বড় খাত হলো শিক্ষা। শিক্ষা খাতে শুধু বরাদ্দ বাড়ালেই হবে না। কর্মমুখী শিক্ষার প্রতি জোর দিতে হবে। বিশেষ করে আইটি ও কারিগরি শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার চাহিদা ও বরাদ্দের মধ্যে যে বিস্তর ফারাক রয়েছে তা কমিয়ে আনতে হবে। কৃষিক্ষেত্রে মূল সমস্যা হচ্ছে মধ্যস্বত্ব ভোগীদের উপস্থিতি। সরকার কৃষিতে যত ভর্তুকি বা বরাদ্দ দিক না কেন, তার সুফল কৃষক পাচ্ছে না। পাচ্ছে ধনী কৃষক ও মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণী। ধান ও পাটের মওসুমে ধানের ও পাটের ন্যায্য দাম কৃষকেরা পাচ্ছে না। শুনতে হচ্ছে কৃষকের কান্না। এবারের বাজেটকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সেমিনার, গোলটেবিল বৈঠকে যে বিষয়টি বেশি আলোচিত হচ্ছেÑ তা হলো বৈষম্যের বিষয়। সামাজিক খাতে আমরা অনেক দূর এগিয়ে গেলেও বৈষম্য কমেনি। আমাদের আয় বাড়লেও বলা যাচ্ছে না সবার মধ্যে সেই আয় সুবণ্টিত হয়েছে।

আমাদের উন্নয়ন প্রকল্প ও উন্নয়ন বরাদ্দের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে বিশাল বৈষম্য। সরকার কর থেকে সাধারণত বেশির ভাগ রাজস্ব পেয়ে থাকে। করের মধ্যে পরোক্ষ কর থেকে বেশি আয় করে (প্রায় ৭০ শতাংশ)। পরোক্ষ করের বোঝাটা সাধারণ মানুষকে বহন করতে হচ্ছে। যাদের মধ্যে নিম্ন আয়ের লোকসংখ্যা বেশি। অন্য দিকে প্রত্যক্ষ কর থেকে প্রায় ৩০ শতাংশ আয় করে থাকে সরকার। এটি ধনীক শ্রেণীও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো দিয়ে থাকে। ফলে সরকার ধনীও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান থেকে কম আয় করছে এবং সাধারণ জনগণ, দরিদ্র শ্রেণীর কাছ থেকে বেশির ভাগ আয় করছে। এতে দরিদ্র ও বৈষম্য দুটিই বাড়ছে। বৈষম্যহীন বাজেট হতে হলে করকাঠামো ভারসাম্য হতে হবে। বেশির ভাগ রাজস্ব আয় ধনী ও বিত্তবানদের কাছ থেকে পেতে হবে।

দারিদ্র্য নিরসন সমাজের সমতা আনার লক্ষ্যে প্রতি বছরই বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বড় বরাদ্দ থাকে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন তার এক বক্তব্যে বলেছেন, আমাদের বাজেটে প্রতি বছর সামাজিক নিরাপত্তা বরাদ্দ বেড়ে যায়। কিন্তু বরাদ্দ বাড়ানোর আগে অপচয় বন্ধ করতে হবে। অপচয় বন্ধ করলেও সামাজিক নিরাপত্তার আওতা আরো বাড়ানো সম্ভব। পাশাপাশি দ্রুততার সাথে দারিদ্র্য নিরসনও সম্ভব হবে অতিরিক্ত খরচ না করে। অপচয় কমাতে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারেরও প্রয়োজন। তাই আসন্ন বাজেটে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া উচিত বিনিয়োগ বাড়ানোর ওপর। কারণ বিনিয়োগের সাথে কর্মসংস্থানের সম্পর্ক। বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থানও বাড়বে, বেকারত্ব কমবে। বৈষম্যহীন বাজেটের জন্য প্রয়োজন আয় কাঠামোতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।

ই-মেইল : main706@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement