২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শতবর্ষে রাজেন্দ্র কলেজ

-

পয়লা জুন শত বছর পূর্তি করল ফরিদপুরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ। ১৯১৫ সালের ১৫ নভেম্বর কংগ্রেস নেতা অম্বিকাচরণ মজুমদার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে ফরিদপুরে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কমিটি গঠন করেন। ওই কমিটির সভায় কলেজ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার জন্য ৮০ হাজার টাকার তহবিল সংগ্রহের সুপারিশ গৃহীত হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের থেকে ৪০ হাজার টাকা সংগ্রহের পর বাকি টাকার জন্য অম্বিকাচরণ তৎকালীন ভাঙ্গা মহকুমার জমিদার রমেশ নারায়ণ রায় চৌধুরীর দ্বারস্থ হন। জমিদার তার বাবা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায়ের নামে কলেজের নামকরণ করার শর্তে ৫০ হাজার টাকা দেয়ার প্রস্তাব দেন। কলেজ প্রতিষ্ঠা কমিটি সে প্রস্তাব মেনে কলেজের নামকরণ করেছিল ‘রাজেন্দ্র কলেজ’। ১৯১৮ সালে ফরিদপুরের জেলা কালেক্টরের মাধ্যমে ৫ দশমিক ৫০ একর জমি কলেজের নামে বরাদ্দ দেয়া হয়। একই বছরের এপ্রিলে জেলা কালেক্টর ডানলপ কলেজ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

১৯১৮ সালের জুনে এই কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন কামাক্ষ্যা নাথ মিত্র। একই সময়ে দর্শন বিভাগে গিরিষ চন্দ্র সেন, গণিত বিভাগে দেবেন্দ্র নাথ দত্ত, সংস্কৃতি বিভাগে দীনেশ চন্দ্র মজুমদার, ইতিহাস বিভাগে শিশির কুমার আচার্য এবং আরবি ও ফারসি বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে ফজলুল হক যোগদান করেন। ১৯১৮ সালের ১ জুলাই উচ্চ মাধ্যমিক কলা বিভাগের ২৯ জন ছাত্র নিয়ে রাজেন্দ্র কলেজের যাত্রা শুরু হয়। তবে ১ জুন কলেজের ‘প্রতিষ্ঠা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। শুরুতেই এটি দ্বিতীয় শ্রেণীর কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। সে সময়ে ফরিদপুর অঞ্চলে অনেক হাইস্কুল থাকলেও কোনো উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। কলেজটি ১৯২৩ সালে ছয়টি বিষয়ে স্নাতক কোর্স আরম্ভ করে এবং ওই বছর উচ্চ মাধ্যমিক বিজ্ঞান কোর্স চালু হয়।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর নবগঠিত পূর্ববঙ্গ প্রদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মফস্বলে স্নাতক কোর্স বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে ১৯৪৯ সালে বন্ধ হয়ে যায় স্নাতক। তবে ১৯৫৩ সালে আবার স্নাতক বিজ্ঞান এবং ১৯৬২ সালে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক বাণিজ্য কোর্স চালু হয়। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার কলেজটি সরকারীকরণ করে দেশের আরো কয়েকটি বড় কলেজের সাথে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বাংলা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, হিসাববিজ্ঞান, রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞানে সম্মান শিক্ষাক্রম প্রবর্তিত হয় এখানে। পরবর্তী বছরগুলোতে গণিত, সমাজবিজ্ঞান, উদ্ভিদ বিজ্ঞান, ইংরেজি, ব্যবস্থাপনা, সমাজকল্যাণ, ভূগোল ও প্রাণিবিদ্যায় পর্যায়ক্রমে সম্মান শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। ১৯৮৫ সালে অর্থনীতি, ১৯৮৬ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ১৯৮৮ সালে পদার্থবিজ্ঞান, হিসাববিজ্ঞান ও বাংলা এবং ১৯৯০ সালে গণিতে স্নাতকোত্তর শেষ পর্ব শিক্ষাক্রম প্রবর্তিত হয়।

১৯৮৮ সালে অর্থনীতি ও গণিত এবং ১৯৯৩ সালে বাংলা, ইংরেজি, ইসলামের ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, হিসাববিদ্যা, ব্যবস্থাপনা, ভূগোল, রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর (প্রথম পর্ব) কোর্স শুরু হয়েছে। ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গঠিত হলে রাজেন্দ্র কলেজ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়। এখন ২১টি বিষয়ে সম্মান ও স্নাতকোত্তর শিক্ষাক্রম চালু রয়েছে। কলেজে শিক্ষক আছেন ১৭০ জন এবং ছাত্রছাত্রী প্রায় ৩০ হাজার। আবাসিক সুবিধার মধ্যে রয়েছে ছয়টি ছাত্রাবাস, যার দু’টি মেয়েদের এবং চারটি ছেলেদের।

২০ দশমিক ৫ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত কলেজের দু’টি ক্যাম্পাস : শহর ক্যাম্পাস এবং বায়তুল আমান ক্যাম্পাস। ১৯৭২ সালে প্রধান ক্যাম্পাস থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে বায়তুল আমান ক্যাম্পাস স্থাপিত হয়। শহর ক্যাম্পাসে উচ্চ মাধ্যমিক এবং পাস কোর্স (ডিগ্রি) পর্যায়ের ক্লাস হয়ে থাকে। প্রশাসনিক কার্যক্রমও শহর ক্যাম্পাসে পরিচালিত হচ্ছে। স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ক্লাস হয় বায়তুল আমান ক্যাম্পাসে।

ঐতিহ্যবাহী এ শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রছাত্রী সংসদের (রুকসু) প্রতিষ্ঠার পর থেকে যাত্রা শুরু করলেও ২০০২-০৩ শিক্ষাবর্ষের পর নির্বাচনসহ যাবতীয় সামাজিক, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ১৩ বছর পর ২০১৬-১৭ সেশনে নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধিত্ব তৈরি হলেও তা বাস্তবে অনেকটা অকার্যকর। বিগত কমিটির মেয়াদে সৃজনশীলতার বিকাশে বিতর্ক, ম্যাগাজিনের মতো সাধারণ কর্মসূচি চোখে পড়েনি।

এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, সামরিক আইনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬২ সালের পরে শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, সর্বোপরি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। এ প্রতিষ্ঠানের অনেকেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুনাম অর্জন করেছেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন কবি জসীমউদ্দীন, কলকাতার চলচ্চিত্র নির্মাতা মৃণাল সেন, ভারতীয় লেখক নরেন্দ্রনাথ মিত্র, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কে এম ওবায়দুর রহমান, ফরিদপুরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলনকারী বর্তমানে শ্রমিক নেতা শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর প্রমুখ।

রাজেন্দ্র কলেজের বর্তমান ও সাবেক একাধিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী জানান, ফরিদপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা জরুরি। এ ছাড়া, প্রায় সাড়ে ২০ একর জমির ওপর দু’টি ক্যাম্পাস নিয়ে গড়ে ওঠা রাজেন্দ্র কলেজের শিক্ষার মানোন্নয়নে পর্যাপ্ত শিক্ষক, নতুন বিভাগ ও ডাইনিংসহ কলেজের আবাসিক সুবিধা বাড়ানো খুবই জরুরি। অর্থাৎ, ফরিদপুরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার পাশাপাশি রাজেন্দ্র কলেজের সার্বিক উন্নয়ন এ অঞ্চলের মানুষের জনদাবি।

লেখক : শিক্ষার্থী, রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর


আরো সংবাদ



premium cement

সকল