ইরানের সাথে যুদ্ধ কি আসন্ন?
- নিকোলাস ক্রিস্টফ
- ০৯ জুন ২০১৯, ১৯:৪০
আমেরিকা কি ইরানের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে? সত্যিকার অর্থে, আমরা ইতোমধ্যে কালিমালিপ্ত হয়েছি। আমরা ইয়েমেনের অবিবেচনাপ্রসূত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছি- যেখানে আড়াই লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এই দুষ্কর্মের কারণে মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে অনেক নিষ্পাপ শিশু রয়েছে এবং তাদের মধ্যে অনাহারে বহু শিশুর মৃত্যু হয়েছে। মাত্র কয়েক দিন আগে বোমাবর্ষণে ইয়েমেনের চারটি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। সম্ভবত আমেরিকার তৈরি করা বোমার হামলায় এই শিশুরা নিহত হয়েছে। প্রতি মিনিটে ইয়েমেনের একটি করে শিশু মৃত্যুবরণ করছে।
ইয়েমেন হচ্ছে একটি জটিল জায়গা, যেখানে বহু মন্দ ও দুষ্ট কুশীলব ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। ইরানের সাথে আমাদের শত্রুতা ও সৌদি আরবের সাথে বন্ধুত্বের কারণে আমরা ইয়েমেনি শিশুদের অনাহারের মাধ্যমে এবং বোমা হামলা চালিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে সহায়তা করছি। সৌদি আরব ওই অঞ্চলে শত্রুতার বিস্তার ঘটিয়ে ইরানের ওপর সামরিক হামলার নির্দেশ দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে উৎসাহিত করছে।
২০১৫ সালে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ইয়েমেনে হস্তক্ষেপ করেছেন। তিনি তার দৃঢ়তা দেখাতে চান এবং তার সেনাবাহিনী ইরান সমর্থিত হাউছি বিদ্রোহীদের নির্মূল করার দায়িত্ব পালন করবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। কিন্তু সৌদি হস্তক্ষেপের কারণে বরং ইয়েমেনে ইরানের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। অপর দিকে জাতিসঙ্ঘ ইয়েমেনের পরিস্থিতিকে যে ‘মারাত্মক মানবিক বিপর্যয়’ হিসেবে অভিহিত করেছেÑ সৌদি আরব সেই পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটানোর জন্য সহায়তা করছে। আমেরিকা-ইরান যুদ্ধ ও সঙ্ঘাত নিয়ে যখন পুনরায় আলোচনা চলছে তখন ইয়েমেন অবশ্যই স্মরণ করিয়ে দেবে, যুদ্ধে জড়ানো সহজ, কিন্তু এর থেকে বেরিয়ে আসা খুবই কঠিন।
সৌদি আরব ও আরব আমিরাত ইয়েমেনে বোমা বর্ষণ করেছে, আর ওয়াশিংটন বুদ্ধিমত্তা, সংবাদ ও গোয়েন্দা তথ্য এবং অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করে এই যুদ্ধকে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত জিইয়ে রেখেছে। আমেরিকার নীতি হচ্ছে, ইয়েমেনি শিশুদের অনাহারে রেখে মৃত্যুর মুখে ঠেলা দেয়ার প্রতি সমর্থন। কারণ, ইরানের সাথে সম্পর্ক রক্ষাকারী একটি উপদল সে দেশ শাসন করে।
এটা কোনো দল বা গোষ্ঠীর প্রতি অন্ধভাবে সমর্থন দেয়ার ইস্যু হওয়া উচিত নয়। প্রেসিডেন্ট ওবামা ইয়েমেনে সৌদিপন্থীদের প্রতি সমর্থন দিয়েছিলেনÑ আর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ওই সমর্থন দ্বিগুণ করেছেন। আমেরিকার বেশির ভাগ প্রেসিডেন্ট প্রার্থীই ইয়েমেন ইস্যুটি নিয়ে বেশি কথা বলেননি। এটা তখন জনগণের তেমন কোনো মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি। তবে ইয়েমেন ইস্যুতে ব্যতিক্রমী ভূমিকা পালন করেছিলেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স। তিনি ইয়েমেন যুদ্ধের তীব্র বিরোধী ছিলেন। আমি গত বছরের শেষের দিকে সৌদি অবরোধের মধ্যেই ইয়েমেন থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। আমি দেখতে পাই, দেশকে যে কর দিয়েছিÑ সেই করের ডলার ইয়েমেনি শিশুদের অনাহারে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার কাজে সহায়তা করতে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটা আমাকে পীড়া দিচ্ছে। বিষয়টি বারবার আমার স্মৃতিপটে উদিত হচ্ছে। ইয়েমেন যুদ্ধে মার্কিন সম্পৃক্ততার অবসান ঘটানোর জন্য দ্বিপক্ষীয়ভাবে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয় কংগ্রেসে অনুমোদন করা হয়েছে। কিন্তু গত মাসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এর বিরুদ্ধে ভেটো দিয়েছেন।
জাতিসঙ্ঘের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, চলতি বছর যুদ্ধ শেষ হলে দুই লাখ ৩৩ হাজার মানুষ নিহত হবে এবং এই যুদ্ধ ২০২২ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকলে মোট চার লাখ ৮২ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটবে। আর যদি ২০৩০ সাল পর্যন্ত যুদ্ধ অব্যাহত থাকে তাহলে ১৮ লাখ লোক মৃত্যুবরণ করবে বলে জাতিসঙ্ঘ মনে করে।
জাতিসঙ্ঘে মানবিক সমন্বয়কারী লাইজ গ্রান্ডি চলতি মাসে আমাকে বলেছেন, ‘প্রতিদিনই পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে।’ বর্তমানে ইয়েমেনে কর্মরত এমন কেউ নেই যিনি মনে করেন না যে, এই ভয়ঙ্কর ও অর্থহীন সঙ্কটের একমাত্র সমাধান হলো যুদ্ধ বন্ধ করা। এই যুদ্ধ ক্লান্তিকরভাবে চলতে থাকলে ইয়েমেন একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে- যেটা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি অস্থিতিশীল দেশ হয়ে উঠবে। গ্রান্ডি বলেন, ‘প্রায় প্রত্যেক পরিবার কাউকে হারিয়েছে কিংবা অনাহারক্লিষ্ট শিশুরা স্কুল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে অথবা কলেরা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে।’ গ্রান্ডি বলেন, ‘এটা উপলব্ধি করা কঠিন, বহু নির্দোষ মানুষের জীবন কেন এত অসহায় অবস্থায় উপনীত হয়েছে।’
বেপরোয়া যুবরাজের ইয়েমেনে আকস্মিক হস্তক্ষেপ কেবল সৌদি আরবেরই ক্ষতি করবে না, বরং এটা ইরানকে সহায়তা করবে। সিএনএনের এক তদন্তে গেছে, আলকায়েদার যোদ্ধাদেরকে আমেরিকান অস্ত্র সরবরাহ করা হবে। এই যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলার পরিপ্রেক্ষিতে কলেরার প্রাদুর্ভাবের কারণে সম্প্রতি পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিন লাখেরও বেশি মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হওয়ার পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে।
ইরান এবং হাউছি বিদ্রোহীরাও খারাপ ব্যবহার করছে। কিন্তু সেটাকে অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে ইয়েমেনের শিশুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ঘটানোকে আমেরিকানরা সমর্থন দিতে পারে না। সৌদি আরব এবং আমিরাতের ইয়েমেন যুদ্ধের ব্যাপারে এখন তেমন আর কোনো উচ্ছ্বাস নেই। কিন্তু তারা যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে এসে ইরান এবং হাউছিদের যুদ্ধে জয়ী হতেও দিতে চায় না। তাই আমেরিকা চাপ না দেয়া পর্যন্ত কিভাবে যুদ্ধের অবসান ঘটবে তা বলা কঠিন। ট্রাম্প বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র বিক্রি না করলে রাশিয়া অথবা চীন অস্ত্র বিক্রি করবে। কিন্তু সৌদি আরবের প্রয়োজন হচ্ছে, আমেরিকার বাড়তি যুদ্ধাস্ত্র ও তার যন্ত্রাংশ। সৌদি আরব সন্দেহাতীত নিরাপত্তা গ্যারান্টির জন্য আংশিক মার্কিন অস্ত্র ক্রয় করেছে। অন্য কোনো দেশই ‘নিরাপত্তা ব্ল্যাঙ্কেট’ সরবরাহ করতে পারবে না।
তাদের সামরিক বাহিনী আমেরিকার বাড়তি অস্ত্রশস্ত্র, উপায়-উপকরণ এবং যুদ্ধোপকরণের ওপর নির্ভরশীল। মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ব্রুস রিডেল এ কথা বলেছেন। আমরা ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের একটি যুদ্ধ ও সঙ্ঘাতের ক্রমবর্ধমান আশঙ্কার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। বিশেষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী পারস্য উপসাগরে একটি দুর্ঘটনার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। ওই দুর্ঘটনার আরো বিস্তৃতি ঘটছে। ১৯৮৮ সালে একই ধরনের উত্তেজনার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ‘ভুলবশত’ ইরানের একটি যাত্রীবাহী বিমানকে গুলি করে ভূপাতিত করেছিল। তখন ওই বিমানে ২৯০ জন যাত্রী ছিলেন এবং তারা সবাই নিহত হন।
সুতরাং আমাদের অবশ্যই ইরানের সাথে সরাসরি একটি যুুদ্ধের ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য কাজ করা উচিত। তবে এই পুরনো ও লজ্জাজনক যুদ্ধের বিষয়টি আমাদেরকে ভুলে গেলে চলবে না। ইয়েমেনে শিশুদের ওপর বোমাবর্ষণ এবং অনাহারে রেখে তাদেরকে হত্যা করার ব্যাপারে আমেরিকার সমর্থনের অবসান ঘটানোর এখনই সময়।
লেখক : নিউ ইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট। দু’বার পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করেন।
নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা