২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শান্তি ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ

-

বাংলাদেশ বৈচিত্র্য এবং সম্প্রীতির দেশ। ১৬ কোটি জনসংখ্যার এ দেশে বিভিন্ন ধর্মের লোকের বসবাস। তাদের মধ্যে প্রায় ৯০ ভাগই মুসলিম, বাকি ১০ ভাগের মধ্যে রয়েছে হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মের লোক। জাতি, ধর্ম ও ভাষার পার্থক্য থাকলেও বাংলাদেশে তাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সাধারণত বিঘিœত হয়নি। নৃ-গোষ্ঠীগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। যেমনÑ উত্তরে সাঁওতাল জনগোষ্ঠী আর পার্বত্যাঞ্চলে চাকমা, মারমা, মুরং, হাজং প্রভৃতি বসবাস করে। যুগ যুগ ধরে পারস্পরিক প্রতিবেশী স্বরূপ সম্প্রীতির সাথে বাঙালিদের পাশাপাশি বসবাস করছেন তারা।

বাংলাদেশে সাংবিধানিকভাবে বিভিন্ন ধর্মের লোকদের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। সংবিধান সবাইকে যেকোনো ধর্ম গ্রহণ, চর্চা ও পালন করার অধিকার দিয়েছে। আরো বলেছে, প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনা করার অধিকার রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ (১) অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্র কখনোই তার নাগরিকদের মধ্যে ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ ও জন্মস্থান ভেদে কোনো প্রকার বৈষম্য করবে না। স্বাধীনতার পর থেকে সংখ্যালঘুদের ওপর তেমন কোনো বড় ধরনের ধর্মীয় বা জাতিগত আঘাত আসেনি। বাংলাদেশ তার অমলিন সামাজিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক সাম্যের জন্য সব রাষ্ট্রের কাছে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আইন প্রয়োগকারী সব কর্তৃপক্ষ সংখ্যালঘুদের ওপর যেকোনো হামলা প্রতিরোধে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং এ ব্যাপারে তারা কোনো ছাড় দিতে রাজি নয়।

নানাবিধ সমস্যা থাকা সত্ত্বেও সব ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা নিজেদের উৎসবগুলোকে শান্তিপূর্ণভাবে উদযাপন করছে। বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও বন্ধন দিন দিন সুদৃঢ় হয়েছে। ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ ও সঙ্ঘাত থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন ধরে রেখেছে এবং অবশ্যই আগামী বছরগুলোতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও শান্তির এই ধারাকে অব্যাহত রেখেই এগিয়ে যাবে। সম্প্রতি দাড়ি রাখা ও টাখনুর ওপর কাপড় পরা শুরু করা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিয়ে, গায়ে হলুদ, জন্মদিন পালন, গান বাজনাসহ পারিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখাসহ বেশ কিছু বিষয়কে ‘জঙ্গিবাদের লক্ষণ’ হিসেবে চিহ্নিত করে বিজ্ঞাপন দিয়েছে ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠন।

বিজ্ঞাপনে সন্দেহভাজন জঙ্গি সদস্য শনাক্তকরণের যেসব সূচক দেয়া হয়েছে, তাতে ক্ষুব্ধ হয়েছেন ধর্মপ্রাণ মানুষেরা। আলেম-ওলামা মনে করেন, এমন প্রচারণা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কারণ এর মাধ্যমে ইসলামের বিধিবিধান সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচার করা হচ্ছে। এটা শান্তি ও সম্প্রীতির পরিপন্থী। মনে রাখা দরকার, ইসলাম শান্তি-সম্প্রীতি ও মানবতার ধর্ম। কোনোরূপ সহিংসতা, বিবাদ-বিসংবাদের স্থান ইসলামে নেই। শান্তি-শৃঙ্খলা ও সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়- এমন কোনো আচরণকেই ইসলাম প্রশ্রয় দেয় না। পবিত্র কুরআন মজিদে আল্লাহ তায়ালা উল্লেখ করেন, ‘ফিৎনা-ফাসাদ বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করা হত্যার চেয়েও কঠিন অপরাধ’ (সূরা বাকারা : ১৯১)। কেবল মুসলমান নয়, অমুসলিমদের প্রতিও কোনো অন্যায় আচরণ ইসলাম অনুমোদন করে না। শান্তি-সৌহার্দ্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সুরক্ষায় ইসলামের রয়েছে শ্বাশত আদর্শ ও সুমহান ঐতিহ্য। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সাথে মহানবী মুহাম্মদ সা:-এর প্রতিটি আচরণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরল ও প্রোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

উৎকৃষ্টতম আদর্শের মাধ্যমেই বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রচার ও জাগরণ ঘটেছে। মুহাম্মদ সা: মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পর যে ‘মদিনা সনদ’ প্রণয়ন করেছিলেন, তা ইতিহাসের সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান এবং শান্তি-সম্প্রীতির ঐতিহাসিক দলিল। এই মহান সনদে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষাসহ সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তা প্রদান সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ ধারা সন্নিবেশিত রয়েছে। যেমন, ‘সনদে স্বাক্ষরকারী সব গোত্র-সম্প্রদায় ‘মদিনা রাষ্ট্রে’ সমান অধিকার ভোগ করবে, সব ধর্মসম্প্রদায়ের নিজ নিজ ধর্ম-কর্ম পালনের স্বাধীনতা ও অধিকার যথারীতি বহাল থাকবে; কেউ কারো ওপর কোনোরূপ আক্রমণ করবে না, সন্ধিভুক্ত কোনো সম্প্রদায় বহিঃশত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হলে আক্রান্ত ওই সম্প্রদায়কে সম্মিলিতভাবে সহযোগিতা এবং শত্রুদের প্রতিহত করতে হবে। কোনো নাগরিক কোনো অপরাধ করলে তা তার ব্যক্তিগত অপরাধ বলে গণ্য করা হবে’ (সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৯৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত)।

ইসলামের ইতিহাসে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে দেখা যায়, ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়ের দিন মহানবী সা: বিজয়ী বেশে মক্কা নগরে প্রবেশ করলে কুরাইশদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু মুহাম্মদ সা: বিজিত শত্রুদের প্রতি কোনো ধরনের দুর্ব্যবহার করেননি এবং কিঞ্চিৎ পরিমাণ প্রতিশোধস্পৃহাও প্রকাশ করেননি। বরং দুশমনদের প্রতি ক্ষমা ঘোষণা করেছেন।

প্রতিশোধের পরিবর্তে শত্রুদের প্রতি মুহাম্মদ সা: ক্ষমা ও মহানুভবতার অসংখ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করার বিষয় শান্তি-সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় ইসলামের চিরন্তন আদর্শের জানান দেয়। কোনো দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর যদি সে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে শান্তি-সম্প্রীতি, নীতি-নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ না ঘটে, তাহলে সে দেশের স্বাধীনতা অর্থবহ হয়ে ওঠে না। পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা, সংলাপ-সমঝোতা, সহযোগিতা, সহিষ্ণুতা ও সহানুভূতিপূর্ণ সামাজিক সম্প্রীতি ছাড়া মানুষ নিরাপদে চলতে পারে না। মানুষের একের প্রতি অন্যের বিশেষ অধিকার ও দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে। এসব নাগরিক অধিকার ও কর্তব্যবোধ ধর্মভীরু মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করে। ফলে সামাজিক ঐক্য-সংহতি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই; সুতরাং তোমরা তোমাদের ভাইদের মধ্যে মীমাংসা করবে আর আল্লাহকে ভয় করবে, যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও’ (সূরা আল হুজরাত : ১০)।

সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত ছোবলে জর্জরিত বিপর্যস্ত এই পৃথিবীকে ইসলাম দিয়েছে অনাবিল শান্তি-সম্প্রীতির পথ্য। বংশানুক্রমিক কলহ আর বিদ্বেষ নিয়ে যুগের পর যুগ পার করা পৃথিবীতে ইসলাম সৃষ্টি করেছে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি এবং সাম্য ও প্রেমের মাহফিল। ইসলামের ইতিহাস কানায় কানায় ভরা সম্প্রীতি ও প্রেমের বাঁধনে গড়া অনন্য সব ঘটনা দিয়ে।

দাড়ি-টুপি ও টাখনুর ওপর কাপড় পরা উগ্রবাদের লক্ষণ বলে কটূক্তি করা বাংলাদেশের শান্তি ও সম্প্রীতি বিনষ্ট করার পাঁয়তারা। বন্ধ করতে হবে এসব অপতৎপরতা। বাংলাদেশ একটি শান্তিপূর্ণ দেশ। এ দেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়। মিলেমিশে থাকতেই তারা অভ্যস্ত। সম্প্রীতি আর আন্তরিকতা আমরা হারাতে চাই না। চাই না কোনো হিংসা-বিদ্বেষ। পৃথিবীর সব দেশের কাছে আমরা সম্প্রীতির মডেল হতে চাই। সাম্প্রদায়িক এই উজ্জ্বল আদর্শকে রক্ষা করতে হবে। বজায় রাখতে হবে সম্প্রীতির সহাবস্থান। উসকানিমূলক কথাবার্তা ও আচরণ পরিহার করতে হবে। ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। কাউকে বাদ দিয়ে এগোনো যাবে না।

লেখক : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক


আরো সংবাদ



premium cement