১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

টেকসই উন্নয়নে করণীয়

- ফাইল ছবি

উন্নয়ন শব্দটির ব্যবহার এখন প্রায় উঠে গেছে। বলা হচ্ছে টেকসই উন্নয়ন। টেকসই উন্নয়ন হচ্ছে কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবনমান, পরিবেশ, দক্ষ শ্রমশক্তি ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন সূচকের গুণগত উন্নতি। টেকসই উন্নয়ন মানে রফতানিমুখী শিল্পায়ন ও রফতানিতে বৈচিত্র্য আনা এবং সম্পদের সুষম বণ্টনের ভিত্তিতে পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় রফতানিমুখী শিল্পের উন্নয়নের কথা বলা থাকলেও বাংলাদেশের রফতানিবাণিজ্য কেবল তৈরী পোশাকের ওপর নির্ভরশীল। রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি আসে এ খাত থেকে। এটি টেকসই ব্যবস্থা নয়। জাতিসঙ্ঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনে মোট অভীষ্ট ১৭টি। এর মধ্যে মোট ১৬৯টি লক্ষ্য আছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এসব লক্ষ্য অর্জনের কথা বলা হয়েছে জাতিসঙ্ঘের ঘোষণায়।

এসডিজি বাস্তবায়নে সরকারের নানামুখী পরিকল্পনা রয়েছে, কিন্তু এ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন কতটুকু বাস্তবভিত্তিক ও টেকসই হচ্ছে, তা দেখা দরকার। অর্থনৈতিক সূচকের দিক থেকে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি; কিন্তু উন্নয়নকে টেকসই মনে করতে পারছি না। কারণ ঋণখেলাপির পরিমাণ বেড়েই চলছে, ক্রমেই প্রকট হচ্ছে ধনী-গরিবের আয় ও ভোগ-ব্যবধান। পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নে আমরা তেমন এগোতে পারছি না। আমাদের শ্রমিকেরা বিদেশে গিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করে আমাদের অর্থ পাঠায়, আর আমরা তা অপচয় করি কোনোরকম জবাবদিহি ছাড়াই। এ ধরনের প্রবণতা আসলে উন্নয়নকে টেকসই করছে না। আমরা যদি জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে পরিণত করতে পারতাম, যদি সঠিকভাবে শিল্পায়নের দিকে মনোনিবেশ করতে পারতাম, তা হলে উন্নয়ন টেকসই হতো।

শিল্পায়ন ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমাদের জমি, কাঁচামাল ও গ্যাসের পর্যাপ্ততার সাথে প্রবাসী অর্থের সংযোগ ঘটিয়ে শিল্পের গতি বাড়াতে পারি। টেকসই উন্নয়নের পথে যেসব বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দেয়া উচিত তা হলো- দুর্নীতি দূর করা, ব্যাংক ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়ে খেলাপি ঋণের হার কমানো, কৃষি খাতের জন্য অনুকূল পরিবেশ, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও ব্যক্তি খাতের জন্য যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিত করা। গুণগত শিক্ষা ও দক্ষতা নিশ্চিত করা, সমাজের বৈষম্য দূর করা ও সবার জন্য স্বাস্থ্যকর জীবনমান নিশ্চিত করা।

আমাদের দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। যদিও জিডিপিতে অবদান মাত্র ১৫ শতাংশ, কৃষি খাত মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪৫ শতাংশের কর্মসংস্থান করে। কৃষি খাতে এর ধারণক্ষমতার তুলনায় বেশি মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে, যা অন্যান্য খাতে সীমিত কর্ম সুযোগের ইঙ্গিত বহন করে। টেকসই উন্নয়নের জন্য জলবায়ু-জনিত পরিবর্তন ও কৃষি খাতের উদীয়মান চ্যালেঞ্জগুলোর প্রতি নজর দেয়া উচিত। বর্তমান সময়ে আমাদের আরেকটি বড় সমস্যা হলো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশÑ যা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। তা ছাড়া রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধির নিম্নমুখী প্রবণতা, মূল্যস্ফীতির বৃদ্ধি এ যাবৎ কালের বড় সমস্যা। রাজনৈতিক অস্থিরতাও প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগে নীতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। টেকসই উন্নয়নের জন্য জোর দেয়া উচিত গুণগত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ওপর। সরকারি ও বেসরকারি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আরো নজরদারি ও জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত। শিক্ষা, গবেষণা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, সর্বোপরি মানবসম্পদ উন্নয়নে সরকারের অগ্রাধিকার দেয়া উচিত।

এতে শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়বে। রাজস্ব ও আর্থিক খাতের সংস্কার প্রয়োজন। কর-জিডিপি অনুপাত দীর্ঘ দিন ধরেই ১০ শতাংশের নিচে। টেকসই উন্নয়নের জন্য এ বৃত্ত ভাঙতেই হবে। বাড়াতে হবে কর বহির্ভূত রাজস্বের পরিমাণ। বড় ঋণখেলাপিদের কঠোর আইনি শাস্তির আওতায় আনতে হবে। অর্থঋণ আদালত আইন সংশোধন করে ঋণ আদায়ের হার বাড়াতে হবে। টেকসই উন্নয়নের ধারা বজায় রাখার ক্ষেত্রে করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটা একধরনের ব্যবসায়িক শিষ্টাচার বা রীতি। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালিত কার্যক্রমের ফলে উদ্ভূত নানা রকম পরিবেশগত বিরূপ প্রভাব পড়ে। এসব দূর করার পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে বিদ্যমান ক্ষোভ, অসমতা ও দারিদ্র্য কমানো সিএসআরের মূল উদ্দেশ্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী, ব্যাংকগুলো আটটি খাতে সিএসআরের অর্থ ব্যয় করতে পারে। এসব খাত হলো- শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ, সাংস্কৃতিক কল্যাণ, প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, অধিকতর বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য আয়বর্ধক কর্মসূচি ও অন্যান্য খাত।

শ্রমঘন অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের তুলনামূলক সুবিধা হলো জনশক্তি বা জনসম্পদ। আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী হলেও নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশ নেয়ার হার ৩৬ শতাংশ। তাতে প্রতীয়মান হয়, নারী শ্রমশক্তির উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অংশ দেশের অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষ অবদান রাখতে পারছে না। অথচ শ্রীলঙ্কার শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ ৭১ শতাংশ। টেকসই উন্নয়নের জন্য এ সম্পদের কার্যকর ও সুষম ব্যবহার বাড়াতে হবে। ২০১৭ সালে এসডিজি বাস্তবায়নে পর্যালোচনাবিষয়ক এক সম্মেলনে বলা হয়েছিলÑ জাতিসঙ্ঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জন করতে বালাদেশের বছরে বাড়তি ছয় হাজার ৬৩০ কোটি ডলার লাগবে, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় পাঁচ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা। ২০১৭ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারিভাবে এ অর্থ ব্যয় করতে হবে। উন্নয়ন পরিকল্পনার ক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

উন্নয়ন পরিকল্পনা সম্পর্কে জনগণের তথ্য পাওয়া নিশ্চিত করতে হবে। যদি দেখা যায় উন্নয়ন পরিবেশ বিধ্বংসী হচ্ছে, তাহলে জনগণকে তার প্রতিকার পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে । যে উন্নয়ন কোনো গোষ্ঠীকে বড়লোক করে, বেশির ভাগ মানুষকে সম্পদহারা করে, সেটি টেকসই উন্নয়ন হতে পারে না। টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী ও কার্যকর গণতন্ত্র ও সুশাসন। প্রয়োজন নিজস্ব ধারার উন্নয়ন। সবার মতামতের ভিত্তিতে উন্নয়ন। বঙ্গবন্ধুর দর্শন ছিল কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের মুক্তি, শোষণমুক্তির কথা। বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীন বাংলায় আঞ্চলিক বৈষম্য ও অসমতা থাকতে পারে না।

টেকসই উন্নয়নের জন্য তৈরী পোশাক শিল্পের উন্নয়নের পাশাপাশি নতুন নতুন পণ্যের বাজার সৃষ্টি করতে হবে। চামড়া ও পাদুকা শিল্পের মতো রফতানিযোগ্য পণ্যের প্রসারে প্রণোদনা দিতে হবে। রফতানিমুখী পণ্যের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। বিশ্ববাজারের সাথে অধিকতর সংযোগ সৃষ্টি করতে হবে। 

লেখক : ব্যাংকার
ইমেইল : main706@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
ফরিদপুরের গণপিটুনিতে নিহত ২ নির্মাণশ্রমিক জাতিসঙ্ঘে ফিলিস্তিনি সদস্যপদ লাভের প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো তীব্র তাপপ্রবাহে বাড়ছে ডায়রিয়া হিটস্ট্রোক মাছ-ডাল-ভাতের অভাব নেই, মানুষের চাহিদা এখন মাংস : প্রধানমন্ত্রী মৌসুমের শুরুতেই আলু নিয়ে হুলস্থূল মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এত শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি বুঝতে পারেনি ইসরাইল রাখাইনে তুমুল যুদ্ধ : মর্টার শেলে প্রকম্পিত সীমান্ত বিএনপির কৌশল বুঝতে চায় ব্রিটেন ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট আজ নিষেধাজ্ঞার কারণে মিয়ানমারের সাথে সম্পৃক্ততায় ঝুঁকি রয়েছে : সেনাপ্রধান

সকল