২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল : রমজানের ভূমিকা

- ফাইল ছবি

শুদ্ধাচার বলতে সাধারণভাবে নৈতিকতা ও সততা দিয়ে প্রভাবিত আচরণগত উৎকর্ষ বোঝায়। ব্যক্তিপর্যায়ে এর অর্থ হলো কর্তব্যনিষ্ঠা ও সততা, তথা চরিত্রনিষ্ঠা। রাষ্ট্রের অন্যতম লক্ষ্য ও দায়িত্ব হলো নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, সমতা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করা। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নেই রাষ্ট্র সুশাসন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। এ ক্ষেত্রে একটি অপরিহার্য কৌশল হলো সমাজ ও রাষ্ট্রকে দুর্নীতিমুক্ত রাখা ও দেশে শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা। এরই সুসমন্বিত উদ্যোগ হিসেবে সরকার ‘সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয় : জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল’ শিরোনামে একটি জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল প্রণয়ন করেছে। ১৮ অক্টোবর ২০১২ অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে কৌশলপত্রটি চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান : ১. নির্বাহী বিভাগ ও জনপ্রশাসন, ২. জাতীয় সংসদ, ৩. বিচার বিভাগ, ৪. নির্বাচন কমিশন, ৫. অ্যাটর্নি জেনারেল, ৬. সরকারি কর্ম কমিশন, ৭. মহাহিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়, ৮. ন্যায়পাল, ৯. দুর্নীতি দমন কমিশন, ১০. স্থানীয় সরকার।
অরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান : ১. রাজনৈতিক দল, ২. বেসরকারি খাতের শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, ৩. এনজিও ও সুশীলসমাজ, ৪. পরিবার, ৫. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ৬ গণমাধ্যম।

কৌশলপত্রের দ্বিতীয় অধ্যায়ে ওই রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য, এর প্রেক্ষাপট ও চ্যালেঞ্জ বর্ণনা করা হয়েছে এবং লক্ষ্য, সুপারিশ ও কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়েছে। ‘শুদ্ধাচার কৌশল’টি বাস্তবায়নের জন্য একটি জাতীয় শুদ্ধাচার উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের কথা বলা হয়েছে। এই উপদেষ্টা পরিষদ বছরে অন্ততপক্ষে দু’বার সভায় মিলিত হবে এবং শুদ্ধাচার অনুশীলন পর্যালোচনা ও পরিবীক্ষণ করবে এবং এ সম্পর্কিত দিকনির্দেশনা দেবে। এ ছাড়াও চিহ্নিত প্রতিষ্ঠানে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নৈতিকতা কমিটি ও শুদ্ধাচার ফোকাল পয়েন্ট প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে।

‘জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল’-এর পটভূমির ভূমিকায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ মঙ্গল এবং জাতীয় জীবনের সর্বত্র উচ্চাদর্শ প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে ‘জনগণের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সুবিচার নিশ্চিতকরণ’সহ জাতিসঙ্ঘের সনদে উল্লিখিত মূলনীতিগুলো মেনে চলার প্রতিশ্রুতির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ন্যায়ভিত্তিক, দুর্নীতিমুক্ত ও শুদ্ধাচারী রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই কেবল মানবসত্তার সেই মর্যাদা এবং মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত করা সম্ভব।

কৌশলপত্রটিতে কয়েকটি রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের শুদ্ধাচার কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ ও সুনির্দিষ্ট সুপরামর্শ ও কার্যক্রমের বিষদ প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু জনশুদ্ধির জন্য ব্যক্তির আত্মশুদ্ধির কর্মপরিকল্পনা আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়নি। যেকোনো কৌশল বাস্তবায়নের জন্য ব্যক্তির রয়েছে অপরিসীম ভূমিকা। ব্যক্তির ব্যর্থতায় অনেক ভালো কৌশলও ম্নান হয়ে পড়ে।
আল কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি খোদার নিকট সবচেয়ে বেশি সম্মানিত, যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খোদাভীরু (যার চরিত্র উত্তম)।’ সূরা আল হুজুরাত : ১৩।

শুদ্ধাচার বাস্তবায়নে রমজানের ভূমিকা : মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত। আল্লাহ তায়ালা মানুষ সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তার ইবাদত ও দাসত্বের জন্য। আল কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আমি জ্বিন ও মানবজাতিকে কেবল আমারই ইবাদত ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি।’ সূরা আয যারিয়াত : ৫৬।

দিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অল্প বা সামান্য সময় মৌলিক ইবাদত পালনের জন্য যথেষ্ট। অবশিষ্ট পুরো সময়ই মানুষকে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, আর্থিক, রাজনৈতিক, পারস্পরিক লেনদেন সংক্রান্ত কার্যক্রমে ব্যস্ত থাকতে হয়। পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য ও অধিকারগুলো ‘হক্কুল ইবাদ’। আর মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সব কার্যকলাপই মুয়ামালাতের অন্তর্ভুক্ত। ইবাদত ও মুয়ামালাতের সমন্বয়েই ইসলাম একমাত্র পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা তথা পূর্ণাঙ্গ দ্বীন।

মৌলিক ইবাদতগুলো পরস্পরের অধিকার ও দায়িত্ব কর্তব্য সর্বোপরি মুয়ামালাতকে সঠিক নীতি ও আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠা করে সমাজ জীবনে আত্মশুদ্ধি ও জনশুদ্ধির পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং জাতীয় শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। কেবল আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে দুর্নীতি ও অবক্ষয় দমন করা সম্ভব নয়। তার জন্য প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন। মৌলিক ইবাদত ও ইসলামের মুয়ামালাতগুলো হতে পারে এ আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ।

রোজা অন্যতম ফরজ ইবাদত। ইসলামের পাঁচটি রুকন বা স্তম্ভের মধ্যে চতুর্থ রুকন হচ্ছে রোজা। রোজা ফারসি শব্দ। রোজাকে আরবিতে সাওম বলা হয়েছে। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, কোনো কিছু থেকে বিরত থাকা, বিরত করা, সংযম, নিয়ন্ত্রণ, সংযত হওয়া, কিছু পরিত্যাগ করা, অবিরাম চেষ্টা-সাধনা ইত্যাদি। রোজা মানুষকে পানাহার ও যৌনাচার থেকে বিরত রাখে, নফসকে বারণ করে, শয়তানকে বান্দার কাছ থেকে সরিয়ে রাখে। এ জন্য এর নাম ‘সাওম’।

আরবি ‘রমজ’ ধাতু থেকে রমজান শব্দটি এসেছে। এর একটি অর্থ দহন করা, পুড়িয়ে ফেলা, জ্বালিয়ে দেয়া, দগ্ধীভূত করা, ধ্বংস করা। রমজানের রোজা গুনাহকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে শেষ করে দেয়। নফসের খায়েসকে পুড়িয়ে মানুষকে খাঁটি বান্দাহ বানায়। সোনা যেমন আগুনে পুড়ে খাঁটি হয়ে ওঠে, সিয়াম সাধনাও তেমনি মানুষকে পুড়িয়ে খাঁটি করে তোলে।

মানুষের মূল পরিচয় হচ্ছে তার নৈতিক দিক। রোজা মানুষের এই নৈতিক সত্তাকে উৎকর্ষ করে, পরিশীলিত করে এবং তাকে সত্যিকার মানুষ তৈরি করে। ইমাম গাজ্জালি রহ:-এর ভাষায় ১০টি মন্দ স্বভাব আত্মোন্নয়ন ও আত্মশুদ্ধির পথে বাধাস্বরূপ : লোভ, উচ্চাভিলাষ, প্রদর্শনেচ্ছা, অহঙ্কার, মিথ্যা, পরনিন্দা, হিংসা, অহমিকা, পরশ্রীকাতরতা ও কৃপণতা।

রোজা মানুষের কুপ্রবৃত্তি, মন্দ স্বভাবকে দমন করে, নফসকে আত্মসংযমী, পরিশোধিত, অনাবিল ও নির্মল করে গড়ে এবং ধৈর্য, উদারতা, ক্ষমা, মহত্ত্ব, প্রেম-ভালোবাসা, সহমর্মিতা, সংবেদনশীলতা, দানশীলতা, কষ্টসহিষ্ণুতা প্রভৃতি মানবীয় গুণকে বিকশিত করে, বিশুদ্ধ করে, পবিত্র ও মার্জিত করে তোলে বলে এ মাসের নাম ‘রমজান’।

রূহ আল্লাহর দাস ও আদেশানুগামী হয়ে থাকে। সফল জীবনযাপনের জন্য অনুগত রূহ একান্ত অপরিহার্য। রূহ ভালো ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করে দেয়। নফসের মন্দ বা খারাপ দাবি বাধা দেয়। রূহ দেহে বিচারব্যবস্থার ভূমিকা পালন করে। নফস ও রূহের দ্বন্দ্ব চলে। রূহ সব সময় ভালো চায়। যে রূহ আল্লাহর আইনের আনুগত্য করবে, প্রবৃত্তির দাবি উপেক্ষা করে মানুষকে স্বীয় প্রভুর অধীন করবেÑ ইসলাম এরূপ রূহকেই সমর্থন করে।

এভাবে ক্রমাগত নফস এক দুচ্ছেদ্য বাঁধনে আবদ্ধ হয় এবং রূহ ও আত্মার মধ্যে এক বিরাট শক্তি স্ফুরিত হয়। ফলে রূহ দেহের ওপর শাসন ক্ষমতা চালাতে সমর্থ হয়। এভাবে রমজান বয়ে আনে অফুরন্ত কল্যাণ, সৃষ্টি করে সংযম, আত্মশক্তি, ইচ্ছাশক্তির বলিষ্ঠতা, বিবেকের প্রাধান্য আর শাণিত ব্যক্তিত্ব। যা ব্যক্তিকে কর্তব্যনিষ্ঠ, সৎ ও চরিত্রনিষ্ঠ করে বেড়ে উঠতে শক্তি জোগায় এবং এভাবে সে জাতীয় শুদ্ধাচার বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখে।


আরো সংবাদ



premium cement