২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আইনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ও খালেদার মুক্তি

খালেদা জিয়া - ছবি : সংগ্রহ

রাজনৈতিক বিশ্লেষণে মুক্তিযুদ্ধের চালিকা শক্তি ছিল ব্যালটের মর্যাদা রক্ষার লড়াই। গণতন্ত্র ও ভোটের মর্যাদা রক্ষার জন্য এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছে এই বাংলাদেশ।
১৯৭১ সালে প্রবাসী মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছিল প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির আদলে। প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান ইয়াহিয়া সরকারের হাতে বন্দী থাকার দরুন মরহুম সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট করা হয়েছিল। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে আসার দুই দিন পরই দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন। অর্থাৎ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আজীবনের রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণার স্বপ্নে লালিত সংসদীয় গণতন্ত্রের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। সংসদীয় পদ্ধতির মাধ্যমে জনগণের ভোটের অধিকারের এবং রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের লড়াইয়ের শতভাগ মর্যাদা দিতে বঙ্গবন্ধু পিছপা হননি।

শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সদ্য স্বাধীন দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করার পরপরই সংসদীয় গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে শুরু হয় ষড়যন্ত্র। একদল ছাত্রনেতা সর্বদলীয় সরকার গঠনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ওপর প্রচণ্ড চাপ প্রয়োগ করলেও বঙ্গবন্ধু সম্মত হননি। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন দেশে প্রথমবারের মতো সংসদীয় পদ্ধতিতে সংসদ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে ক্ষমতাসীন দল। সংসদীয় গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করে সশস্ত্রপন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টায় সিরাজুল আলম খানের ভাবশিষ্য কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য সেনাছাউনিতে ‘গণবাহিনী’ গঠিত হয়। সংসদীয় পদ্ধতিতেই একপর্যায়ে সব চক্রান্তের বিলুপ্তি ঘটানো যেত। নাজুক প্রেক্ষাপটে মস্কোপন্থীদের ভুল পরামর্শে শেখ মুজিবুর রহমান তার রাজনীতির আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদের মাধ্যমে একদলীয় সরকার গঠন করে সংসদীয় পদ্ধতির যবনিকাপাত ঘটালেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সামরিক অভ্যুত্থানে রাজনীতির পটপরিবর্তনের ধারায় বাকশালের বিলুপ্তি ঘটে। বহুদলীয় ব্যবস্থার প্রত্যাবর্তনকে জনগণ সানন্দে গ্রহণ করে। বর্তমান পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেন নতুন করে বাকশালের প্রশংসা করছেন তা বোধগম্য নয়। ‘একদলীয় শাসনেও ভোটের নিশ্চয়তা’র কথা তিনি বলেছেন। বাস্তবে একদলীয় শাসনে গণতন্ত্র, সংসদীয় গণতন্ত্র, ভোটের অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকে না। গণতন্ত্র হারা দেশে গণতন্ত্র সুসংহত আছে বলেও দাবি করা হচ্ছে। আমার ব্যক্তিগত মত, বাকশাল গঠনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর ভাবমর্যাদা নস্যাৎ হয়েছিল। যা হোক, সরকারের একদলীয় শাসনের প্রয়োজন নেই।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি এবং ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র দুটোই নির্বাসিত হয়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশে জনগণ আজ পর্যন্ত ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত। ক্ষমতাসীন সরকার গণতন্ত্রের উল্টো পথে হাঁটছে। আমেরিকার একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্রের প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত একটি দেশের সরকারও স্বৈরাচার হতে পারে।’ বিরোধী দল গণতন্ত্রের মাতা বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। এ দাবি জনগণের দাবি। গণতন্ত্র উদ্ধারের লড়াইয়ে জনগণ বিজয়ী হবে, এটাই স্বাভাবিক। ক্ষমতাসীন সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিজেদের ক্ষমতাসীন রাখার স্বার্থে ব্যবহার করে যাচ্ছে। এমন নজির কোনো গণতান্ত্রিক দেশে নেই।

জাতি আশা করে, জনগণের ভোটাধিকার ও হারানো গণতন্ত্র ফিরে পাওয়ার নির্ভেজাল গণ-আন্দোলনকে সন্ত্রাসী আন্দোলনের শ্রেণিভুক্ত করা হবে না।
এক-এগারোর পর্যায়ে সেনাবাহিনী প্রধান মইন ইউ আহমেদ এবং ফখরুদ্দীন ক্ষমতাসীন হয়ে নিজেরা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকার নীলনকশার অংশ হিসেবে তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং আওয়ামী লীগ প্রধান ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কারাবন্দী করে, দুর্নীতির মামলা সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের বিপুল জনপ্রিয়তা নস্যাৎ করার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তবে তাদের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করে তার নামে দায়ের করা প্রায় ১৪টি মামলা এবং তার দলীয় নেতাদের নামে দায়েরকৃত মামলা সরকারি ক্ষমতা বলে তুলে নেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার নামে দায়ের করা ১২টি মামলা সরকার তুলে নেয়নি। তুলে নেয়নি বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাগুলো। এ ব্যাপারে ইচ্ছাকৃতভাবে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বৈষম্যের পাহাড় সৃষ্টি করা হয়েছে।

‘এক-এগারো’ সরকার জনগণ থেকে জনপ্রিয় দুই নেত্রীকে বিচ্ছিন্ন করার কৌশল অবলম্বন করে তাদের দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি চিহ্নিত করার অন্তহীন প্রয়াস চালিয়েছিল। খালেদা জিয়ার মামলাগুলো রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে ক্ষমতাসীনেরা উঠিয়ে নেয়নি। সেহেতু রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় উচ্চতর আদালতের মাধ্যমে মামলাগুলোর পরিসমাপ্তি হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু সরকারের নগ্ন হস্তক্ষেপে তা হতে পারেনি। খালেদা জিয়ার মামলাগুলো রেখে দিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে মামলাগুলো সচল করে তাকে সাজা দেয়া, পরে উচ্চ আদালতের মাধ্যমে সাজা বেড়ে যাওয়া ইত্যাদিকে জনগণ মনে করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করা। খালেদা দুর্নীতির জন্য নয়, রাজনৈতিক কারণে আজ কারাগারে রাজবন্দী। তাকে বন্দী এবং নির্বাচন থেকে দূরে রাখা নীলনকশার অংশ। গত ৩০ ডিসেম্বরের ভোটারবিহীন নির্বাচন দেশ-বিদেশ মেনে না নিলেও ক্ষমতাসীনেরা নির্বাচনের নামে ক্ষমতা আঁকড়ে আছেন। ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার জন্য দেশ থেকে গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। খালেদা জিয়ার কারামুক্তির সাথে গণতন্ত্রের মুক্তি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। স্মর্তব্য, ১৯৯১ সালে তার হাত দিয়েই দীর্ঘ ১৫ বছরের হারানো সংসদীয় গণতন্ত্র দেশ ফিরে পেয়েছিল। বেগম জিয়ার জামিন প্রসঙ্গে বলতে হয়- ক. বেগম খালেদা জিয়া ৭৪ বছর বয়সী প্রবীণ মহিলা এবং তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী; খ. তিনি স্বেচ্ছায় আদালতে হাজির হয়েছেন; গ. তিনি স্বীকৃত মতেই গুরুতর অসুস্থ; ঘ. তিনি দীর্ঘ দিন ধরে কারাগারে। যেসব মামলায় তিনি জামিনে মুক্ত আছেন, তিনি অসুস্থ বলে বিজ্ঞ বিচারকদের ভরহফরহম-এ উল্লেখ রয়েছে। মেডিক্যাল বোর্ডের মাধ্যমে তার চিকিৎসা চলছে। ফৌজদারি কার্যবিধি ৪৯৭(১) ধারায় জামিন অযোগ্য, এমনকি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার মতো অভিযোগ প্রমাণিত হলেও তিনি যদি মহিলা, অসুস্থ এবং চলাফেরায় অক্ষম হন; তাহলে জামিনে মুক্তি পেতে পারেন বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশে।

বেগম খালেদা জিয়া একজন মহিলা, তিনি অসুস্থ এবং চলাফেরা করতে অক্ষম। এ অবস্থায় উচ্চতর আদালতের মাধ্যমে জামিনে মুক্তি পেতে আইনগত বাধা থাকার কথা নয়। বর্তমান অবস্থায় প্যারোলে কেন, উচ্চতর আদালতের মাধ্যমে জামিনে তিনি মুক্তি পাওয়াই স্বাভাবিক দীর্ঘ কারাবাস বিবেচনায়। মন্ত্রীরাও বলছেন, আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তিনি জামিন ও মুক্তি পেতে পারেন। অবশ্য প্রতীয়মান হয়, সরকার চাচ্ছে না তিনি কারামুক্ত থাকুন। তিনি যদি গণতন্ত্রের ব্যাপারে আপসহীন সংগ্রামী না হতেন, যদি জনপ্রিয়তার শীর্ষে না থাকতেন, তবে তাকে মামলা সাজিয়ে কারাবন্দী রাখা হতো না। তবুও আশা করা যায়, উচ্চতর আদালতের আইনি প্রক্রিয়ায় তিনি জামিনে মুক্তি লাভ করবেন। সরকার বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তিতে বাধা বিধায় উচ্চতর আদালতের আইনসঙ্গত হস্তক্ষেপই এ ক্ষেত্রে কাম্য।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও সিনিয়র অ্যাডভোকেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জজকোর্ট


আরো সংবাদ



premium cement