১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বাণিজ্যযুদ্ধসহ সর্বক্ষেত্রে চীন-আমেরিকার ঠাণ্ডা লড়াই

বাণিজ্যযুদ্ধসহ সর্বক্ষেত্রে চীন-আমেরিকার ঠাণ্ডা লড়াই - ছবি : সংগ্রহ

দুই পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন একে অপরের বিরুদ্ধে এখন বাণিজ্যযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। শুধু বাণিজ্য ক্ষেত্রেই নয়, দু’দেশ সেমি কন্ডাক্টর থেকে সাবমেরিন এবং ব্লকবাস্টার সিনেমা থেকে চন্দ্রে অবতরণ বা মহাকাশযান নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রেও প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। দুই সুপার পাওয়ারই একটি উইন-উইন বিশ্ব চায়। বর্তমানে জয়লাভ করার অর্থ হলো একের জন্য- অপর পক্ষের পরাজয়। আমেরিকা চীনকে স্থায়ীভাবে পরাভূত করে রাখতে চায়- যে আমেরিকা পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রশান্ত মহাসাগর থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এটা একটা নতুন ধরনের স্নায়ুযুদ্ধ- সে যুদ্ধে কেউ হারতে চায় না।

আমেরিকার অভিযোগ হচ্ছে, চীন প্রযুক্তি চুরি করে এবং প্রতারণার মাধ্যমে শীর্ষে ওঠার চেষ্টা করছে এবং দক্ষিণ চীন সাগরে পেশিশক্তি প্রদর্শন এবং কানাডা ও সুইডেনের মতো বলপ্রয়োগের গণতন্ত্রের মাধ্যমে বিশ্ব শান্তির পথে হুমকি হয়ে দাঁড়াতে চায়।
অপর দিকে চীন এশিয়ায় তার ন্যায়সঙ্গত স্থান ও মর্যাদা ফিরে পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর। চীনের ভয় ক্লান্ত ও ঈর্ষাপরায়ণ আমেরিকা চীনের উত্থান থামিয়ে দিতে চায়।

যুক্তরাষ্ট্রে রফতানিকৃত প্রায় দুই হাজার কোটি ডলারের চীনা পণ্যের শুল্ক বৃদ্ধি করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশে বৃদ্ধি করা হয়েছে। মাছ, হাতব্যাগ, পোশাক, জুতাসহ এ পণ্যগুলোর শুল্ক ১০ থেকে ২৫ শতাংশ হয়েছে বলে জানিয়েছে চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এদিকে, চীনা পণ্য আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বাড়ানোর জবাবে সমপরিমাণ মার্কিন পণ্যের ওপর দ্বিগুণ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে বেইজিং। চীনের এই পাল্টা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ট্রাম্প। সম্প্রতি প্রায় ২০ হাজার কোটি ডলার মূল্যের চীনা পণ্যে শুল্কের হার দ্বিগুণ করেছে আমেরিকা। এর জবাবে চীন বলেছে, জুনের ১ তারিখ থেকে তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হওয়া পণ্যে শুল্ক হার বাড়াবে। চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা জবাব না দেয়ার জন্য হুঁশিয়ার করেছেন ট্রাম্প। এই হুঁশিয়ারির মাধ্যমে বাণিজ্যযুদ্ধে আরো কঠোর অবস্থানই জানান দিলেন ট্রাম্প। চীন একটি বাণিজ্য চুক্তিতে রাজি না এলে তাদের অবস্থা আরো বেগতিক হবে বলেও জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। একের পর এক টুইটের মাধ্যমে ট্রাম্প চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে পাল্টা শুল্কারোপের পদক্ষেপ না নেয়ার জন্য সতর্ক করেছেন।

২০১৮ সালের তিন হাজার ৪০০ কোটি ডলারের চীনা পণ্য আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ শুরু করে ট্রাম্প প্রশাসন। পাল্টা উত্তর দেবার হুমকি আসে বেইজিংয়ের পক্ষ থেকেও। চীনের অভিযোগ ট্রাম্পের নেয়া পদক্ষেপ বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নিয়মের লঙ্ঘন। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব অর্থনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেছে। এরপর চলতি বছর জানুয়ারি থেকে পরবর্তী ৯০ দিনের জন্য কোনো রকম শুল্ক আরোপ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন ট্রাম্প ও শি জিন পিং। কিন্তু এরপর আবারো শুল্ক আরোপের ঘোষণা এসেছে। চীন জানায়, তারা এই সিদ্ধান্তে গভীরভাবে হতাশ এবং পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার বিষয় ভাবছে। দেশ দু’টির মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের মধ্যে যেমন অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে, তেমনি বিশ্ব অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু মার্কিন প্রতিষ্ঠান ও ক্রেতার জন্য শুল্ক বাড়ানোটা একটা ধাক্কার মতো বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। এশিয়ান ট্রেড সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক ডেবোরাহ এলমস বলেছেন, ‘এটা অর্থনীতিতে একটা বড় ধাক্কা দিতে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, সব মার্কিন প্রতিষ্ঠানের হঠাৎ করে ২৫ শতাংশ খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার চীনও পাল্টা ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে। তবে কেউ কেউ মনে করেন, চীন এখনো আলোচনার চেষ্টা করবে। কারণ বাণিজ্যযুদ্ধ থামানো খুবই জরুরি। পিটারসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিকসের গ্যারি হাফবাউর বলেন, বাণিজ্যযুদ্ধ চীনের অর্থনীতি ও বাণিজ্য ক্ষেত্রের জন্য ক্ষতিকর হবে। এ ছাড়া বিশ্ব অর্থনীতির জন্যও এর ফল খারাপ হবে। তাই চীনের উচিত হবে ক্ষুব্ধ না হয়ে ঠাণ্ডা মাথায় সমাধান করা।

চীনা পণ্য আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বাড়ানোর পরি প্রেক্ষিতে চীন সমুচিত পাল্টা ব্যবস্থা তাদের নিতেই হবে বলে জানায়। চীনের এই ঘোষণার প্রভাব ইতোমধ্যে আমেরিকার বাজারে পড়তে শুরু করেছে। পাল্টাপাল্টি এই ঘোষণায় যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজার ওয়াল স্ট্রিটে দরপতনের পূর্বাভাস পাওয়া গেছে। বিশেষ করে এই ঘোষণায় গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে। কোর্ড ও জেনারেল মোটরসের মতো গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম ২ শতাংশ নেমে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি চীনের সাথে তাদের যে বাণিজ্য ঘাটতি সেজন্য চীনই দায়ী। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ফার্মগুলো থেকে চীনের প্রতিষ্ঠানগুলো বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ চুরি করেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। তবে এসব বিষয় সমাধানে ট্রাম্পের নেয়া শুল্কহার বাড়ানোর যে পদক্ষেপ, তাতে দ্বিমত পোষণ করেছেন তার নিজস্ব অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ল্যারিক্যাডলো। তার মতে, এই ঢিল ছোড়াছুড়িতে উভয়পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

আমেরিকা সাবেক পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নকে পৃথিবীর রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চ থেকে যেভাবে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল মনে করছে, চীনকেও সেভাবে হটিয়ে দেবে। চীনকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন তৈরি করা যেতে পারে। কিন্তু এটা করতে হলে বিপুল অর্থনৈতিক ব্যয় সামাল দিতে হবে। ১৯৮০ এর দশকে সোভিয়েত-আমেরিকান বাণিজ্য ছিল বার্ষিক ২ বিলিয়ন বা ২০০ কোটি ডলার। আর এখন আমেরিকা ও চীনের মধ্যকার প্রতিদিনের বাণিজ্য হচ্ছে ২ বিলিয়ন বা ২০০ কোটি ডলার। চিপ মেকিং এবং ৫জি-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে কোথায় বাণিজ্য শেষ এবং জাতীয় নিরাপত্তা শুরু তা বলা কঠিন। এশিয়া এবং ইউরোপে আমেরিকার মিত্রদের ব্যবসায় বাণিজ্য চীনের সাথে বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল। চীনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চেয়ে একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থাই বেশি কার্যকর হলেও প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং দৃঢ়তার সাথে পার্টিকে নিয়ন্ত্রণ করেন এবং চীনের ক্ষমতাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু সবার পক্ষে এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে, রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটরা চীনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের তিন দশক পর একক বিশ্বব্যবস্থার কার্যকারিতাও ফুরিয়ে গেছে। চীনে আমেরিকা বহু প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি। ব্যবসায়িক বন্ধন ও লাভ পরস্পরের সম্পর্ককে সুদৃঢ় করে। পরাশক্তির প্রতিযোগিতার এই যুগে চীন ও আমেরিকার তীব্র প্রয়োজন হলো সঙ্ঘাতময় পারস্পরিক সহযোগিতায় এগিয়ে আসা।


আরো সংবাদ



premium cement