২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে বিলকিস বানুর সংগ্রাম

- ছবি : সংগৃহীত

গুজরাটে ২০০২ সালের গণহারে মুসলিম নিধনের সময় চরম বর্বরোচিত নির্যাতনের শিকার বিলকিস বানু অবশেষে ইনসাফ পেলেন বটে। ভারতের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট গুজরাট সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন, তারা যেন ক্ষতিপূরণস্বরূপ বিলকিস বানুকে ৫০ লাখ রুপি দেয়ার পাশাপাশি সরকারি চাকরি এবং তার পছন্দমাফিক একটি জমিরও ব্যবস্থা করে দেন। সুপ্রিম কোর্ট যখন এ ঐতিহাসিক রায় দিয়েছিলেন, তখন বিলকিস গুজরাটের দেবগড় ভোটকেন্দ্রে ভোট দিচ্ছিলেন। বিগত ১৭ বছর ধরে বিচারের দাবিতে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ানোর এলোমেলো সময়ে এবারই প্রথম তিনি তার ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পেলেন। বিলকিস ভোট দেয়ার পর বলেন, ‘আমার ভোট দেশের ঐক্যের জন্য। দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর আমার আস্থা আছে এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর পূর্ণরূপে আমার ভরসা আছে।’

এটা এমন এক মজলুম নিপীড়িত নারীর কথা, যাকে গুজরাটে ২০০২ সালে গণহারে মুসলিম নিধনের সময় যে অত্যাচার ও পাশবিকতার নিশানা বানানো হয়েছিল, তা বর্ণনার জন্য যথার্থ শব্দ নেই। যদি বিলকিস বানুর বদলে অন্য কেউ হতো তাহলে এ অত্যাচার ও বর্বরতায় নিষ্পেষিত হয়ে তার কলিজা ফেটে যেত এবং শেষ হয়ে যেত তার অস্তিত্ব। এ বিলকিস বানুই ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য বিরামহীন আন্দোলন করেছেন এবং অবশেষে এক জালিম ও উদ্ধত সরকারকে নত হতে বাধ্য করেছেন। তার এ সংগ্রাম আমাদের বার্তা দেয়, যদি কোনো দুর্বল ও মজলুম ব্যক্তি দৃঢ় সঙ্কল্প নিয়ে ময়দানে নেমে পড়ে তাহলে সে জালিম ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ প্রশাসনের ষড়যন্ত্রগুলোকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে।

বাস্তবতা হলো, বিলকিস বানুর সাথে যে চরম পর্যায়ের জুলুম করা হয়েছে এবং হিংস্র পশুরা তাকে যে কষ্ট ও আঘাতে জর্জরিত করেছে তা দূর করতে পঞ্চাশ লাখ রুপি দূরের কথা, ৫০ কোটিতেও হবে না। তবে বিলকিস বানু যে জালিম প্রশাসনের সাথে লড়াই করেছেন, তার কাছ থেকে ৫০ লাখ রুপি আদায় করাও এক বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, যা সুপ্রিম কোর্টের সহায়তায় পূর্ণ করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বিলকিস বিদ্বেষ ও শঙ্কার ওই পরিবেশ দূর করার জন্য আপিল করেন, যা কব্জা করে রেখেছে পুরো ভারতকে। বিলকিস বানু বলেছেন, গুজরাট দাঙ্গার পরের কয়েকটি বছর আমাকে অনেক কঠিন স্তর অতিক্রম করতে হয়েছে।

বিলকিস বানু আদালত ও সংবিধানের ওপর আস্থা প্রকাশ করে বলেন, সুপ্রিম কোর্টের রায় প্রমাণ দেয় যে, আদালত আমার ওপর হওয়া জুলুম এবং আমার আন্দোলন স্বীকার করে নিয়েছেন। বিলকিস বানু বলেন, তিনি ক্ষতিপূরণের অর্থ দিয়ে তার কন্যা সালেহার স্মরণে একটি ফান্ড গঠন করবেন, যাকে তার চোখের সামনে নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়েছিল। বিলকিস জানান, ওই সময়টা এমন ছিল যে, তিনি তার কন্যা সালেহার দাফন পর্যন্ত করতে পারেননি। এর যন্ত্রণাদায়ক স্মৃতি এখন পর্যন্ত তাকে তাড়া করে বেড়ায়। বিলকিস বানুকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘আপনি তো এ মামলায় ১১ জন আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন’, তখন তিনি বলেন, ‘আমার লড়াই কখনো প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য ছিল না, বরং লড়াই ছিল ইনসাফের জন্য।’ সরকার থেকে ক্ষতিপূরণ গ্রহণের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘তিনি একটি সৃদৃঢ় জীবন যাপন করতে চান এবং এটাও চান যে, তার স্বামী ইয়াকুব যেন চাকরি পান এবং তার সন্তান সুশিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।’

ওই সময় বিলকিস বানুর বয়স ছিল মাত্র ২১ বছর। যখন মানুষরূপী হিংস্র পশুরা তার ওপর হামলে পড়েছিল, তখন তিনি পাঁচ মাসের গর্ভবতী। ৩ মার্চ, ২০০২ সালের কথা তিনি কখনো ভুলতে পারবেন না, যেদিন তিনি পাশবিক নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য নিজের পরিবারের সাথে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে পালাচ্ছিলেন। যে ট্রাকে বিলকিস বানু ও তার পরিবারের ১৭ জন সদস্য আরোহী ছিলেন, হিংস্র নেকড়েরা তা ঘিরে ধরে এবং তাদের ওপর হামলা চালায়। তাদের মধ্যে ১৪ জনকে, যারা সবাই বিলকিস বানুর আত্মীয়, অত্যন্ত পাশবিকভাবে হত্যা করা হয়। নিহতদের মধ্যে বিলকিস বানুর তিন শিশুসন্তানসহ তার মা হালীমা ও চাচাত ভাই শামীম ছিলেন। হামলার সময় বিলকিস অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। হামলাকারীরা তাকে মৃত ভেবে ছেড়ে চলে যায়। দুই ঘণ্টা পর যখন তার হুঁশ ফিরে আসে, তখন চারদিকে সন্তান ও আত্মীয়স্বজনের লাশ দেখে আবার জ্ঞান হারান।

ভয়ার্ত বিলকিস কাছে এক পাহাড়ে পৌঁছেন, যেখানে একটি গোত্রীয় পরিবার তাকে আশ্রয় এবং তার দেহে কাপড় জড়িয়ে দেয়। এ সব কিছু আজো বিলকিসের জন্য ভয়ঙ্কর স্বপ্নের চেয়ে কম নয়। হামলার সময় বিলকিস বানুর যে কন্যা গর্ভে ছিল, সে এখন ষোল বছরের। বিলকিস তাকে আইনবিদ বানাতে চান, যাতে সে অন্যায়-অত্যাচারের শিকার হওয়া নারীদের জন্য ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা করে দিতে পারে। বিলকিস বানু সুপ্রিম কোর্টের সহায়তায় প্রাপ্য ৫০ লাখ রুপির একটি অংশ ধর্ষিত নারীদের পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যও ওয়াকফ করতে চান। তিনি অবশিষ্ট অর্থ তার চার সন্তানের শিক্ষা ও সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য ব্যয় করবেন। প্রকাশ থাকে, বিলকিস বানু গুজরাট গণহত্যার পর বিগত ১৭ বছর নিজের ও সন্তানদের নিরাপত্তার জন্য দ্বারে দ্বারে ব্যর্থ হয়ে ঘুরেছেন। আজ পর্যন্ত তিনি কোনো আশ্রয় পাননি। তিনি গুজরাট ও এর বাইরে স্থান পরিবর্তন করেই চলেছেন। আহমেদাবাদ, বরোদা, দিল্লি, লক্ষেèৗ ও মুম্বাইয়ের মানবদরদি মানুষেরা তাকে সাময়িক আশ্রয় দিয়েছেন।

সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে ৫০ লাখ রুপি ক্ষতিপূরণ বাবদ পাইয়ে দেয়ার আগে মুম্বাই হাইকোর্ট তাকে শুধু পাঁচ লাখ রুপি ক্ষতিপূরণ আদায়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন, যা গ্রহণ করতে বিলকিস বানু অস্বীকার করে। গণধর্ষণের ১৫ বছর পর ২০১৭ সালের মে মাসে এ মামলায় ১২ জন অপরাধী ও হিংস্র পশুকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় শোনানো হয়। তন্মধ্যে ওই পুলিশ ও ডাক্তারও শামিল, যারা তাদের দায়িত্বের প্রতি অপরাধমূলক অবহেলা প্রদর্শন করেছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট বিলকিস বানুর মামলায় আলামত মিটিয়ে ফেলার অপরাধে তিনজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে দুইজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তার পেনশনের অর্থ কমিয়ে দেয়া হয়েছে এবং একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে দেয়া হয়েছে পদাবনতি। চিফ জাস্টিস রঞ্জন গগৌয়ের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ তার রায়ে গুজরাট সরকারকে লক্ষ করে বলেছেন, ‘তারা নিজেদের যেন সৌভাগ্যবান মনে করে। কেননা, আমরা তাদের বিরুদ্ধে কোনো নির্দেশ দিচ্ছি না।’

নিঃসন্দেহে এ গুজরাট সরকারই বিগত ১৭ বছর ধরে গণহত্যার অপরাধীদের পদে পদে আশ্রয় দিয়েছে এবং মজলুম ব্যক্তিদের ন্যায়বিচার পেতে সব ধরনের বাধার দেয়াল তৈরি করেছে। এটা স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে প্রথম ঘটনা, নিজেরই নাগরিকের গণহত্যাকে রাজনৈতিক প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে এবং সমগ্র সরকারি সংস্থা জালিম, খুনি, ধর্ষণকারী ও হিংস্র পশুদের নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছে। গুজরাট সরকার নিজেদের অপরাধমূলক কার্যক্রমের কারণে কখনো লজ্জিত হয়নি এবং তারা অন্যায়-অবিচার থেকে সৃষ্ট এ মর্মান্তিক ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশও করেনি। এক দিকে গুজরাটের জালিম ও নির্দয় সরকার, অপর দিকে অন্যায়-অবিচারের শিকার বিলকিস বানু, আজো যার ভারতের গণতন্ত্র ও নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি পূর্ণ আস্থা। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর বিলকিস বানুর প্রতিক্রিয়া সোনালি হরফে লিখে রাখার মতো।

যারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, গণহত্যা ও গণপিটুনির মাধ্যমে মুসলমানদের মনোবল ভেঙে দিতে চায় এবং মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানাতে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছে, তাদের সার্বিকভাবে এ বাস্তবতা স্বীকার করে নেয়া উচিত যে, চূড়ান্ত পর্যায়ের নির্যাতন এবং বর্বরোচিত আচরণের পরও তারা ব্যর্থ হয়েছে মুসলমানদের মনোবল ভেঙে দিতে। তার জ্বলন্ত উদাহরণ বিলকিস বানু, যিনি একাই সব ধরনের অত্যাচার ও নির্যাতন ভোগ করা সত্ত্বেও আজো পূর্ণ সাহসিকতা ও মনোবল নিয়ে ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর আস্থা প্রকাশ করছেন। গুজরাট সরকারের অসহযোগিতা এবং ন্যায়বিচার পাওয়ার পথে ভয়ঙ্কর প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বিলকিস ন্যায়বিচার পেয়েছেন। বিলকিস বানুর এ কথাগুলো গুজরাট সরকারের ডুবে মরার জন্য যথেষ্ট, যা তিনি দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন। বিলকিস বানু বলেছেন, ‘আমার মামলা এ লজ্জাজনক বাস্তবতার সাক্ষ্য যে, রাজ্য সরকার তার জনগণের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।’ এ কথাগুলো তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি ২০০২ সালের গণহত্যার পর আহমেদাবাদ সফরে ওই সময়ের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতিতে বলেছিলেন এবং তাকে রাজধর্মের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন।

লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট

মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক উর্দু টাইমস ২৮ এপ্রিল,  ২০১৯ থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব


আরো সংবাদ



premium cement