২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ফারাক্কা লংমার্চ

ফারাক্কা - ছবি : সংগ্রহ

আজ ১৬ মে। ১৯৭৬ সালের এই দিনে মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে সারা দেশের লাখ লাখ মানুষ রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদরাসা ময়দান থেকে মরণবাঁধ ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চে অংশগ্রহণ করেছিল। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে জনদুর্ভোগের জন্য তারা ওই দিন লংমার্চ করে ভারত সরকারের কাছে প্রতিবাদ জানায়। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মহলের কাছে বিষয়টি তুলে ধরেন মওলানা ভাসানী। এ দিনটি আজো শোষণ, বৈষম্য আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে বঞ্চিতদের প্রেরণার উৎস হয়ে আছে।

১৯৬১ সালের ৩০ জানুয়ারি ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ শুরু করে বিহার-পশ্চিম বঙ্গ সীমান্তে। ১৯৭০ সালে শেষ হয় বাঁধটির গঙ্গা নদীতে নির্মাণকাজ। তখন পরীক্ষামূলকভাবে ভারত কিছু কিছু পানি ছেড়েছিল। ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির মাধ্যমে ফারাক্কা বাঁধ চালু হয় ‘পরীক্ষামূলকভাবে’। ১৯৭৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ফারাক্কা বাঁধের সব ক’টি গেট খুলে দেয় ভারত। ১৯৭৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত চাহিদানুযায়ী পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিতই রয়ে গেছে বাংলাদেশ। অথচ ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের আগে, শুষ্ক মওসুমেও পদ্মা নদী থেকে ৪০ হাজার কিউসেক পর্যন্ত পানি পেত বাংলাদেশ।

১৬ মে রাজশাহী থেকে লংমার্চ শুরু হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে গিয়ে শেষ হয়। লাখ লাখ প্রতিবাদী মানুষের ঢল নামে রাজশাহীর রাজপথে। নানা স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে জনপদ। সন্ধ্যা ৬টায় লংমার্চ চাঁপাইনবাবগঞ্জে গিয়ে সেই দিনের মতো শেষ হয়। মাঠে রাত যাপন করে, পরদিন সকাল ৮টায় আবার যাত্রা শুরু হয় শিবগঞ্জের কানসাট অভিমুখে। সীমান্তের অদূরে কানসাটে পৌঁছানোর আগে মহানন্দা নদী পার হতে হয়।

হাজার হাজার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেন সেই লংমার্চে। নিজেরাই নৌকা দিয়ে কৃত্রিম সেতু তৈরি করে নদী পার হন। কানসাট হাইস্কুল মাঠে পৌঁছানোর পর মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। তিনি ভারতের উদ্দেশে বলেন, ‘তাদের জানা উচিত বাংলার মানুষ এক আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না। কারো হুমকিকে পরোয়া করে না।’ তিনি বলেন, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও কানসাটে যে ইতিহাস শুরু হয়েছে তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করবে। মওলানা ভাসানী তখন লংমার্চের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। সেদিন ভারতীয় সীমান্তে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছিল।

ফারাক্কা বাঁধের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৯ ফুট উঁচুতে অবস্থিত রাজশাহীর গোদাগাড়ীসহ সমগ্র বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামছে। এতে অগভীর নলকূপ থেকে পানি উঠছে না। সরকারি গবেষণায় দেখা গেছে, বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রতি বছর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্থানভেদে এক-দুই ফুট পর্যন্ত নেমে যাচ্ছে। এর মধ্যে ২০১০ সালে গোদাগাড়ী এলাকায় পানির স্তর ছিল মাটির ১৯ ফুট গভীরে। ২০১১ সালে স্থানভেদে তা ২১ ফুট পর্যন্ত নেমে যায়। ২০১২ সালে ২৩ ফুট এবং ২০১৩ সালে পানির স্তর স্থানভেদে ২৩-২৫ ফুট মাটির গভীরে নেমে যায়।

চুক্তি অনুযায়ী, শুষ্ক মওসুমে ভারত বাংলাদেশকে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি প্রদান করবে। এ সময়ে ভারত বাংলাদেশকে চুক্তি অনুযায়ী পানি দিলে পদ্মায় প্রবাহ থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। চুক্তি মতে, ফারাক্কায় যে পানি জমছে তাই ভাগ করে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু গঙ্গা নদীর পুরো পানি ভাগাভাগির কথা চুক্তিতে নেই। অথচ চুক্তির পানি দিয়ে চাহিদার অর্ধেকও পূরণ করা যাচ্ছে না। যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে বিষয়টি বারবার উত্থাপন করা হলেও কাজ হয়নি। দীর্ঘ দিন ধরে ভারতের পক্ষ থেকে শুধু আশ্বাসের বাণী শোনানো হচ্ছে। ভারত চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে তার প্রাপ্য হিস্যা প্রদান করছে না। পালাক্রমে উভয় দেশের মধ্যে পানি ভাগ হয়ে থাকে। ১০ দিনের যেকোনো পালায় পানির প্রবাহ ৫০ হাজার কিউসেকের নিচে নেমে গেলে দুই দেশের সরকার জরুরি ভিত্তিতে আলোচনা করে পানি বণ্টনে সামঞ্জস্য বিধান প্রদান করে থাকে। ফারাক্কা পয়েন্টে পানিপ্রবাহ ৭৫ হাজার কিউসেকের বেশি হলে ভারত ৪০ হাজার কিউসেক পায়। প্রবাহ ৭০ হাজার কিউসেক বা তার কম হলে উভয় দেশ সমানভাবে পানি পায়। কিন্তু গঙ্গা নদীর পুরো পানির ভাগ দেয়া হচ্ছে না। অন্যান্য মাসে সমস্যা না হলেও মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে আমাদের পানি সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করে।

তাই বর্তমান সরকারের কাছে পানি চুক্তি পর্যালোচনা করার দাবি তুলেছে দেশের মানুষ। শুকনো মওসুমে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উজান ও ভাটিতে পানির স্তর নেমে যাওয়ায় পদ্মা ও সব শাখা নদীর অবস্থা এখন করুণ। বেকার হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার জেলে। বিঘ্ন ঘটছে সেচকাজে। সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে নৌপথ। পদ্মার দুই পাড়ের মানুষ আর্সেনিকসহ নানা রোগে ভুগছেন। জলবায়ুতে সূচিত হয়েছে বড় ধরনের ক্ষতিকর পরিবর্তন। বেড়ে যাচ্ছে তাপমাত্রা, বাড়ছে খরার শঙ্কা। লাখ লাখ মানুষ বহুমুখী সঙ্কটে ডুবে যাচ্ছে। পদ্মা স্বয়ংক্রিয় পরিশোধন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। ফারাক্কার প্রভাবে শুধু পাবনা জেলাতেই ২০টি নদীতে পানি নেই। এর মধ্যে বেশ কিছু নদী বিলীন হয়ে গেছে। এসব নদীতে বিভিন্ন ফসল উৎপাদন করা হচ্ছে। অনেকে নদী দখল করে বাড়ি নির্মাণ করছেন। দেখা গেছে, পদ্মা নদীর বুকে বিশাল বালুচর পড়েছে। সেখানে ফুটবল খেলা হচ্ছে, গরু-মহিষের গাড়ি চলছে। পদ্মার মূল নদী রাজশাহী শহর থেকে অনেক দূরে (প্রায় পাঁচ কিলোমিটার) সরে গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ অবস্থা চলতে থাকলে কিছু দিনের মধ্যেই দেশের বৃহৎ এ অঞ্চলটি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে এবং মরুকরণ দেখা দেবে।

চলনবিল অঞ্চলের প্রবীণ লোকেরা জানান, বিলসংলগ্ন ১৬টি ছোট নদী, ৩৯টি ছোট বিল ও ৩২টি খাল ছিল। এসব নদী ও খাল এখন শুধু স্মৃতিতে বেঁচে আছে। বাস্তবে এর বেশির ভাগের কোনো অস্তিত্ব নেই। ফারাক্কা বাঁধের পর এসব নদী ও খাল শুকিয়ে গেছে। সেখানে হচ্ছে বিভিন্ন মওসুমি ফসলের চাষাবাদ। নদী-খাল শুকিয়ে যাওয়ায় হাজার হাজার জেলে তাদের পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এই পেশায় এখনো যারা রয়ে গেছেন, তাদের দিন কাটছে খেয়ে-না খেয়ে।


আরো সংবাদ



premium cement