২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শরণার্থী সমস্যার সমাধান জরুরি

শরণার্থী সমস্যার সমাধান জরুরি - ছবি : সংগ্রহ

১৯৪৮ সালে গ্রাম থেকে ঢাকা এসে ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৩ সালের প্রথমার্ধ অবধি আমরা ওয়ারিতে ৩ নম্বর ওয়ার স্ট্রিটের একটি ভাড়া বাসায় ছিলাম। আমরাই তখন সে এলাকায় প্রথম মুসলমান পরিবার। ১৯৫০ সালের দাঙ্গার পর এলাকার হিন্দুরা কেউ বাড়ি বিক্রি করে, কেউবা বাড়ি বদল করে যে যেভাবে পারলেন ভারতে চলে গেলেন। তাদের অস্থাবর সম্পত্তি তখনকার মদন মোহন বসাক রোডে (বর্তমান টিপু সুলতান রোড) নিলামে বিক্রি হয়ে গেল। সেটা নিজে দেখেছি। তাদের স্থলে কলকাতা, বিহার, বোম্বাই থেকে মুসলমান মুহাজির পরিবারগুলো এলো। এদের কেউ কেউ চাকরিজীবী এবং কেউ কেউ এখানে এসে ব্যবসা শুরু করেন। এসব মুহাজির অভিজাত সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন।

তাদের ছেলেরা আমার খেলার সাথী হলো। এরপর আমরা বাসা বদল করে দু-তিন বাসা ঘুরে ১৯৫৫ সালের শেষের দিকে পরীবাগের রেললাইনের ধারে যে বাসায় থিতু হলাম সেখানে আমরা ১৯৭৬ সালের শেষ পর্যন্ত ছিলাম। রেললাইনটি পরে উঠে গিয়ে সোনারগাঁ রোডে রূপান্তর হয়। রেললাইন যত দিন ছিল, দেখেছি চৈত্রের খরদুপুরেও বিহার থেকে আগত মুসলমান শ্রমিকেরা রেললাইন সচল রাখার জন্য নিরলস পরিশ্রম করতেন। সারা দেশের রেল যোগাযোগব্যবস্থাই তারা সচল রেখেছিলেন। নদীপথের পরে, সড়কপথের অবর্তমানে রেলপথই তখন পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের প্রধান অবলম্বন ছিল এবং বিহারিরা ছিলেন রেলপথের প্রাণতুল্য। এ ছাড়া দেশ গড়ার আরো বিভিন্ন ধরনের কাজে তারা আন্তরিকতা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। তাদের মেয়েরাও কর্মঠ ও কষ্টসহিষ্ণু। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামের পাহাড়তলি এবং সৈয়দপুর ছাড়াও তখনকার ঢাকা শহর থেকে অদূরবর্তী মিরপুর, মোহাম্মদপুর এবং অন্যত্র কর্মস্থলে এদের পুনর্বাসন করা হয়েছিল। অন্তত পাকিস্তানের পূর্বাংশে দেশ গড়ায় কঠোর পরিশ্রমী এ লোকদের জীবন একরকম ভালোই কাটছিল।

১৯৬৯ সালের কথা। তখন করাচির পিআইডিইতে স্টাফ ইকোনমিস্ট হিসেবে আমি কর্মরত। থাকি উত্তর করাচির আল আজম স্কয়ারের একটি ফ্ল্যাটে। তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তানে গণ-আন্দোলন চলছে। এক দুপুরে সদর এলাকার কাফে জর্জে খাচ্ছি। আমার ডানদিকের সারিতে দু-চার টেবিল সামনে, জনচারেক মধ্যবয়সী লোক খাচ্ছিলেন। এদের একজন আমার সামনে এসে বসে জিজ্ঞেস করলেন,- ‘আপনি বাঙালি না’? বললাম- ‘হ্যাঁ। আপনাকে তো চিনলাম না।’ তিনি বললেন, ‘আমি বিহারি।’ বাকিদের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন- ‘আমরা ঢাকা থেকে এসেছি। আমরা সেখানে বড় বিপদে আছি।’

বললাম, ‘বিপদে আছেন মানে?’ তিনি বললেন, ‘শেখ মুজিবের লেকেরা আমাদের নির্যাতন করছে।’ আমি বললাম, ‘এখানে এসেছেন কেন?’ তিনি বললেন, ‘মুহাজির নেতাদের কাছে নালিশ করতে।’ বিরক্তির সাথে ধমকের সুরে বললাম, ‘সেখানে সরকার আছে না?’ তিনি বললেন, ‘মোনায়েম খানের সাথে দেখা করেছি। কোনো কাজ হচ্ছে না। তিনি আমাদের জন্য কিছুই করছেন না।’ বললাম, ‘ঢাকা চলে যান।’ এই বলে টেবিলবয়ের হাতে খাবারের বিল দিয়ে উঠে পড়লাম। তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বয়োজ্যেষ্ঠ এই ভদ্রলোককে সালাম জানিয়ে আমি ক্যাফে থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ঢাকায় তখন ঠিক কী হচ্ছে, জানি না। তবে শুনেছি সদর থেকে আমার এলাকায় যাওয়ার মাঝপথে জাহাঙ্গীর ইস্ট, জাহাঙ্গীর ওয়েস্ট ও লালুক্ষেত এবং পশ্চিম করাচির পাকিস্তান কোয়ার্টার প্রভৃতি বাঙালিঅধ্যুষিত এলাকাগুলোর বাঙালিদের বাড়ির দরজায় সে সময়ে খড়িমাটি দিয়ে তলোয়ার, ড্যাগার জাতীয় নানা চিত্র কারা যেন এঁকে রেখেছিল। তবে কোনো অঘটনের কথা শুনিনি। আমাদের এলাকায় এ ধরনের তেমন উৎপাত ছিল না। তবে এটাও সত্য, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে পশ্চিম পাকিস্তানের বেশ কয়েক লাখ বাঙালি বাংলাদেশকে অপশন দেননি। বর্তমানে পাকিস্তানে ২০ লাখ অবৈধ বাংলাদেশী বসবাস করছেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তাদের সন্তানদের সম্প্রতি জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

১৯৭০ সালের ২৩ অক্টোবর করাচি ছেড়ে ঢাকায় পরিবাগের বাসায় ফিরে এলাম। স্বাধীনতার অব্যবহিত আগে অবাঙালিদের ব্যাপারে বিস্তারিত জানলাম বহু দিন পর ১৯৯০-এর দশকের প্রথমার্ধে। তখন আমি কুমিল্লায়। পাকিস্তান আমল থেকে চলে আসা একটি জাতীয় দৈনিক যেটি বাসায় রাখতাম তাতে দেখলাম, শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের আগে থেকেই পাহাড়তলী, সৈয়দপুর এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলের অবাঙালিদের ওপর আওয়ামী লীগের কর্মীরা আক্রমণ করেছিল। এর সত্যতা আমরা প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সর্বাধিনায়ক, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব:) এ কে খন্দকারের বইয়েও পাই। তিনি লিখেন, ‘এদিকে মার্চে অসহযোগ আন্দোলনের সময় ঢাকাসহ সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। এ সময় যে লুটপাট শুরু হয়েছিল, তা আমি প্রত্যক্ষ করেছি। এসব লুটপাটের সঙ্গে বাঙালিরাও জড়িত ছিল। প্রতিটি সমাজেই এই ধরনের দুষ্কৃতকারীর অভাব হয় না। আমরা সবাই যে ফেরেশতা, তা তো নয়।

অবাঙালিরা নিরাপত্তাহীনতার জন্য ঢাকা ছেড়ে যখন অপেক্ষাকৃত নিরাপদ এলাকা বা পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাচ্ছিল, তখন রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তাদের সোনার গয়না, টাকাপয়সা ও মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী লুট করে নিয়ে গিয়েছিল বাঙালিরা। ... দেশের এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু সাতই মার্চ ভাষণ দেয়ার কথা ঘোষণা করেন’ (এ কে খন্দকার, ১৯৭১ ভেতরে বাইরে, ২০১৪, পৃষ্ঠা ৩০-৩১)। এ পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য পাকিস্তান প্রশাসন সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছিল, যাদের ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার জন্য ৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান ‘তোমরা আমার ভাই’ বলে অনুরোধ করেছিলেন। বাংলাদেশের অবাঙালিদের ব্যাপারে যা প্রচার হয়েছে, তা হলো স্বাধীনতা যুদ্ধকালে পাকিস্তানের পক্ষে তারা বাঙালিদের ওপর অত্যাচার করেছে। তবে পাকিস্তানের দাবি ১৯৭১ সালের যুদ্ধকালে আওয়ামী লীগের হাতে ‘৬৪ হাজার অবাঙালি ও পাকিস্তানি নিহত’ হয়েছে, যা বাংলাদেশের মতে ‘৩০ থেকে ৪০ হাজার।’ আসলে অবাঙালিরা ১৯৬৯ সালেই ভয় পেয়েছিলেন এবং সে ভয় থেকেই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তান অপশন দিয়েছেন। অদৃষ্টের কী নির্মম পরিহাস, তিন লাখের বেশি সংখ্যায় তারা তাদের উত্তরসূরিসহ বিগত ৪৮ বছর যাবৎ বাংলাদেশের নানা ক্যাম্পে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। পাকিস্তানের মতো তাদেরও বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট দেয়ার কথা বিবেচনা করা যায়।

সম্প্রতি মিয়ানমার থেকে অমানুষিকভাবে নির্যাতিত হয়ে, পথের অমানবিক কষ্ট স্বীকার করে বাংলাদেশে যত রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে, পূর্বতনদেরসহ তাদের সংখ্যা ১১ লাখের উপরে। এ কথা সহজবোধ্য যে, তারা স্বেচ্ছায় মিয়ানমার ফিরে যাবে না এবং মিয়ানমারও তাদের কোনোভাবেই ফিরিয়ে নেবে না। ১৯৭১ সালে ভারত সুপার পাওয়ার রাশিয়াকে ম্যানেজ করে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে প্রতিপক্ষ পাকিস্তানকে কাবু করে প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে পেরেছিল। সে প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর মতো বাংলাদেশের হাতে কোনো সুপার পাওয়ার ও সামরিক শক্তি নেই। জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে যেমন কাশ্মির ও ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান করা যায়নি, তেমনি রোহিঙ্গা সমস্যারও সমাধান করা যাবে বলে মনে হয় না। পশ্চিমা দেশগুলো এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে সান্ত্বনা দিতে আসে বটে, কিন্তু তাদের দিয়েও এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে না। এখন বাংলাদেশ যেমন মিয়ানমারের সাথে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা এবং বিশ্বের অপরাপর সহানুভূতিশীল দেশগুলোকে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য চেষ্টা করছে, তাতেও কাজ হবে বলে মনে হয় না। উপরন্তু ভারত প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা ও ৪০ হাজার অসমিয়াকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার পাঁয়তারা করছে। এসব সমস্যা মোকাবেলায় বাংলাদেশকে বিকল্প পদক্ষেপ নিতে হবে।

রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বাংলাদেশ যা করতে পারে তা হলো, তাদের ক্যাম্প জীবনের বন্দিদশা থেকে মুক্ত করা এবং ১৯৭১ সালে যেমন আন্তর্জাতিক সাহায্যের মাধ্যমে শরণার্থীদের পুনর্বাসন করেছিল, তা করা। এ ব্যাপারে জাতিসঙ্ঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষে হাত বাড়ানো সহজ হবে। বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময়কালে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের ছিটমহলের প্রায় সব সনাতন ধর্মাবলম্বীই ভারতে চলে গেছে যদিও ভারতীয় ছিটমহলের অনেক মুসলমান বাংলাদেশে আসেনি। এ ছাড়া স্বাধীনতার আগে এবং পরে প্রায় প্রতিনিয়তই সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ভারতে চলে যাচ্ছে। সম্প্রতি ভারত সরকার এ ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপের ফলে এ প্রবণতা কমেছে বটে, তবে বন্ধ হয়নি।

মিয়ানমার ও ভারতের সাথে সম্ভাব্য জনবিনিময় ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের সময়ের পাক-ভারতের মধ্যকার জনসংখ্যা বিনিময়ের মতো ক্রন্দনরোলের ভেতর দিয়ে হবে না, বরং সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে শান্তিপূর্ণ সমঝোতার ভিত্তিতে হতে হবে। এ ব্যাপারে জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা দেয়া সহজ ও কার্যকর হবে বলে আশা করা যায়। অবশ্য এ প্রক্রিয়ায় জনবিনিময়ের ফলে বাংলাদেশ খুব একটা লাভবান হবে না। কারণ এর পরও প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠাঁই দিতে হবে, হয়তো এটা হবে মন্দের ভালো। কারণ ভারত থেকে যদি বিপুলসংখ্যক মুসলমান বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হয়, তবে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাসহ শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়াতে পারে প্রায় ১২ লাখ। এ ভার বাংলাদেশের জন্য হবে দুর্বহ। সুতরাং জনবিনিময়ের মাধ্যমে এ সংখ্যা যদি অর্ধেকে নামিয়ে আনা যায়, লাচার বাংলাদেশের জন্য সেটাইবা কম কী!

অনেকের মতে, এভাবে বাংলাদেশে মোট শরণার্থী সংখ্যা দুই-পঞ্চমাংশ কমিয়ে আনা যায় এবং বাকিদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সম্মানজনক জীবিকা অর্জনে ও জাতি গঠনে কাজে লাগানো যায়। অধিকন্তু বাংলাদেশের শরণার্থীদের নিয়ে দেশী-বিদেশী এনজিওদের এবং দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ হওয়াও জরুরি। পাকিস্তান আমলের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, এ জাতীয় উদ্বাস্তুদের স্থানীয়দের তুলনায় কর্মঠ, দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ, সত্যনিষ্ঠ হতে দেখা গেছে। শরণার্থী সমস্যার সুরাহা সম্ভব হলে বাংলাদেশ একটি বিব্রতকর অবস্থা থেকে রেহাই পাবে এবং তাদের অবমাননাকর জীবন থেকে মুক্ত করতে পারবে। শরণার্থী সমস্যার এ সম্মানজনক, কার্যকর ও দ্রুত সমাধানের পথটি নিষ্কণ্টক হবে কি না জানি না, তবে বাংলাদেশ সরকার তা আন্তরিকভাবে ভেবে দেখতে পারে। দেখা যাচ্ছে ইতোমধ্যেই রোহিঙ্গাদের অনেকে বিপথগামী হতে শুরু করেছে। এটা মোটেও বাড়তে দেয়া যায় না।

লেখক : অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক,
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার

 


আরো সংবাদ



premium cement