১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রক্তাক্ত উপাসনালয়

রক্তাক্ত উপাসনালয় - ছবি : সংগ্রহ

মহান স্রষ্টার আরাধনার সর্বোৎকৃষ্ট স্থান উপাসনালয়। মানুষ উপাসনালয়ে হিংসা দ্বেষ, ঘৃণা ও বিভাজন ভুলে স্রষ্টার উপাসনায় লিপ্ত হয়। প্রত্যেক ধর্মের অনুসারীরা তাদের বিধিবিধান অনুসারে উপাসনালয়ে আরাধনা করে থাকেন। এর মাধ্যমে মানুষের হৃদয় কলুষমুক্ত হয়। স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসা ও মানবপ্রেম জাগ্রত হয়। এমনকি প্রকৃত ধার্মিকরা মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণিকুলকেও ভালোবেসে থাকেন।

মহানবী সা: হাদিস শরিফে প্রাণিকুলকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। সৃষ্টিকে ভালোবাসলে পরোক্ষভাবে স্রষ্টাকেই ভালোবাসা হয়। আল্লাহ পাকের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলো মানুষ। মানুষ হত্যা করে স্রষ্টার ভালোবাসা অর্জন করা সম্ভব নয়। অকারণে আল্লাহ মানুষ হত্যাকে নিষিদ্ধ করেছেন। পরস্পর যুদ্ধরত বা বিচারিক আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছাড়া সাধারণ মানুষ হত্যা করা অতীব গর্হিত কাজ।

আল্লাহ পাক তাঁর ইবাদতকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। হাক্কুল্লাহ ও হাক্কুল ইবাদ। হাক্কুল্লাহ বলতে বোঝায় যেসব ইবাদত সরাসরি আল্লাহ পাকের সাথে সম্পৃক্ত। যেমন- কালেমা, নামাজ, রোজা, হজ ইত্যাদি। অপর দিকে হাক্কুল ইবাদ বলতে বোঝায় মানবতার সেবা তথা সৃষ্টির সেবা। যথা- জাকাত, ফিতরা, দান, সদকা এবং মানবতার সেবায় নিয়োজিত সব কর্ম। মহানবী সা: সৃষ্টির সেবা শুরু করেছিলেন ১৭ বছর বয়সে হিলফুল ফুজুল নামক প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। এর মাধ্যমে তিনি মক্কার যুবশ্রেণীকে সঙ্ঘবদ্ধ করে মানবতার সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। অতঃপর তিনি চল্লিশ বছর বয়ঃক্রমকালে নবুওয়াতের দায়িত্বভার প্রাপ্তির পর কালেমার দাওয়াতের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে স্রষ্টার আনুগত্যের আহ্বান জানিয়েছিলেন। অতঃপর মানবজাতিকে সার্বিকভাবে স্রষ্টার সেবার পথনির্দেশ প্রদান করেছিলেন। সে কারণে বলা যায়, সৃষ্টির সেবা ছাড়া স্রষ্টার সেবা অচল।

বর্তমান সময়ে পৃথিবীতে মানবজাতির সভ্যতা চরমভাবে বিকশিত হয়েছে বলে আমরা দাবি করে থাকি। জ্ঞানবিজ্ঞান ও শিক্ষার প্রভূত উন্নতি হয়েছে বলে আমরা গর্ব করে থাকি। অথচ একজন সভ্য জ্ঞানী মানুষের পক্ষে কিভাবে উপাসনালয়ে স্রষ্টার উপাসনায় নিবেদিত মানুষকে আমরা হত্যা করি, তা ভেবে দেখি না। আমাদের জেনে রাখা ভালো, ধর্মীয় বিশ্বাসের মূল উৎপাটন করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নে জোসেফ স্ট্যালিন কোটি কোটি মানুষকে হত্যা করেছিলেন। চীনেও ধর্মীয় বিশ্বাসের মূল উৎপাটনের জন্য অগণিত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। অথচ ধর্মীয় বিশ্বাস বিলুপ্ত করা যায়নি। কারণ ধর্মীয় বিশ্বাস মানুষের হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত। সেখান থেকে তা উপড়ে ফেলা অসম্ভব। আমরা আরো জানি, পৃথিবীতে ধর্মান্ধতা ও ধর্মোন্মত্ততার কারণে খ্রিষ্টান ও মুসলমানের মাঝে অনেকবার ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ হয়েছে।

যে যুদ্ধগুলো পৃথিবীতে খ্রিষ্টান ধর্মের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছিল। এসব যুদ্ধে অগণিত মানুষ বিশেষত মুসলমানেরা শহীদ হয়েছিল। এসব যুদ্ধের ফলাফল ছিল শূন্য। খ্রিষ্টান বিশ্ব হজরত ঈসা বা যিশুর মানবতা বা সেবার পথ পরিত্যাগ করে শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে ধর্মের বিস্তার ঘটাতে সচেষ্ট হয়েছিল। তাদের সে উদ্দেশ্য সফল হয়নি। খ্রিষ্টান ধর্মের যে বিস্তৃতি তা মূলত সৃষ্টির সেবা বা মানবতার সেবার মাধ্যমে ঘটেছে। অনেকের মতে, ইসলামের বিজয় অস্ত্রের মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছে। বাস্তবে এ ধারণা ভুল। বিজাতীয়রা ইসলামের ওপর অপবাদ হিসেবে এ ধরনের চেতনার বিস্তার ঘটিয়েছে। মূলত ইসলাম মানবতার সেবা ও আদর্শের মাধ্যমে বিস্তার লাভ করেছে। পৃথিবীর সর্বাধিক জনসংখ্যা অধ্যুষিত মুসলিম রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়াতে মুসলিম শাসকদের পক্ষ থেকে কোনো অভিযান পরিচালিত হয়নি। অথচ সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত। ধর্মীয় আচারণবিধি পালনের মাধ্যমে মানুষের হৃদয় প্রসারিত হয়। অপর দিকে ধর্মান্ধতা বা ধর্মোন্মত্ততা মানুষের হৃদয়কে কলুষিত, সঙ্কুুচিত ও অন্ধকারাচ্ছন্নতায় ঢেকে ফেলে। এ অবস্থায় মানব হৃদয়ে ন্যায়-অন্যায়ের প্রভেদ সৃষ্টির শক্তি বিলুপ্ত হয়। তার অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, সে মনে করে আমি ধর্মীয় বিধিবিধান পালন করি আর নাই করি অন্য ধর্মাবলম্বীদের কিভাবে ক্ষতি ও ধ্বংস করা যায়। এ ধ্বংসযজ্ঞকে সে ধর্মীয় উপাসনার মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করে।
সম্প্রতি উপাসনালয়ে হত্যাকাণ্ডের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। উপাসনালয় স্রষ্টার আলয়। মানুষ সেখানে ইবাদতের মাধ্যমে আত্মার শান্তি ও তার বিকাশের জন্য গমন করে থাকে। অথচ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে নামাজরত মুসল্লিদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে তাদের হত্যা করা হয়েছে। দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার দুটি গির্জায় বোমা হামলা চালিয়ে শত শত উপাসনারত খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের হত্যা করা হয়েছে। এ ধরনের হত্যাযজ্ঞ বর্বরতার চরম বহিঃপ্রকাশ।

অনেক সময় মানুষ ব্যক্তিগত অশান্তি, পারিবারিক অশান্তি, সামাজিক নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় জুলুমের হাত থেকে রক্ষা পেতে উপাসনালয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। কারণ ধর্মীয় বিশ্বাসের অনুসারীরা মনে করে থাকেন, উপাসনালয় হলো সৃষ্টিকর্তার আলয় বা ঘর। পৃথিবীর সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ও মানসিক মুক্তি এ ঘরে ইবাদতের মাধ্যমেই লাভ করা যায়। এখন যদি সে উপাসনালয় নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে অবস্থান করে, তাহলে মানুষ আত্মার মুক্তি ও শান্তির জন্য কোথায় অবস্থান করবে? প্রকৃতপক্ষে ধর্মের অনুসারী হওয়া ভালো কিন্তু ধর্মান্ধতা খুবই খারাপ। বর্তমানে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী অনেক মানুষ ধর্মান্ধতা ও ধর্মোন্মত্ততায় আক্রান্ত হয়েছে। সে কারণে তারা ন্যায়-অন্যায়ের বিভাজন ভুলে অন্য ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়ে উপাসনারত উপাসকদের ওপর ঘৃণিত হামলা পরিচালিত করছে। এ ধরনের ঘটনা অব্যাহত থাকলে পৃথিবীতে আবারো ক্রুসেড যুদ্ধের মতো ধর্মান্ধতার যুদ্ধের বিকাশ ঘটবে, যা কারো জন্য শুভ নয়। এখনই শুভ বুদ্ধি ও বিবেকবান মানুষদের এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। অপরকে সচেতন করতে হবে।

হাদিস শরিফে বর্ণিত মহানবী সা: মোয়াজ রা:কে ইয়েমেনের গভর্নর হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন। মহানবী সা: মোয়াজ রা:কে অন্য ধর্মের উপাসনালয়ের ক্ষতিসাধন করা ও উপাসনালয়ের উপাসকদের হত্যা ও নারী, শিশু হত্যা করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছিলেন। হজরত ওমর রা: তার খিলাফতকালে ফিলিস্তিনে গিয়ে খ্রিষ্টানদের গির্জায় নামাজ আদায় করেছিলেন। সে কারণে বলা যায়, ইসলাম অন্য ধর্মের উপরে সহিংসতায় বিশ্বাসী নয়। বরং সহাবস্থানে বিশ্বাসী।

 


আরো সংবাদ



premium cement