এই প্রবণতা বৃদ্ধির দায় কার
- মো: তোফাজ্জল বিন আমীন
- ০৩ মে ২০১৯, ১৯:৫৭
আমরা কঠিন এক অবস্থার ভেতরে বসবাস করছি। যেখানে প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এক-একটি দিন পার করতে হচ্ছে। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলেই ধর্ষণের খবর পাওয়া যায়। নারীরা ঘরে-বাইরে, সমাজে, কর্মক্ষেত্রে, স্কুল-কলেজে এবং বিশ্ববিদ্যালয়সহ কোথাও নিরাপদ নয়। তিন বছরের শিশু থেকে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, গৃহবধূ এবং বৃদ্ধা কেউ ধর্ষণের বিভীষিকা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। ৮ মার্চ নারী দিবস পালিত হলেও নারীরা কোথাও নিরাপদ নন। এই নিরাপত্তাহীনতার অবসান হওয়া জরুরি।
রাজনৈতিক স্লোগানে নারীর স্বাধীনতার কথা বলা হলেও ভিন্ন মতের প্রতীকে ভোট দেয়ার অপরাধে যে দেশে নারী গণধর্ষণের শিকার হয় সে দেশে নারীর নিরাপত্তা কতটুকু বিরাজ করছে তা সহজে অনুমেয়। শরীরের একই জায়গা বারবার কেটে গেলে চামড়া মোটা হয়ে যায় তখন অনুভূতি আর কাজ করে না। আমাদের অবস্থাও তাই হয়েছে। প্রতিনিয়ত গুম, খুন, অপহরণ আর ধর্ষণের বীভৎসতার ছবি দেখে তা সয়ে যাওয়া অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সাকিব আল হাসানের সেঞ্চুরি কিংবা শাকিব খানের বিয়ের বিষয় নিয়ে এ সমাজ ও রাষ্ট্রে যতটা তোলপাড় হয়, ধর্ষিতা নারীর জীবন নিয়ে এতটা তোলপাড় হয় না।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ছিলেন বিখ্যাত কবি, গীতিকার ও নাট্যকার। অনেকের কাছে ডি এল রায় হিসেবে পরিচিত। তার একটি দেশাত্মবোধক গান- ‘ধন ধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা... এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’! এই গানটির কথা বারবার মনে পড়ছে। সত্যিই তো এমন দেশ কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না- যেখানে গুম, খুন, অপহরণ ও ধর্ষণের সিরিজ সমানতালে চলে। দেশের মানুষেরা অন্ধকারের অমাবস্যার রাতে চাঁদের আলো খুঁজতে গিয়ে কখনো আগুনে পুড়ে, কখনো ভিন্ন মতের প্রতীকে ভোট দেয়ার কারণে গণধর্ষিত হচ্ছে।
তবু থামছে না নারীর প্রতি নিষ্ঠুরতা। ধর্ষিতা নারীর জীবনে উন্নয়নের অগ্রযাত্রার প্রয়োজন নেই। কারণ উন্নয়নের প্রদীপের নিচে বিদঘুটে অন্ধকার। ধর্ষণ সংক্রামক জীবাণুর মতো ছড়িয়ে পড়ছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। মানুষ গড়ার কারিগর যাদের বলা হয়, তারাই যদি যৌনতার লালসায় নারীর ওপর হিংস্র হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েন- তাহলে নারীরা যাবে কোথায়? প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকের কথা না হয় বাদই দিলাম, যখন দেখি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের এক শ্রেণীর শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌনতার অভিযোগ উঠছে, তখন সত্যিই মনে দাগ কাটে।
নৈতিক স্খলনের অভিযোগে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং সিলেট শাহজালাল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নৈতিক স্খলনের অভিযোগ গণমাধ্যমে মুদ্রিত হয়েছে। দেশের গণমাধ্যমে ধর্ষণের যে সংখ্যা প্রকাশিত হচ্ছে তা সঠিক চিত্র নয়। ধর্ষণের প্রকৃত চিত্র এর চেয়ে আরো ভয়াবহ। আমরা যদি কয়েক বছরের সংবাদপত্রের আলোচিত কিছু প্রকাশিত খবর দেখি তাহলে পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুধাবন করতে পারব।
দেশের মানুষের প্রার্থনা ও চিকিৎসকদের প্রাণান্তকর চেষ্টার পরও ফেনীর অগ্নিদগ্ধ শিক্ষার্থী নুসরাত জাহানকে আমরা বাঁচাতে পারলাম না। নুসরাত যখন মৃত্যুর প্রহর গুনছে, তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার এক স্কুলছাত্রীকে রাতভর গণধর্ষণ করে চলন্ত অটোরিকশা থেকে রাস্তায় ফেলে চলে যায় ধর্ষক ও তার সহযোগীরা। বিচারহীনতার কারণেই শ্রীপুরের কর্ণপুর সিটপাড়া গ্রামের হজরত আলী ও তার মেয়ে আয়েশা আক্তার ধর্ষণের বিচার না পেয়ে শ্রীপুর রেলস্টেশনের দক্ষিণ পাশে তিস্তা এক্সপ্রেস ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। তার এই মৃত্যু সমাজ ও রাষ্ট্রের বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে দিলেও ধর্ষণ থামেনি।
গত ২৫ আগস্ট ২০১৭ বগুড়া থেকে ময়মনসিংহের যাওয়ার পথে ছোঁয়া পরিবহনের একটি বাসে টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসে গণধর্ষণের শিকার হন জাকিয়া সুলতানা রূপা। ধর্ষণের পর ঘাতকেরা রূপাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বনানীর রেইনট্রি হোটেলে সংঘটিত ধর্ষণের ঘটনা ও বগুড়ার তুফান সরকারের ধর্ষণের ঘটনা কারো অজানা নয়। এমনকি চাপাতি বদরুলের হিংস্রতার শিকার খাদিজার কথা আজো লোকমুখে শোনা যায়। ২০১৬ সালের ৩ অক্টোবর সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ ক্যাম্পাসে খাদিজা নামের এক ছাত্রীকে চাপাতি দিয়ে পাশবিকভাবে জখম করে বদরুল। ১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট দিনাজপুরে পুলিশ কর্তৃক ইয়াসমিন ধর্ষণের শিকার হয়।
ধর্ষণ-পরবর্তী সময়ে হত্যার অপরাধে পুলিশের বিচার হলেও আজো বহু নারী-শিশু গণধর্ষণের শিকার। ২০১৭ সালের ২ এপ্রিল গৌরীপুর থানার ব্যারাকে নিজ কক্ষে শরীরে আগুন দিয়ে আত্মাহুতি দেন কনস্টেবল হালিমা। ঘটনাটির লুকায়িত রহস্য ২৫ এপ্রিল সব জাতীয় দৈনিকে মুদ্রিত হয়েছে। যার সারমর্ম হচ্ছে, ‘আমার মরে যাওয়ার একমাত্র কারণ এসআই মিজানুর আমাকে ধর্ষণ করে। ১৭/০৩/১৭ ইং রাত ২.০০ ঘটিকায়। অথচ আমার অভিযোগ অফিসার ইনচার্জ (ওসি) গ্রহণ করেনি। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়। ২০১৫ সালের ২১ মে কুড়িল বিশ্বরোডে পাঁচ নরপশু এক গারো তরুণীকে মাইক্রোবাসে তুলে গণধর্ষণ করে রাস্তায় ফেলে দিয়ে যায়।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেয়া পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে গত ১৯ জানুয়ারি প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে তিন হাজার ৫৮৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৭৮ জনকে। এর মধ্যে ৮৬ শতাংশই শিশু ও কিশোর। ৬ থেকে ১২ বছরের মেয়েরা সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের জরিপ ও পুলিশ সদর দফতরের হিসাবে সেই একই সময়ে ধর্ষণসংক্রান্ত মামলা হয়েছে ১৯ হাজারের বেশি। গড়ে প্রতিদিন ১১টি মামলা হচ্ছে। কিন্তু মামলার নিষ্পত্তির হার অত্যন্ত কম। ২০১৮ সালে সারা দেশে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ৭৩২ জন, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার ৬৩ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে সাতজন।
ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে ধর্ষণের যে রুট রয়েছে তা বন্ধ করতে হবে। একটা সময় তো আমাদের পারিবারিক বন্ধনে মিলনমেলার সুবাতাস বইত। এখন আর তেমনটা দেখা যায় না। পারিবারিক বন্ধন ভেঙে গেছে। পরকীয়া এখন ওপেনসিক্রেটে পরিণত হয়েছে। ধর্ষণ প্রতিরোধে অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, অশ্লীল ছায়াছবি, অশ্লীল গান, অশ্লীল বিজ্ঞাপন, অশ্লীল নাটক, পর্নোসাহিত্য, ইন্টারনেট পর্নোগ্রাফি, অশ্লীল বই, অশালীন পোশাক ও তরুণ-তরুণীর অবাধ মেলামেশার অবৈধ রুটকে রুদ্ধ করতে পারলে ধর্ষণের সেঞ্চুরি শূন্যের কোঠায় না এলেও সেঞ্চুরি আর হবে না।
ভারত-মিয়ানমার থেকে আসা যৌন উত্তেজক ইয়াবা ও অন্যান্য মাদকসামগ্রী কঠোর হস্তে বন্ধ করতে হবে। ‘কুরআনের সূরা আন নূর ২ নম্বর আয়াতে জেনার শাস্তি কী হবে তা উল্লেখ করা হয়েছে, ব্যভিচারিণী নারী ও ব্যভিচারী পুরুষ; তাদের প্রত্যেককে এক শ’ করে বেত্রাঘাত কর। আল্লাহর বিধান কার্যকর করতে তাদের প্রতি যেন তোমাদের মনে দয়ার উদ্রেক না হয়, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক।
সূরা বনি ইসরাইলের ৩২ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমরা যেনার ধারে কাছেও যেও না, নিঃসন্দেহে এটি হচ্ছে একটি অশ্লীল কাজ এবং নিকৃষ্ট পথ।’ কুরআনের এ বিধান সমাজ ও রাষ্ট্রে কার্যকর করার মধ্য দিয়ে যৌন নির্যাতন বন্ধ করা সম্ভব। বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের ঘটনা আগেও ছিল এবং ভবিষ্যতেও হয়তো তা পরিপূর্ণভাবে দূর করা কতটুকু সম্ভব হবে তা আমার বোধগম্য নয়। তবে ধর্ষণের বীভৎসতার ক্ষত জাতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড় করিয়েছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য যেমন সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন, তেমনি ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিষয়টি রাষ্ট্রের নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আশা করব, সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা