২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শিক্ষার মূল ভিত্তি দুর্বল কেন

- সংগৃহীত

সুশিক্ষার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সুপ্ত সুকুমার বৃত্তির বিকাশ ঘটে, জ্ঞানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি-আচার-আচরণে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে, মানুষের মধ্যে উন্নততর নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ বিকাশিত হয়, আধ্যাত্মিকতার উন্মেষ ঘটে, মানুষের দক্ষতা ও সক্ষমতা সৃষ্টি হয়, ফলে মানুষ সৎ চরিত্রবান ও নীতি-নৈতিকতার ধারক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে এবং মানুষ মানব সম্পদে পরিণত হয়। শিক্ষার্জনের মাধ্যমে একজন মানুষ সমাজের একজন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ পায় এবং মানুষ প্রকৃত মানুষে পরিণত হয়।

প্রাথমিক বিদ্যালয় হলো শিক্ষার ভিত্তি। এই ভিত যত মজবুত এবং নৈতিক গুণাবলি, মানবিক গুণাবলিসহ আদর্শিক হবে, শিক্ষার মানও ততই শক্তিশালী ও উন্নত হবে। শিক্ষা সুযোগ নয়, অধিকার। রাষ্ট্র শিশুদের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সুশিক্ষা নিশ্চিত করবে, এটি রাষ্ট্রে অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।

একটি শিশু যেমন তার মায়ের কাছ থেকে যে ভাষা শেখে, তার জীবনে কথায়-কাজে সেই ভাষাই প্রভাব বিস্তার লাভ করে, ঠিক তেমনি একটি শিশু যখন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে যে জ্ঞান বা শিক্ষা লাভ করে, পরবর্তী জীবনে সেই শিক্ষার প্রভাব ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের ওপর পড়ে।

১৬ কোটি মানুষের এ দেশে সবচেয়ে হতাশা এবং ক্ষোভের ক্ষেত্র হচ্ছে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা। বর্তমানে শিক্ষার বিষয়বস্তু সামগ্রিকভাবে একজন সৎ, যোগ্য, সামাজিক ও মানবিক গুণে গুণান্বিত মানুষ সৃষ্টি করতে যখন ব্যর্থ হচ্ছে, তখন সবার মনে আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন জাগবেই। নানা অনিয়ম ও অস্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে। ফলে আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়েছে। ভবিষ্যৎ শিশুদের নিয়ে তাদের অভিভাবকেরা গভীর উদ্বিগ্ন।

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে। রিপোর্টে প্রাথমিক শিক্ষার মান নিয়ে গভীর উদ্বেগ রয়েছে। এতে বলা হয় পঞ্চম শ্রেণীতে গণিতে পাস ২৫ শতাংশ এবং তৃতীয় শ্রেণীতে বাংলা পড়তে পারে ৩৫ শতাংশ। সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশ তার সব শিশুকে প্রাথমিক স্কুলে নিয়ে আসতে সক্ষম হলেও শিক্ষার গুণগতমান এখন গভীর উদ্বেগের পর্যায়ে রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান না থাকায় পরবর্তীকালে চাকরি ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে। ওই সমস্যাটি সমাধানের জন্য তিনটি পরামর্শ প্রদান করা হয়। সরকারি-পর্যায়ের দায়িত্বশীলরাও তখন উপস্থিত ছিলেন।

শিক্ষার শুরু থেকেই সব ধর্মের ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। এতে কোমলমতি শিশুরা ধর্মীয় শিক্ষার আলোকে সৎ, যোগ্য ও মানবিক গুণাবলি অধিকারী হতে পারে। যাও ছিটেফোঁটা ধর্মীয় শিক্ষা শুরুতে ছিল তাও পর্যায় ক্রমে তুলে দেয়া হচ্ছে। ২০১৯ সালে প্রাথমিক শিক্ষার যে বেহাল দশা, তা থেকে উত্তরণ করতে হলে শিশু শ্রেণী থেকে সব শ্রেণীতে ধর্মীয় শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

ধর্মীয় শিক্ষা হচ্ছে যেখানে শিশুদের মনের বিশুদ্ধ চিন্তার বিকাশ ঘটে এবং একজন শিশু ভবিষ্যৎ জীবনে নীতি নৈতিকতার মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। সব ধর্মই মানুষকে খারাপ ও অন্যায় কাজ পরিহার করার কথা বলে থাকে।

একটি শিশু যখন প্রাথমিকভাবে এ শিক্ষা অর্জন করে থাকে তখন ভবিষ্যৎ জীবন আলোকিত হয়। এর আগে প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে যতটুকু ধর্মীয় শিক্ষা ছিল তার সাথে আরো যোগ না করে বর্তমানে ধর্মীয় শিক্ষা প্রায় বাদ দেয়া হয়েছে। ফলে ছাত্ররা অন্যায় ও অপকর্মের দিকে ধাবিত হচ্ছে। শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিয়ে অভিভাবকসহ সব মহল আজ হতাশ। শিশু শ্রেণী থেকেই সব ধর্মীয় শিক্ষা শুরু করতে হবে। প্রয়োজন মোতাবেক সব শ্রেণীতে ধর্মীয় শিক্ষা চালু করতে হবে।

প্রাথমিক শিক্ষা বেহাল দশার আরো একটি কারণ হচ্ছে- যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ না দেয়া। বরং অসৎ উপায়ে নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে অদক্ষ ও নিম্নমানের শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। যার ফলে কোমলমতি শিশুরা প্রকৃত শিক্ষা থেকে ব্যাপকভাবে বঞ্চিত হচ্ছে। ভবিষ্যৎ জীবন তাদের প্রকৃত শিক্ষার আলো থেকে অন্ধকার জগতের দিকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

নৈতিকতার মান এমনভাবে নিচে নেমে গেছে যেন মনে হয়, মিথ্যাই সত্য আর সত্যই মিথ্যায় পরিণত হচ্ছে, যা জাতির জন্য কলঙ্কজনক। তাই মনে হয়, সত্য দুর্বল, আর মিথ্যা কেবল শক্তিশালী হচ্ছে। কবি বলেছিলেন, ‘সত্য সমাগত, মিথ্যা বিতাড়িত’ বর্তমানে তা যেন অবাস্তব পরিণত হচ্ছে।

এ আধুনিকতার বিকাশের যুগে প্রাথমিক শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অথচ একটি জরিপে দেখা গেছে যারা নিবন্ধিত সরকারি এবং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে, আর যারা অন্যান্য প্রাইভেট স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করে, তাদের গুণগত মানের অবস্থা সমান না। বলা চলে, যারা প্রাইভেট স্কুল, কিন্ডারগার্টেন ও ইংরেজি ভার্সন থেকে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করে, তারা বেশি মেধাবী ও সব ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে। এ অসম অবস্থার পরিবর্তন অপরিহার্য।

প্রাথমিক শিক্ষাকে আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগী করতে হবে। দেখা যায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের শিক্ষার জন্য অনেক পুরনো শিক্ষা সরঞ্জাম ও পুরাতন সিলেবাস ও কারিকুলামের মাধ্যমে পাঠদান করা হয়ে থাকে। বর্তমানে মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে ও আধুনিক শিক্ষা সরঞ্জামাদির মাধ্যমে প্রথমিক শিক্ষাকে ঢেলে সাজাতে হবে। দেখা গেছে, প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারি বাজেট কম, আর যতটুকু বরাদ্দ হয় তা দুর্নীতির দরুন যথাযথ ব্যবহার হয় না। তা ছাড়া এখন অনেক শিক্ষক মানবেতর জীবনযাপন করছেন, তারা যে বেতন পান তা দিয়ে তাদের সংসার চালানো কঠিন। এ কারণে তাদের আয়ের বিকল্প ব্যবস্থা করতে হয়।

শিক্ষা ক্ষেত্রে তাদের যথাযথ মেধা খাটাতে পারে না। প্রাথমিক শিক্ষার সবপর্যায়ে সরকারিভাবে বাজেট বাড়াতে হবে এবং বাজেটের সঠিক ব্যবহার করতে হবে। শিক্ষা বাজেটে যেন দুর্নীতি স্থান না পায়।
প্রাথমিক বিদ্যালয় নিয়ে যেসব কারণে জাতি আজ গভীর সংশয়ের মুখে, তার মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে- অর্ধশিক্ষিত ও অযোগ্য শিক্ষক এবং দলীয়ভাবে ম্যানেজিং কমিটি নিয়োগ দেয়া।

অভিভাবকসহ সুশীলসমাজ এ ব্যাপারে একমত। তাদের মতে, বিদ্যালয় পরিচালনা করার জন্য দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের সৎ, যোগ্য এবং শিক্ষার একটি ন্যূনতম যোগ্যতা থাকতে হবে এবং বিদ্যালয়ের গুণগতমান ধরে রাখার জন্য কার্যকর নিয়মাবলি থাকবে, যা প্রাথমিক শিক্ষাকে আরো উন্নত করবে।

তাই দুর্বল ও অনৈতিক শিক্ষাকে বাদ দিতে হবে। তাহলে প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে সৎ, যোগ্য, মানবিক গুণে গুণান্বিত ছাত্রছাত্রী গড়ে উঠতে পারবে। তার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় পাঠ্যসূচি, শিক্ষকমণ্ডলী, অভিভাবক ও ছাত্রছাত্রীদের কতকগুলো বাস্তবসম্মত শিক্ষা কর্মসূচি গ্রহণ করা জরুরি। ১. আদর্শিক বিষয় সম্মিলিত পাঠ্যবই সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা। ২. ছাত্রছাত্রীদের যার যার ধর্মীয় শিক্ষা মানসম্মতভাবে পাঠ্যসূচিতে থাকা। ৩. উচ্চশিক্ষিত, যোগ্য ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগ। ৪. শিক্ষকদের আলাদা ব্যবস্থাপনায় বেতন প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করা।

৫. শিক্ষকেরা মানসম্মত শিক্ষা দিতে পারছেন কি না, তা দেখার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। ৬. প্রাথমিক শিক্ষা থেকেই বাংলা, আরবি ও ইংরেজি ভাষায় শিক্ষা লাভ করার ব্যবস্থা। ৭. শিক্ষার ঘর, বইসহ উপায় ও উপকরণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা। ৮. প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা বিভিন্ন স্তর থেকে পরিবর্তন করে এক স্তরে আনা। ৯ . শিক্ষার জন্য অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো এবং নতুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৈরি করা। ১০. এনজিওদের প্রাথমিক শিক্ষার মনিটরিংসহ সব দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করা। পরিশেষে বলা যায়, প্রাথমিক শিক্ষার দুরবস্থা দূর করতে আমাদের উচিত এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

লেখক : সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

দেখুন:

আরো সংবাদ



premium cement