২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

মালদ্বীপে গণতন্ত্রের সুবাতাস

- ছবি : সংগৃহীত

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর দ্বীপ দেশ মালদ্বীপে সম্প্রতি পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এই নির্বাচনে বিদেশে নির্বাসিত সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদের দল মালদ্বীপিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্ট (এমডিপি) জয়লাভ করেছে। দলটি মালদ্বীপের পার্লামেন্ট ‘মজলিসে’ দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে জয়লাভ করেছে। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এমডিপির এই জয়লাভের মাধ্যমে দেশটির ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে দলটির শক্তি সুসংহত হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি মালদ্বীপের রাজনীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন।

আমরা গত বছরের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও মালদ্বীপিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এমডিপি) নেতা ইব্রাহিম মোহাম্মদ সোলিহকে জয়লাভ করতে দেখেছি। মোহাম্মদ সোলিহ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে দেশটিতে সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিনের পাঁচ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান হয়। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর পার্লামেন্ট নির্বাচনেও এমডিপির জয়লাভের মাধ্যমে কি দেশটিতে গণতন্ত্রের পথ সুগম হবে?

২০১৩ সাল থেকে মালদ্বীপে আবদুল্লাহ ইয়ামিনের শাসনামলে দেশটির নতুন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়, সিভিল লিবার্টি বা বেসামরিক লোকদের বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতাকে পদে পদে বাধাগ্রস্ত করা হয়। মিডিয়া তথা সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ এবং উগ্রবাদীদের উৎসাহিত করা হয়। কর্তৃত্ববাদী শাসনের কবলে দেশবাসী হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

নির্বাচনে পরাজিত হয়ে কর্তৃত্ববাদী শাসক আবদুল্লাহ ইয়ামিনের রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে বিদায় এবং পার্লামেন্ট নির্বাচনে জয়লাভের পর সাবেক প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ নাশিদের নির্বাসন থেকে দেশে ফেরার মধ্য দিয়ে দেশটিতে পুনরায় গণতন্ত্রের সুবাতাস বইতে শুরু করেছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন। মুহাম্মদ নাশিদের প্রবাস থেকে দেশে ফেরা এবং পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিজয়- কাকতালীয়ভাবে একই সময়ে ঘটেছে। নাশিদে দ্রুত দেশটিকে সংস্কার সাধনের মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান। ধারণা করা হচ্ছে, মুহাম্মদ নাশিদ শিগগিরই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবেন। মুহাম্মদ নাশিদ বর্তমান সংবিধান সংশোধন করে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন করে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চান বলে জানা গেছে।

পার্লামেন্ট নির্বাচনে এমডিপি যেহেতু দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে, সেহেতু সহজেই তারা সংবিধান সংশোধন করতে পারবে। নির্বাহী বিভাগ এবং আইন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার জন্য এই সংশোধনী আনা হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু বিশ্লেষকেরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, খুব দ্রুত সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া ঠিক হবে না। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এমডিপির ১৯ দফা কর্মসূচিতে কত সম্পদের মালিক- তার ঘোষণা প্রদান, আয়কর চালু করা এবং ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ এবং বেকারত্বভাতা চালু করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। এরপর বিচার বিভাগের সংস্কারের ইস্যুও রয়েছে।

মালদ্বীপকে নিয়ে বাইরের শক্তির রাজনীতি ও সক্রিয় রয়েছে। নতুন অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীন ও আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারতের সরাসরি প্রভাব রয়েছে মালদ্বীপে। আব্দুল্লাহ ইয়ামিনের শাসনামলে চীন অর্থনৈতিক বিনিয়োগ ও সুবিধাদানের মাধ্যমে মালদ্বীপের রাজনীতিতে সরাসরি জড়িয়ে পড়ে। দুই বছর আগে চীনের সাথে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে চীন মালদ্বীপকে ঘিরে বিভিন্ন মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করা শুরু করে। রাজধানী মালি এবং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মধ্যে একটি সেতু নির্মাণ এবং গৃহনির্মাণের চুক্তির মাধ্যমে চীন মালদ্বীপকেও তার ঋণের আওতায় নিয়ে আসে। চীনের কাছে মালদ্বীপের ঋণ প্রায় তিন শ’ কোটি ডলারে ছাড়িয়ে গেছে। দ্বীপ রাষ্ট্রটির মতো ছোট্ট একটি দেশের জন্য এটি অবাস্তব। মালদ্বীপের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হলো পর্যটন শিল্প।

মালদ্বীপের রাজনৈতিক পরিবর্তনে শুভেচ্ছা জানাতে ভোলেননি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আবদুল্লাহ ইয়ামিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত হলে ভারত দ্রুত নতুন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহীম মুহাম্মদ সোলিহকে অভিনন্দন জানান। গত বছরের নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট সোলিহর দায়িত্ব গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য মোদি মালদ্বীপ সফর করেন। সেটি ছিল গত পাঁচ বছরের মধ্যে নরেন্দ্র মোদির প্রথম মালদ্বীপ সফর। তার ওই সফরের আগে মোদি মালদ্বীপ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অন্যসব দেশ সফর করেন।

এরপর গত ডিসেম্বরে মালদ্বীপের নতুন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহীম সোলিহ ভারত সফর করেন। এরপর চলতি বছরের মার্চে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ মালদ্বীপ সফর করেন। ভারত মালদ্বীপের সহায়তায় হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। সুষমা স্বরাজের সফরের সময় ভারত ১৪০ কোটি মার্কিন ডলারের একটি আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করে। মালদ্বীপের পার্লামেন্ট নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর মোদি দ্রুত গত ৮ এপ্রিল সোলিহ ও মুহাম্মদ নাশিদের সাথে কথা বলেন এবং ‘প্রতিবেশী প্রথম’- এই নীতির আলোকে মালদ্বীপের স্বার্থে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। মোদি মালদ্বীপের আর্থসামাজিক উন্নয়নে পাশে থাকার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।

মালদ্বীপের নতুন সরকার দেশটিকে রাতারাতি সংস্কার ও পরিবর্তন আনতে পারবে বলে আমরা মনে করি না। তবে ধীরে ধীরে তাদের আঞ্চলিক রাজনীতিতে যে পরিবর্তনের সূচনা হবে- তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মালদ্বীপ চাইলেও দেশটির মারাত্মক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে পারবে না। সোলিহ সরকার চীনের প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যেকোনো বড় ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করলে সেটি ভারতের অনুকূলে ষড়যন্ত্র হিসেবে বিবেচিত হবে এবং কোনো কোনো পক্ষ এটিকে দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে পাল্টাব্যবস্থা হিসেবে চিহ্নিত করবে। এ ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কা হচ্ছে একটি উদাহরণ।

দেশটিতে সরকার পরিবর্তিত হওয়া সত্ত্বেও চীনের প্রভাব ও গুরুত্বকে কমানো যায়নি। কারণ চীনের হামবানটোটা সমুদ্রবন্দরের জন্য চীনের কাছ থেকে শ্রীলঙ্কা যে ঋণ নিয়েছে তা পরিশোধ করার সামর্থ্য বা সক্ষমতা শ্রীলঙ্কার নেই। মালদ্বীপসহ দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের জন্য চীন তার অর্থনৈতিক শক্তিকে ব্যবহার করবে। এর মাধ্যমে চীন প্রতিবেশীদের ওপর থেকে ভারতের প্রাধান্য বা প্রভাবও হ্রাস করার প্রচেষ্টা চালাবে। মালদ্বীপের নতুন প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও নতুন নির্বাহী কর্তৃপক্ষ নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় চীনের সাথে ভবিষ্যতে কোন ধরনের সম্পর্ক বজায় রাখবে ভারত আগ্রহ সহকারে তা পর্যবেক্ষণ করছে।


আরো সংবাদ



premium cement