১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অবরুদ্ধ গাজার ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা

- ছবি : সংগৃহীত

গাজায় বহু বছর ধরে অবরোধ ও ইসরাইলি হামলার পুনরাবৃত্তির ঘটনার ভয়াবহ মানসিক প্রভাব রয়েছে। ফিলিস্তিনি কবি মাহমুদ দারবিশ একবার লিখেছিলেন, বিশ্বের অবহেলিত অংশে আমাদের বসবাস। ফিলিস্তিন সম্পূর্ণরূপে ভুলে যায় না। আমরা সত্যকে সামনে আনতে সংগ্রাম করি। আমরা আজকে আমাদের জন্য। কিন্তু আগামীকাল প্রজন্মের জন্য। চিরকালের জন্য আমরা নিরাপদ থাকার আশা করি। আমরা যারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছি টুকরা টুকরা হয়ে, প্রতিদিন লড়াই করি।

গাজা হচ্ছে ফিলিস্তিন-অধ্যুষিত এমন একটি এলাকা, যা পশ্চিম তীর থেকে বিচ্ছিন্ন। এলাকাটি ৪১ কিলোমিটার বা ২৫ মাইল দীর্ঘ এবং ১০ কিলোমিটার চওড়া। একদিকে ভূমধ্যসাগর, তিন দিকে ইসরাইল ও দক্ষিণ দিকে মিসরের সিনাই সীমান্ত।

এলাকাটি কড়া প্রহরাধীন এবং অত্যন্ত ঝুঁঁকিপূর্ণ হিসেবে কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা। শ’খানেক বর্গমাইল আয়তনের ওই ছোট এলাকায় বাস করে প্রায় ১৯ লাখ ফিলিস্তিনি। তারা বেশির ভাগই ১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার সময় বাড়ি ছেড়ে পালানো বা উচ্ছেদ হওয়া ফিলিস্তিনিদের বংশধর। অনেকেই এখনো বাস করেন শরণার্থী শিবিরে। তারা এখনো স্বপ্ন দেখেন নিজের হারানো বসতভূমি যা এখন ইসরাইলে, সেখানে ফিরে যাওয়ার। তারা বলেন, গাজা হচ্ছে পৃথিবীর বৃহত্তম উন্মুক্ত কারাগার।

গাজায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে সাড়ে পাঁচ হাজার লোক। আগামী দুই বছরে তা ছয় হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। এখানে মানুষের মধ্যে ব্যাপক দারিদ্র্য, বেকারত্ব, কঠোর সীমান্ত প্রহরা আর চেক পয়েন্ট পেরিয়ে বাইরে যাওয়ার সুযোগ খুবই সীমিত। গাজার ভেতর থেকে ইসরাইলে রকেট হামলার জবাবে কয়েকবার এখানে অভিযান চালায় ইসরাইল। প্রতিবারই ব্যাপক সংখ্যক বেসামরিক লোকের মৃত্যু হয়। সীমান্ত নিরাপত্তা লঙ্ঘনের কোনো রকম চেষ্টাকে ইসরাইল তার প্রতি সরাসরি হুমকি বলে মনে করে।

চিকিৎসার জন্য এখানকার লোকদের আগে মিসরে বা ইসরাইলের ভেতরে যাওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু তা এখন সীমান্তে কড়াকড়ির জন্য ব্যাপকভাবে কমে গেছে। ওষুধ বা ডায়ালাইসিস মেশিনের মতো চিকিৎসা যন্ত্রপাতিও এখন গাজায় আসা মুশকিল। বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাবে তিনটি হাসপাতাল এবং ১০টি মেডিক্যাল সেন্টার তাদের সেবা স্থগিত করে দিয়েছে বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য বিভাগ।

গাজার লোকেরা কিছু খাদ্য সাহায্য পায়, কিন্তু তা সত্ত্বেও এখানে পাঁচ লাখের বেশি লোক মাঝারি থেকে তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। আবাসনের ঘাটতিও প্রকট। ইসরাইল ঘোষিত সীমান্ত সংলগ্ন প্রায় এক মাইলের বাফার জোনে ফিলিস্তিনিরা চাষবাস করতে পারেন না। সমুদ্র তীর থেকে একটা নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে গাজার মৎস্যজীবীরা মাছ ধরতেও পারেন না। গাজা থেকে রকেট হামলা হলেই ইসরাইল ওই মাছ ধরার এলাকা কমিয়ে দেয়।

গাজার লোকেরা গড়ে দিনে মাত্র ছয় ঘণ্টা বিদ্যুৎ পান। বেশির ভাগ বিদ্যুৎ আসে ইসরাইল থেকে। তবে গাজার একটি নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে, আর কিছু মিসর থেকে আসে। অনেক লোক ডিজেলের জেনারেটর ব্যবহার করেন, তবে তা খুবই ব্যয়বহুল।

গাজায় বৃষ্টিপাত হয় খুবই সামান্য। কোনো বড় মিঠা পানির জলাধার নেই। গাজার বাড়িগুলোতে পাইপে যে পানি আসে, তার সরবরাহ অনিয়মিত। ৯৭ শতাংশ বাড়ি নির্ভর করে ট্যাংকার দিয়ে সরবরাহ করা পানির ওপর। পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা হচ্ছে আরেকটি গুরুতর সমস্যা। প্রায় ৯ কোটি লিটার বর্জ্য পাম্প করে ভূমধ্যসাগরে বা খোলা পুকুরে ফেলা হয়। ফলে গাজার পানির স্তরের ৯৫ শতাংশই দূষিত।

গাজার জনসংখ্যা ২০১৫ সালে ছিল ছয় লাখ ৩০ হাজার। জাতিসঙ্ঘের হিসাব অনুযায়ী, ২০৩০ সালে ওই সংখ্যা ৩১ লাখে গিয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করা হয়।

গাজা একসময় মিসরের অধিকারে ছিল। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল এলাকাটি দখল করে নেয়। পরে ২০০৫ সালে ইসরাইল এলাকাটির দখল ছেড়ে দেয়, সেখান থেকে চলে যায় ইসরাইলি সৈন্যরা এবং প্রায় সাত হাজার ইহুদি বসতি স্থাপনকারী। ওই এলাকাটি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অধীনে। তবে ২০০৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস শাসন করত এই গাজা। হামাস ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনি আইনসভার নির্বাচনে জয়ী হয়। কিন্তু তার পর প্রতিদ্বন্দ্বী ফাতাহর সাথে তাদের সঙ্ঘাত সৃষ্টির পর তারা গাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।

হামাসের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের পর খুব দ্রুত ইসরাইল ওই এলাকাটির ওপর অবরোধ আরোপ করে। গাজা ও ফিলিস্তিনের অন্য এলাকার মধ্যে লোকজন ও পণ্যের চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। মিসরও গাজার দক্ষিণ সীমান্তে অবরোধ আরোপ করে।
ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে এক সংক্ষিপ্ত সামরিক সঙ্ঘাত হয় ২০১৪ সালে। ইসরাইলের চেষ্টা ছিল গাজা থেকে রকেট হামলা থামানো। অন্য দিকে, হামাসের লক্ষ্য ছিল তাদের বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটানো।

মিসর ও গাজার মধ্যে রাফাহ সীমান্ত দিয়ে সে সময় গড়ে ওঠে সুড়ঙ্গের এক নেটওয়ার্ক। এগুলো দিয়ে খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্য মিসর থেকে গাজায় ঢুুকত। ২০১৩ সালের মাঝামাঝি ওই রাফাহ সীমান্তে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে এবং সুড়ঙ্গের নেটওয়ার্কগুলোও বন্ধ করে দেয়ার জন্য অভিযান চালায়। বিশেষ কিছু ক্ষেত্র ছাড়া ২০১৪ সালের অক্টোবর থেকেই মিসর গাজা সীমান্ত বন্ধ করে রাখে।

গাজা থেকে সীমান্ত ক্রসিং পার হয়ে ইসরাইলের ভেতর দিয়ে ফিলিস্তিনিদের চলাচলের ওপরও আছে কঠোর নিষেধাজ্ঞা। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে এরেৎজ ক্রসিং দিয়ে পারাপার করত প্রতিদিন ২৬ হাজার ফিলিস্তিনি। আর ২০১৭ সালের প্রথম ছয় মাসে এরেৎজ দিয়ে ইসরাইলে ঢুকেছে ২৪০ জনেরও কম।

গাজার বাসিন্দাদের গড় আয়ও কমে গেছে। বিশ্ব ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৯৪ সালে গাজার একজন অধিবাসীর গড় বার্ষিক আয় ছিল দুই হাজার ৬৫৯ ডলার। ২০১৮ সালে সে আয় নেমে এসেছে এক হাজার ৮২৬ ডলারে। গাজার ৪৪ শতাংশ লোকই বেকার। উদ্বেগের বিষয় হলো, যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৬০ শতাংশেরও বেশি। গাজার দারিদ্র্যের হার ৩৯ শতাংশ- যা পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের তুলনায় দ্বিগুণ। জাতিসঙ্ঘের সংস্থাগুলোর সামাজিক ভাতা না থাকলে এ হার আরো বেড়ে যেত। ধারণা করা হয়, যে গাজার ৮০ শতাংশ লোকই কোনো না কোনো রকমের সামাজিক কল্যাণ-ভাতার ওপর নির্ভরশীল।

গাজার স্কুলগুলোর ওপর ছাত্রছাত্রীর সংখ্যার প্রচণ্ড চাপের কারণে ৯৪ শতাংশ স্কুলই দুই শিফট করে চলে। একটি সকালে আরেকটি বিকেলে।
প্রভাবশালী মিডল ইস্ট আই পত্রিকার এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, গাজায় আজ দু’টি বিকল্প রয়েছে। একটি দখলদারদের বোমা হামলার নিচে দ্রুত মৃত্যু, অথবা বছরের দীর্ঘ অবরোধের মধ্যে ধীরে ধীরে মৃত্যু। এ অবস্থায় গাজার অধিবাসীরা আল্লাহর কাছে থেকে এবং প্রিয় পরিবার, বন্ধু, উষ্ণ মুহূর্তের স্মৃতি থেকে শক্তি অর্জন করছেন। তারা হচ্ছেন এমন যারা জীবন গণনা করতে পারেন। প্রতিটি চিকিৎসার সময়, যুদ্ধ বা অবরোধে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের গল্প শুনে বাবার চোখে ক্লান্তি দেখা যায়। মনোবিজ্ঞান ওই শিশুদের নিরাময় করতে পারবে না। তবে এটা তাদের জীবনের সাথে যেতে সাহায্য করতে পারে।


আরো সংবাদ



premium cement
ফরিদপুরের গণপিটুনিতে নিহত ২ নির্মাণশ্রমিক জাতিসঙ্ঘে ফিলিস্তিনি সদস্যপদ লাভের প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো তীব্র তাপপ্রবাহে বাড়ছে ডায়রিয়া হিটস্ট্রোক মাছ-ডাল-ভাতের অভাব নেই, মানুষের চাহিদা এখন মাংস : প্রধানমন্ত্রী মৌসুমের শুরুতেই আলু নিয়ে হুলস্থূল মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এত শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি বুঝতে পারেনি ইসরাইল রাখাইনে তুমুল যুদ্ধ : মর্টার শেলে প্রকম্পিত সীমান্ত বিএনপির কৌশল বুঝতে চায় ব্রিটেন ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট আজ নিষেধাজ্ঞার কারণে মিয়ানমারের সাথে সম্পৃক্ততায় ঝুঁকি রয়েছে : সেনাপ্রধান

সকল