২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মার্কিন-চীন কি যুদ্ধ বেধে যাবে?

- ছবি : সংগৃহীত

বিবিসি পরিবেশিত এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে- চীন ও আমেরিকার মধ্যে যুদ্ধ বেধে যাওয়ার কার্যকারণগুলো খুবই জোরালো হয়ে উঠেছে। বিবিসির বিশ্লেষক জোনাথন মার্কস লিখছেন, চীনকে এখন দেখা হচ্ছে, একটি হুমকি হিসেবে। অনেকেই ভয় পাচ্ছেন যে, চীন আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেভাবে বাড়ছে তাতে শেষ পর্যন্ত একটা যুদ্ধ বেধে যেতে পারে। তা যদি হয়, তাহলে এর প্রতিক্রিয়া হবে বিশ্বব্যাপী। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্রাহাম অ্যালিসন এ নিয়ে একটা বই লিখেছেন, যা এখন নীতিনির্ধারক, শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিকদের অবশ্য পাঠ্য হয়ে উঠেছে।

বইটির নাম ‘ডেস্টিনড ফল ওয়্যার : ক্যান আমেরিকা অ্যান্ড চায়না অ্যাভয়েড দ্য থুসিডিডেস ট্র্যাপ?’ এতে তিনি প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক ‘থুসিডিডেসের ফাঁদ’ নামে এক তত্ত্বের অবতারণা করেছেন, যাতে বলা হয়েছে কিভাবে একটি উদীয়মান শক্তি হুমকি হয়ে ওঠে একটি প্রতিষ্ঠিত শক্তির জন্য। অধ্যাপক অ্যালিসন বলছেন, বিশ্বের ইতিহাসে এ রকম ১৬টি উদাহরণ আছে, তার মধ্যে ১২টিই শেষ পর্যন্ত শেষ হয়েছে যুদ্ধে। তিনি বলছেন, ওয়াশিংটন আর বেইজিংয়ের দ্বন্দ্ব হচ্ছে আজকের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নির্ণায়ক ঘটনা। সবাই যে এর সাথে একমত, তা নয়। বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও নৌযুদ্ধ কৌশল বিশেষজ্ঞ প্রফেসর হুবো বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি মনে করেন, চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বের সাথে থুসিডিডেসের ফাঁদের মিল নেই। তিনি বলেন, চীনের উত্থান চোখে পড়ার মতো ঠিকই, কিন্তু এখনো সার্বিকভাবে তার শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুলনীয় নয়। আমেরিকার সাথে চীন পাল্লা দিতে পারে শুধু একটি জায়গায়, তা হলো পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে।

এই এলাকায়ও কি চীন-মার্কিন দ্বন্দ্ব হঠাৎ যুুদ্ধের রূপ নিতে পারে না? এ প্রশ্নের জবাবে মার্কিন নৌযুদ্ধ বিশেষজ্ঞ অ্যান্ড্রু এরিকসন বলছেন, প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় চীন যে সমরসজ্জা করছে তা ঐতিহাসিক মাপেও বিশাল। চীন এমন সব বিশাল ও উন্নত প্রযুক্তিসমৃদ্ধ যুদ্ধজাহাজ তৈরি করছে, যা মানের দিক থেকে পশ্চিমা যুদ্ধজাহাজের সমকক্ষ। ওই অঞ্চলে চীন ক্রমেই আরো বেশি করে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।

সম্প্রতি চীনের বিশেষজ্ঞরা ‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’কে জানিয়েছেন, আমেরিকাকে মোকাবেলার জন্য পরমাণু সক্ষমতাসম্পন্ন অত্যাধুনিক বিমানবাহী চারটি রণতরী নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে চীন। ২০৩৫ সালের মধ্যে ছয়টি বিমানবাহী রণতরী পানিতে নামবে এবং এর মধ্যে চারটির পরমাণু সক্ষমতা থাকবে।

বর্তমানে ‘লায়নিং’ নামে চীনের মাত্র একটি ডিজেলচালিত বিমানবাহী রণতরী ভাসমান রয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ২০১২ সালে ইউক্রেন থেকে অর্ধনির্মিত অবস্থায় এটি কিনেছিল চীন। পরে এটাতে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও নানা সিস্টেম সংযোজন করে নেয় তারা, যা দক্ষিণ-চীন সাগরে ভাসমান রয়েছে। চীন ২০১৭ সালে আরো একটি বিমানবাহী রণতরী নির্মাণ করে সাগরে ভাসিয়েছে। মূলত দক্ষিণ চীন সাগরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চীন-মার্কিন যুদ্ধ পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিল ২০১৬ সালে। আবারো সেখানেই দেখা যাচ্ছে ‘সাজ সাজ’ অবস্থা।

সাধারণত কোনো দেশের উপকূল রেখা থেকে সমুদ্রের গভীরে দুই নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত এলাকাকে সেই দেশের পানিসীমা ধরা হয়। কিন্তু বেইজিং গোটা দক্ষিণ চীন সাগরের ৯০ শতাংশকেই নিজেদের এলাকা বলে দাবি করছে, তাতে আন্তর্জাতিক নিয়ম লঙ্ঘিত হচ্ছে। একই সাথে, অন্যান্য দেশের সার্বভৌমত্বও লঙ্ঘিত হচ্ছে। ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ব্রুনাই, ফিলিপিন্স, তাইওয়ান, জাপান-এ সবক’টি দেশের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। তারা চীনা ‘আগ্রাসনের মুখে পড়েছে’ বলা হচ্ছে। জাপান এশিয়ার অন্যতম প্রধান নৌশক্তি হওয়া সত্ত্বেও চীনের সাথে সরাসরি সঙ্ঘাতে জড়াতে চাচ্ছে না। আর ফিলিপিন্স আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্থ হয়ে রায় পেলেও ফিরে পাচ্ছে না তাদের সমুদ্রসীমা এবং স্প্রাটলি আইল্যান্ডের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব। দক্ষিণ চীন সাগরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে চীনকে হুঁশিয়ারি বার্তা দিয়েছেন ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট দুতার্তে। প্রয়োজনে ‘সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য হবেন’ বলেও জানান সম্প্রতি। বেইজিং যদি ফিলিপিন্সের প্রধান সমুদ্রসীমায় প্রবেশের চেষ্টা করে তবে এই ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান দুতার্তে। ফিলিপিন্সের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রুটগুলো দক্ষিণ চীন সাগরের মধ্য দিয়ে। এ পথে দেশটি ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি-রফতানি করে থাকে। চীনের ফ্রিগেন্ট ও কোস্টগার্ডরা ফিলিপিন্সের পানিসীমায় ঢুকে বাধা সৃষ্টি করে থাকে।

এদিকে দক্ষিণ চীন সাগরের ৯০ শতাংশ এলাকা ঐতিহাসিকভাবে চীনের বলে দাবি করছে বেইজিং। তা ‘প্রমাণ’ করতে সমুদ্রের বিভিন্ন এলাকায় তারা কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করেছে। সেইসব দ্বীপে সামরিক পরিকাঠামো এবং বিমান উড্ডয়নের রানওয়ে গড়ে তোলে। বসানো হয় ব্যালাস্টিক মিসাইল লঞ্চারও। কিন্তু যেসব এলাকায় এসব কৃত্রিম দ্বীপ চীন গড়ে তুলেছে তার কোনোটিই চীনা উপকূলের দুই নটিক্যাল মাইলের মধ্যে পড়ে না। ‘প্যারাসেল আইল্যান্ড’ নামে কৃত্রিম দ্বীপপুঞ্জ চীন তৈরি করেছে। তা নিয়ে চীনের সাথে ভিয়েতনামের বিরোধ চলছে। ফিলিপিন্সের উপকূলের গা ঘেঁষে তৈরি করা স্প্রাটলি আইল্যান্ডস নিয়ে চীনের বিরোধ চলছে ফিলিপিন্সের সাথে। সেই আইল্যান্ডের অধিকার স্বত্ব আন্তর্জাতিক আদালত ফিলিপিন্সকে দিলেও চীন ছাড়েনি তার কর্তৃত্ব। এ ছাড়া স্কারবোরো চর এলাকা নিয়ে বিরোধ চলছে তাইওয়ানের সাথে। অবশ্য ব্রুনাই দাবি করেনি সমুদ্রসীমা এবং সিঙ্গাপুর শান্তিপ্রিয় দেশ হিসেবে চীনের সাথে কোনো বিরোধে জড়াতে চায়নি।

কিন্তু নানা কারণে ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষার বিষয় রয়েছে। চীনকে সে এখন প্রতিপক্ষ মনে করছে নানা কারণেই। প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্র ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখত চীনকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ভেবেছিল, ভিন্ন ধারার সমাজতন্ত্রী দেশ চীনকে তাদের আজ্ঞাবহ বানিয়ে নেবে। সেই লক্ষ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট সিনিয়র বুশ (১৯৮৯-১৯৯৩) চীনকে উন্নত প্রযুক্তি রফতানি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে মার্কিন এমন আচরণ চীন বুঝতে সক্ষম হয় যে, প্রতিশ্রুতি তারা প্রতিপালন করছে না। এ অবস্থায় ভেঙে পড়া সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান উত্তরসূরি, ফেডারেল রাশিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন (১৯৯১-১৯৯৯) যুক্তরাষ্ট্র সফর করে সোজা বেইজিং আসেন এবং চীনকে উন্নত প্রযুক্তি রফতানি করার চুক্তি স্বাক্ষর করেন।

সেই থেকেই চীনের সাথে রাশিয়ার সামরিক অস্ত্রের যৌথ উন্নয়ন ও নির্মাণের যুগ শুরু। দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে চীন। অর্ধশত বছরে চীনের বিস্ময়কর উন্নতি গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। চীন শুধু অর্থনৈতিক সেক্টরে এক নম্বর প্রমাণিত হয়নি, সামরিক ক্ষেত্রেও পরাশক্তি হয়ে ওঠায় মার্কিনিদের টনক নাড়িয়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চায় এখন চীনকে ‘সাইজ’ করতে। এ ব্যাপারে বিগত কয়েক বছর বাণিজ্যযুদ্ধ চালিয়েছে চীনের সাথে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর মোটামুটি চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধ জমে ওঠে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারণায় চীনকে এক হাত নিয়েছিলেন। জয়ের পরও তিনি চীনের সাথে দ্বন্দ্বের ধারা বজায় রেখেছেন। চীনকে পাত্তা না দিয়ে তিনি তাইওয়ানের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার হুমকি দিয়েই। ‘এক চীন নীতি’ থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। এমনকি তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনও চীনবিরোধী মন্তব্য করেন। চীন এসবের কঠোর ভাষায় প্রতিবাদ জানায়। ‘এক চীন’ নীতি মেনেই যুক্তরাষ্ট্রকে সম্পর্কের হাত বাড়াতে হবে- এটাই চীনের স্পষ্ট ঘোষণা।

চীনকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথা কম নয়, তা বেশ স্পষ্টই বোঝা যায়। কখনো চীনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র উদার নীতি অবলম্বন করে, কখনো কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি। এ প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জিম ম্যাটিস বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের দুই বৃহৎ অর্থনীতির দেশের মধ্যে টেকসই সামরিক সম্পর্ক চায়। মার্কিন জয়েন্ট চিপ অব স্টাফ কমিটির চেয়ারম্যান জেনারেল জোসেফ ডানফোর্ড মনে করেন, রাশিয়াকে হটিয়ে ২০২৫ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চীন সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দেখা দেবে। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ তুলে ধরতে গিয়ে ডানফোর্ড আফগানিস্তান ও উত্তর কোরিয়ার বিষয়েও কথা বলেন। তিনি বলেছেন, ২০২৫ সালের মধ্যে সম্ভবত চীন হবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। মেরিন কোরের সাবেক কমান্ডার ও আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর নেতৃত্বদানকারী ডানফোর্ড বলেন, আমরা যদি ২০১৫ সালের দৃশ্যপট চিন্তা করি, জনসংখ্যাগত ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নেই, তাহলে চীন আমাদের দেশের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হবে। এই মুহূর্তে চীন প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা প্রদর্শনের সামর্থ্য খর্ব এবং মিত্র দেশগুলোকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে। চীনকে নামিয়ে আনার জন্য বহুদিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র তৎপর। ভারতকে দিয়েও চেষ্টা কম করেনি।

২০১৬তে যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল চীন, পাকিস্তান ও ভারতকে লড়াইয়ে নামাতে। কিন্তু ভারত সাহস করেনি। কারণ রাশিয়া দুমুখো নীতি অবলম্বন করেছিল। চীন ও পাকিস্তানের সাথে যৌথ সামরিক মহড়ার মাধ্যমে রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রকে বার্তা দিতে চেয়েছে, এখানে যুক্তরাষ্ট্র হাত দিলে রাশিয়া বসে থাকবে না। তবু হাল ছাড়েনি যুক্তরাষ্ট্র। ভারত মহাসাগরে চীনের আধিপত্য খর্ব করতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের কাছে ২৪এম এইচ ৬০ হেলিকপ্টার বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওই হেলিকপ্টার দিয়ে সাগরের ৪০০ ফুট গভীরে চলা সাবমেরিন টার্গেট করে ধ্বংস করা যায়। গত বছরের শেষ দিকে সাবমেরিন বিধ্বংসী ওই হেলিকপ্টার কিনতে চেয়ে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানায়।

চীনের ব্যাপারে রাশিয়ার নীতিও পাল্টেছে বলে বেশ স্পষ্টভাবে ধরা পড়ছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়া চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নত করেছে। চীন বিপুল পরিমাণ অর্থ সাহায্য দেয় রাশিয়াকে। রাশিয়াও চীনের প্রযুক্তি উন্নয়নে ‘উদার হস্তে’ সহযোগিতা দেয়। মোটামুটি দুই দশক পর্যন্ত রাশিয়া-চীন অক্ষশক্তি হিসেবে ভূ-রাজনীতির এক নয়া দিগন্তে দাঁড়ায়। কিন্তু বিশ্ব দ্রুতই পাল্টাতে থাকে। ভারত যেভাবে একসময় রাশিয়ার চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে সখা বানাতে উঠেপড়ে লেগেছিল, তাতে মনে হচ্ছিল ভারতের সাথে রাশিয়ার আদি সম্পর্ক নবায়ন করা বুঝি সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু, বিগত বছরের শেষ দিকে রাশিয়া ভারতের সাথে এস ৪০০ ‘ট্রায়াম্ফ’ মিসাইল সিস্টেম বিক্রয়ের চুক্তি করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এ ঘটনাও চীনের বিরুদ্ধেই যাচ্ছে। এমনিতে রাশিয়ার সাথে চীনের ঐতিহাসিকভাবে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। চীন সবসময় রাশিয়াকে ‘হিসেবের মধ্যে’ই রেখেছে। রাশিয়া বরং পশ্চিমা শক্তির কবল থেকে বাঁচার জন্য চীনকে ‘অক্ষশক্তি’ বানানোর ছল করেছিল। অন্য কোনোভাবে চীনকে ধরার যখন এ পর্যন্ত কোনো উপায় করে উঠতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র, এবার সে নিজেই নেমেছে। অন্তত বিগত কয়েক মাসে প্রশান্ত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদেশের তৎপরতা দেখে তেমনটা আন্দাজ করা যাচ্ছে।

গত বছর আগস্টে অস্ট্রেলিয়ান রাজকীয় নৌবাহিনীর এক রণতরীকে চীনের নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ ধাওয়া দেয়। এরপর ডিসেম্বরে পেন্টাগন প্রশান্ত মহাসাগরীয় সব মিত্র দেশকে দক্ষিণ চীন সাগরে নৌশক্তির সমাবেশ ঘটাতে আহ্বান জানায়। এর এশিয়া এবং প্যাসিফিক জোনের সহকারী সচিব রেনডি স্ক্রিভার ‘দ্য অস্ট্রেলিয়ান নিউজ পেপার’ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে এ আহ্বান জানান।

উল্লেখ্য, চীন ছাড়া সাগর পাড়ের অন্য দেশগুলোর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা চুক্তি রয়েছে। যেমন- তাইওয়ানের জনগণের ওপর কোনো ধরনের হুমকি এলে যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে রক্ষা করতে বাধ্য। এ ধরনের চুক্তি রয়েছে জাপান, ফিলিপাইন আর ভিয়েতনামের সাথেও। এদিকে চীন হুঁশিয়ারি দিয়েছেÑ চীন সাগরে নির্মিত কৃত্রিম দ্বীপগুলোতে চীনকে যেতে বাধা দিলে তা ভয়ঙ্কর সঙ্ঘাতে রূপ নেবে, মানে বড় আকারে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। বেইজিং সতর্ক করে দেয় যে, দক্ষিণ চীন সাগরের বিতর্কিত এলাকায় চীন যেসব কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করছে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে তাদের যাওয়ার পথ বন্ধ করে দিতে পারে।

এভাবে পরিস্থিতি সঙ্ঘাতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। য্ক্তুরাষ্ট্র আরো একটি রণতরী পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে ভিড়িয়েছে, যাতে ১০টি এফ-৩৫ এ (স্টিলথ) যুদ্ধবিমান রয়েছে। চীন মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ডিএফ-২৬ (পাল্লা : পাঁচ হাজার ৭৪০ কিলোমিটার) এপ্রিল মাসে দক্ষিণ চীন সাগরে মোতায়েনকৃত (রকেট ফোর্স) বাহিনীর হাতে হস্তান্তর করছে। এ ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরীয় ঘাঁটি গুয়ামে আঘাত করা সম্ভব।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নৌ কমান্ডার রিয়ার অ্যাডমিরাল রোনাল্ড বক্সেল বলেছেন, আমরা বিগত কয়েক বছর অযথা সময় অপচয় করেছি। সময় এসেছে আমাদের সক্ষমতা দেখানো আর ফিলিপিন্স বলেছে, তার আত্মঘাতী বাহিনীকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে যেকোনো সময় মিশন পাঠাতে, যাতে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের আধিপত্য থেকে মুক্ত করতে পারে তাদের পানিসীমা। যুক্তরাষ্ট্রও তার একটি বিমানবাহী রণতরী প্রশান্ত মহাসাগরের উদ্দেশে রওনা করিয়েছে। রাশিয়া তার পাঁচটি যুদ্ধজাহাজ ম্যানিলা ভ্রমণ করিয়ে এনেছে, যা ছিল ইঙ্গিতবহ।

যুদ্ধ ও বাধা নির্ভর করে অনেকটা শাসকের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার ওপর। কখনো কখনো এমন শাসক দেশে দেশে আসেন যারা মনস্তাত্ত্বিকভাবেই যুদ্ধবাজ। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্পর্কে রিপাবলিকান দলের ৫০ জন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ নির্বাচনের আগে ট্রাম্পের ভূমিকায় বিরক্ত হয়ে খোলা চিঠিতে বলেছিলেন- ‘নির্বাচিত হলে ট্রাম্প হবেন মার্কিন ইতিহাসে সবচেয়ে বেপরোয়া প্রেসিডেন্ট।’ ইতোমধ্যে ট্রাম্প উত্তর কোরিয়াসহ বিভিন্ন প্রসঙ্গে যেসব মন্তব্য করেছেন তা তার উগ্র ও দাম্ভিক প্রকৃতি প্রমাণ করে। উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনকে হুঁশিয়ার করে ট্রাম্প বলেছেন, উত্তর কোরিয়ার নেতার চেয়ে তিনি অনেক বড় ও আরো শক্তিশালী। পারমাণবিক বোতাম তার রয়েছে।’ অপরদিকে, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংকে একজন ধীরস্থির ও শান্ত প্রকৃতির বলে মনে হয়। ২০১৩ থেকে তিনি চীনকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন সফলভাবে। ২০১৭তে তিনি পেয়েছেন ‘অনির্দিষ্ট সময়কাল’ প্রেসিডেন্ট থাকার সাংবিধানিক সুযোগ। ‘সুপার পাওয়ার’ হওয়া এবং তা দেখানোর মনোবাঞ্ছা তার মনে বাসা বেঁধে আছে কি না তা কে বলবে।

যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো ইউনিভার্সিটিতে একদল বিজ্ঞানীর চালু করা দেয়ালে স্থাপিত ‘ডুমসডে ক্লক’ সম্পর্কে একটি তথ্য দিয়ে নিবন্ধ শেষ করছি। ৬৪ বছরের মধ্যে নাকি এখনই চরম ক্ষণের কাছাকাছি ঘড়িটির কাঁটা। ২০১৫ সালের ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে ইউনিভার্সিটির দেয়ালে স্থাপিত ঘড়িটির কাঁটা ৩০ সেকেন্ড এগিয়ে আনা হয়েছে। এখন চরম সময়, মধ্যরাতের আড়াই মিনিট আগে রয়েছে কাঁটাটির অবস্থান। এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উদ্বেগজনক বক্তব্য এবং উসকানিমূলক তৎপরতাকে দায়ী করা হয়েছে।

লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক


আরো সংবাদ



premium cement