অনাগ্রহ ও প্রত্যাখ্যানের পঞ্চম উপজেলা নির্বাচন
- ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন
- ১৯ এপ্রিল ২০১৯, ২০:২৬
পঞ্চম উপজেলা নির্বাচনের চতুর্থ ধাপ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। রোজার ঈদের পর পঞ্চম ধাপের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ পর্যন্ত সমাপ্ত নির্বাচনে ভোটের প্রতি জনগণের অবিশ্বাস, অশ্রদ্ধা, তীব্র ক্ষোভ ও চরম অনীহার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্র ও মিডিয়ায় সীমিত আকারে হলেও ভোটকেন্দ্রে ভোটারের আকাল বা খরার চিত্র প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা এবং কমিশনার মাহবুব তালুকদার ভোটের খরার কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। মাহবুব তালুকদার এক বক্তব্যে এক ধাপ অগ্রসর হয়ে মন্তব্য করেছেন, ভোটে জনগণের যে অনীহা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাতে জাতি এক গভীর খাদের কিনারে অগ্রসরমান। আমরা গণতন্ত্রের শোকযাত্রায় শামিল হতে চাই না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নামে আগের রাতের ভোট ডাকাতি এবং পঞ্চম উপজেলা নির্বাচনের চতুর্থ ধাপ পর্যন্ত নির্বাচনের নামে প্রহসনকে বৈধতা দিয়ে প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রের শবযাত্রায় শামিল হয়েছেন।
উপজেলা নির্বাচনের আগে ৭ মার্চ প্রকাশিত একটি লেখায় পঞ্চম উপজেলা নির্বাচনের এহেন দৈন্যদশা ও অনীহার কথা বিবেচনা করে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কেন ৯১০ কোটি টাকার অপচয় করা হবে, সেই প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলাম। নির্বাচনের নামে কী ধরনের প্রহসন হবে, সে বিষয়ে আশঙ্কা সঠিক হলেও টাকার অপচয় রোধ করা সম্ভব হয়নি।
পঞ্চম উপজেলা নির্বাচন যে একতরফা, প্রতিযোগিতাহীন ও নিষ্প্রভ হবে তা কারোরই অজানা ছিল না। গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯ ডিসেম্বর রাতে ইসিসহ সব প্রশাসনের সামনে যে নজিরবিহীন ভোট ডাকাতি হয়েছিল, সে দুঃস্বপ্ন ও ক্ষত দুই মাসের মধ্যে দেশের জনগণের স্মৃতি থেকে সামান্যতম ম্লান হয়ে যায়নি। এ অবস্থায় একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে ধ্বংসপ্রাপ্ত নির্বাচনব্যবস্থার ধারাবাহিকতায় উপজেলা নির্বাচনের চতুর্থ ধাপ পর্যন্ত সম্পন্ন হয়েছে।
এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে ভোটের আকাল ও খরা থাকা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশনের ঘোষণা মোতাবেক চতুর্থ ধাপ পর্যন্ত গড় ভোট পড়েছে ৪০.৬৩ শতাংশ। প্রকৃতপক্ষে ভোটার উপস্থিতি ছিল মারাত্মকভাবে কম। যেসব উপজেলায় নির্বাচন হয়েছে, সেসব উপজেলা চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের নৌকা এবং আওয়ামী বিদ্রোহীদের মধ্যে মূলত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা এবং বিরোধী দলের কোনো প্রার্থী না থাকায় ভোটকেন্দ্রে সংঘর্ষ ও নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা না থাকার পরও ভোটের আকাল ও খরা অবশ্যই উদ্বেগ এবং দুশ্চিন্তার বিষয়। বিভিন্ন পত্রিকায় খবর প্রকাশ হয়েছে, ভোটকেন্দ্রে ভোটার আনার জন্য মসজিদের মাইকে আহ্বান জানানোসহ পুলিশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েও জনগণকে ভোটকেন্দ্রে আকৃষ্ট করা সম্ভব হয়নি।
তাই প্রতি ধাপের নির্বাচনের পরের দিনের পত্রিকায় ভোটার উপস্থিতি সম্পর্কিত খবর ও মন্তব্যে গণতন্ত্রকামী মানুষ আতঙ্কিত ও উৎকণ্ঠিত। প্রথম ধাপের নির্বাচনের পরের দিনে প্রকাশিত একটি প্রথম সারির পত্রিকার শিরোনাম ছিল ‘পর্যাপ্ত আয়োজন, ছিল না তেমন ভোটার এবং ভোট গ্রহণের দায়িত্বে ৩৬, ভোট পড়েছে ৬৭।’ দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের পরের দিনে প্রকাশিত কয়েকটি পত্রিকায় ‘দ্বিতীয় ধাপেও সাড়া নেই ভোটারের’, ‘দ্বিতীয় ধাপেও ভোটার খরা’ এবং ‘আবারও ভোটারবিহীন ভোট’ শিরোনামে খবর পরিবেশন করা হয়। তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপেও ভোটারের উপস্থিতির ধারাবাহিকতার একই চিত্র ফুটে উঠেছে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত কয়েকটি শিরোনাম উল্লেখযোগ্য।
যেমন- ‘সংঘর্ষ, কারচুপি, বর্জন- ভোটার খরা কাটেনি’, ‘রাতে বাক্সভর্তি দিনে ভোট বন্ধ- নিরুত্তাপ পরিবেশে ভোট গ্রহণ’; ‘ফাঁকা ভোটের মাঠেও সঙ্ঘাত অনিয়ম’, ‘কেন্দ্রে ভোটারের আকাল’, ‘ফাঁকা কেন্দ্র, অভিযোগ, বর্জন’; “প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন ভোট আ’লীগের জয়” ইত্যাদি। সরেজমিন সাংবাদিকেরা কেন্দ্রে গিয়ে ২টা বা ৩টার দিকে যেখানে ৮ বা ১০ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জেনেছেন, সেসব কেন্দ্রে ফলাফল ঘোষণার পর ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ দেখানো হয়েছে। এতসব করেও চতুর্থ ধাপের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন গড়ে ৪০.৬৩ শতাংশের বেশি দেখাতে পারেনি। চতুর্থ ধাপে ইসির ঘোষণা মোতাবেক ৩৬.৫০ শতাংশ ভোট পড়েছে। চতুর্থ উপজেলা নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হওয়ায় গড়ে ভোট পড়েছিল ৬০ শতাংশেরও বেশি। ইসির হিসাব মোতাবেক বিগত প্রশ্নবিদ্ধ সংসদ নির্বাচনে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছিল, যার মধ্যে ৭৬ শতাংশই আ’লীগ পেয়েছে। নির্বাচন কমিশনের প্রদত্ত হিসাবে দেখা যাচ্ছে- পঞ্চম উপজেলা নির্বাচনে জনগণের ভোটের প্রতি অনীহা ও অনাস্থা কী পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ভোটার উপস্থিতি ছিল আশঙ্কাজনক কম।
বর্তমান উপজেলা নির্বাচনে ভোটার শূন্যতা সম্পর্কে ইসি সচিব সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন, ভোটের হার নিয়ে ইসির কোনো মাথাব্যথা নেই। অবশ্য ইসি কমিশনার মাহবুব তালুকদার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, একতরফা নির্বাচনের কারণে ভোটাররা কেউ ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার বিষয়ে আগ্রহী নয়। এহেন নির্বাচনবিমুখতা গণতন্ত্রবিমুখতায় পর্যবসিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থা গণতন্ত্রের জন্য অশনিসঙ্কেত বলেও মন্তব্য করেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদাও ভোটের খরার কথা স্বীকার করেছেন। বিগত একাদশ নির্বাচনের নামে ২৯ ডিসেম্বর রাতে ভোট ডাকাতির ফলাফলকে বৈধতা দিয়ে ইসি লজ্জাজনকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। তাই উপজেলা নির্বাচনে হতাশাব্যঞ্জক কম উপস্থিতি সম্পর্কে ইসিকে কেউ প্রশ্ন না করলেও ইসি তাদের দায় এড়াতে পারে না। রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ৯১০ কোটি টাকা খরচ করে ইসি যাদের মতামত প্রদানের জন্য নির্বাচনের এত বড় আয়োজন করলেন, সেখানে ভোটাররা ভোট দিতে না এসে কেন ভোটের প্রতি এত অনীহা ও অশ্রদ্ধা প্রকাশ করল তার জবাব ইসিকেই দিতে হবে।
নির্বাচন বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি উৎসবের বিষয় ছিল। মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগকে তাদের পবিত্র দায়িত্ব বলে মনে করত। পঞ্চম উপজেলা নির্বাচনে জনগণের ভোটের প্রতি অনীহা ও ভোটাধিকার প্রয়োগে উৎসাহ হারানোর বিষয়টি আকস্মিকভাবে ঘটেনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের রাতে ভোট ডাকাতির মাধ্যমে যে নজিরবিহীন ও অনৈতিকভাবে জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছিল, সেই বঞ্চনার প্রতিবাদে ভোটদানে বিরত বা ভোট প্রদানে অনীহার অন্যতম কারণ।
পঞ্চম উপজেলা নির্বাচনের চতুর্থ পর্যায় পর্যন্ত ইসি ঘোষিত ও একটি পত্রিকায় প্রকাশিত ফলাফল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ৪৪৫টি উপজেলার ঘোষিত ফলাফল অনুযায়ী উপজেলা চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ (নৌকা) ১৯৪ জন, আওয়ামী লীগ বিদ্রোহী ১৩৬ জন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১১০ জন এবং জাতীয় পার্টি ও অন্যান্য মিলে পাঁচজন নির্বাচিত হয়েছেন। বলাই বাহুল্য, যারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন, তারাও আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী। ফলাফল থেকে এটা স্পষ্ট যে, এ পর্যন্ত ঘোষিত উপজেলা চেয়ারম্যান প্রায় সবাই একদলীয় অর্থাৎ আ’লীগ নেতা। এ ধরনের ফলাফল দেখে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ঘোষিত প্রার্থীরা আসলে নির্বাচিত নন, বরং তারা মনোনীত। নির্বাচিত পদে মনোনীত হিসেবে আসীন হয়ে দায়িত্ব পালন করা কতটুকু নৈতিক ও সাংবিধানিক তা বিচার্য বিষয়। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার প্রবণতা কোনো মানদণ্ডেই গ্রহণযোগ্য নয়।
আমাদের নির্বাচনব্যবস্থা আজ সম্পূর্ণ খাদের কিনারায় এসে পৌঁছেছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আগের রাতের নজিরবিহীন ভোট ডাকাতির পর জনগণের মধ্যে নির্বাচনবিমুখতা, ভোটের প্রতি অশ্রদ্ধা ও অনীহা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কয়েক মাসের মধ্যে ঢাকা সিটি করপোরেশনের ভোটারবিহীন নির্বাচন, ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বড় সংগঠন এফবিসিসিআইর বিনা ভোটে নির্বাচন ও পোশাক শিল্প সমিতির (বিজিএমইএ) প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন, ডাকসু নির্বাচন এবং সর্বশেষ উপজেলা নির্বাচনে জনগণের মধ্যে নির্বাচনবিমুখতা ও অনীহাকে অনেকে গণতন্ত্রের ‘শবযাত্রা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কেউ কেউ গণতন্ত্রের কবর রচনা করা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন। দেশে বর্তমানে অলিখিত ‘বাকশাল’ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।
লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা গণতন্ত্র নিয়ে ছিনিমিনি খেলা জাতির জন্য কোনো ক্রমেই মঙ্গলজনক নয়। গণতন্ত্রহীন দেশে জনগণের মধ্যে শান্তি, শৃঙ্খলা, স্থিতিশীলতা ও টেকসই উন্নয়ন কোনোটাই অর্জন করা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রীয় সব কর্মকাণ্ডে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ একটি অপরিহার্য বিষয়। জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিত্বের নীতি বর্তমানে চরম বিপর্যয়ের মুখে নিপতিত। দেশ ও জনগণের স্বার্থে জাতীয় এই বিপর্যয় থেকে আশু পরিত্রাণ একান্ত কাম্য। গণতন্ত্রকে শৃঙ্খলিত রেখে জনগণের সার্বিক মুক্তি সম্ভব নয়। এ অবস্থায় যত দ্রুত সম্ভব গণতন্ত্র, জনগণের অধিকার, মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা অতীব জরুরি।
লেখক : সদস্য, জাতীয় স্থায়ী কমিটি, বিএনপি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা