২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

অ্যাসাঞ্জকে নিয়ে বিপদে পশ্চিমা বিশ্ব

জুলিয়ান পল অ্যাসাঞ্জ - ছবি : সংগ্রহ

উইকিলিকস। বিশ্ব কাঁপিয়ে দেয়া এক নাম। এর প্রধান উদ্যোক্তা জুলিয়ান পল অ্যাসাঞ্জ। ৩ জুলাই ১৯৭১ সালে অস্ট্রেলিয়ায় জন্ম নেয়া অ্যাসাঞ্জ সাংবাদিক, প্রকাশক ও কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসেবে খ্যাতি থাকলেও বহুল আলোচিত উইকিলিকসের মাধ্যমেই বিশ্ববাসীর নজরে আসেন তিনি। ১৯ জুন ২০১২ থেকে ১১ এপ্রিল ২০১৯ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে অবস্থিত ইকুয়েডোর দূতাবাসে রিফিউজি হিসেবে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিলেন। বর্তমানে লন্ডন পুলিশের হেফাজতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি মামলার আসামি হিসেবে অজ্ঞাত স্থানে বন্দী আছেন।

যৌন সহিংসতার অভিযোগে করা একটি মামলায় সুইডেনে প্রত্যর্পণ এড়াতে সাত বছর আগে লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন অ্যাসাঞ্জ। ২০১০ সালে সুইডেনে দুই নারীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়; কিন্তু পরে তা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। তবে বরাবরই আসাঞ্জ তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন।

তবে ইকুয়েডরের বর্তমান প্রেসিডেন্ট লেনিন মোরেনো জানিয়েছেন, বারবার আন্তর্জাতিক নীতিমালা ভঙ্গ করায় তার রাজনৈতিক আশ্রয় প্রত্যাহার করা হয়েছে। অন্যদিকে উইকিলিকসের পক্ষ থেকে এক টুইট বার্তায় বলা হয়েছে, অবৈধভাবে অ্যাসাঞ্জের ওপর থেকে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রত্যাহার করে নিয়েছে ইকুয়েডর।
গত বৃহস্পতিবার ব্রিটেনে অবস্থিত ইকুয়েডরের দূতাবাস থেকে সাত কর্মকর্তা তাকে টেনেহিঁচড়ে দূতাবাস থেকে বের করে আনেন। তবে নিউ ইয়র্ক টাইমস জানায়, অ্যাসাঞ্জকে ধরিয়ে দেয়ার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ঋণ মওকুফের আবেদন জানিয়েছেন ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট লেনিন মোরেনো।

এ দিকে অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণ না করার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাজ্যের বিরোধী দল লেবার পার্টি বলেছে, মানবাধিকারের সুরক্ষার তাগিদে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে যেন কোনোভাবেই যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণ না করা হয়। তবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে এখন পর্যন্ত এ দাবি মেনে নেয়ার কোনো আভাস দেননি। উল্টো অ্যাসাঞ্জের গ্রেফতারকে স্বাগত জানিয়েছেন তিনি।

গোপন খবর হলো, অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধেই গ্রেফতার করেছে ব্রিটেন। অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক অ্যাসাঞ্জ ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লাখ লাখ সামরিক ও কূটনৈতিক গোপন নথি ফাঁস করে দিয়ে বিশ্বজুড়ে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। আফগান ও ইরাক যুদ্ধ নিয়ে তার প্রকাশ করা নথিতে চরম বেকায়দায় পড়েছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও পেন্টাগন।

এ দিকে যুক্তরাষ্ট্রের জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রে ও যুক্তরাজ্যের মধ্যকার বন্দিবিনিময় চুক্তি অনুসারে অ্যাসাঞ্জকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গোপন তথ্য ফাঁসের ঘটনায় অভিযুক্ত তিনি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়েছে, অ্যাসাঞ্জ ২০১০ সালের মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের সিক্রেট ইন্টারনেট প্রটোকল নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত পররাষ্ট্র দফতরের কম্পিউটারে সংরক্ষিত পাসওয়ার্ড বের করতে চেলসি ম্যানিংয়ের সাথে ষড়যন্ত্র করেছিলেন। দোষী সাব্যস্ত হলে অ্যাসাঞ্জের পাঁচ বছরের সাজা হতে পারে।

২০১৭ সালে ইকুয়েডরের ক্ষমতায় আসা মোরেনোও উইকিলিকসের সত্য প্রকাশের শিকার হয়েছেন। গত ফেব্রুয়ারিতে উইকিলিকস একগুচ্ছ গোপন নথি ফাঁস করে যেখানে মোরেনা ও তার পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতি ও মুদ্রাপাচারের তথ্য বেরিয়ে আসে। অ্যাসাঞ্জের বিষয়ে এ সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট মোরেনোর তুমুল সমালোচনা করেছেন ইকুয়েডরের সাবেক প্রেসিডেন্ট রাফায়েল কোরেয়া। ২০১২ সালে অ্যাসাঞ্জকে আশ্রয় দেয়ার সময় দেশটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন কোরেয়া। তিনি টুইটে লিখেছেন ‘লেনিন মোরেনো ইকুয়েডর ও ল্যাটিন আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতক।’

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে করা সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস বলেছে, তাকে হস্তান্তর করা হলে তা সাংবাদিক, সত্য প্রকাশকারী ও সাংবাদিকতা সংশ্লিষ্ট অন্যদের জন্য ভয়ানক নজির তৈরি করবে। অ্যাসাঞ্জের গ্রেফতারকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য এক অন্ধকার অধ্যায় আখ্যায়িত করেছেন এডওয়ার্ড স্নোডেন, যিনি নিজেও যুক্তরাষ্ট্রের গোপন নথি ফাঁসের পর রাশিয়ায় স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছেন। ওয়াশিংটনের জন্য অ্যাসাঞ্জের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে ইকুয়েডর এবং এর মধ্য দিয়ে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কালো অধ্যায় রচিত হলো। বাক স্বাধীনতার কথা বলা যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার অপব্যবহারের তথ্য বিশ্ববাসীর সামনে আনায় অ্যাসাঞ্জকে নায়ক হিসেবে দেখেন বহু মানুষ।

সাড়াজাগানো উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অতি গোপনীয় তথ্য ফাঁস করে এক পক্ষের কাছে যেমন ‘বীরে’ পরিণত হয়েছিলেন, তেমনই অন্য পক্ষের কাছে হয়েছিলেন শত্রু। তার প্রধান শত্রু যুক্তরাষ্ট্র। তিনি এখনো এই মেরুকরণ অবস্থায় রয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র অ্যাসাঞ্জকে নিরাপত্তার জন্য চরম হুমকি হিসেবে মনে করে। তাই তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে।

উইকিলিকসের বিচারের আইনি প্রভাব সম্পর্কে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ইয়োকাই বেনক্লার বলেছেন, অভিযোগপত্রে কিছু অত্যন্ত বিপজ্জনক উপাদান রয়েছে, যা নিরাপত্তার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ঝুঁকি সৃষ্টি করে। অভিযোগের ধারাবাহিকতা বহুদূরে বিস্তৃত। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ শীতল প্রভাব থাকতে পারে। এটি প্রত্যাখ্যান করা উচিত। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাইট ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্ট ইনস্টিউটের স্টাফ অ্যাটর্নি ক্যারি ডেসেল বলেছেন, ‘অভিযোগগুলো সাংবাদিকতার ওপর চাপানো ঝুঁকিপূর্ণ। অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে বেশির ভাগ অভিযোগ সাংবাদিকদের সুরক্ষার জন্য আনা সংশোধনীর পরিপন্থী। এটা আমাদের জন্য খুবই কষ্টকর।’

সাংবাদিকতা ও স্বাধীন মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে অ্যাসাঞ্জ বর্তমান প্রজন্মের কাছে পথপ্রদর্শক। তার প্রকাশিত সরকারি গোপন নথি সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করলেও পশ্চিমা বিশ্বে এখন তাকে খলনায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। মূলত অ্যাসাঞ্জের ভাবাদর্শে ভবিষ্যতে যাতে কেউ উদ্বুদ্ধ না হয়, সে জন্য এ অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে।

বিশ্বজুড়ে প্রায়ই সরকারি বিভিন্ন গোপন নথি প্রকাশ পেলেও শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। মূলত তার ও উইকিলিকসের রাজনৈতিক যে আদর্শ তাতে ভয় পেয়েই দানব রাষ্ট্রগুলো অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে। তাকে থামাতে পারলেই ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের অনেক অপকর্ম জনগণের চক্ষুর আড়াল হবে এমনট ধারণাই তাদের। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে মুক্ত সমাজ নির্মাণে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে এমন বিশ্বাস থেকেই অ্যাসাঞ্জ ‘উইকিলিকস’ গড়ে তুলেছিলেন। যার প্রধান উদ্দেশ্য জনস্বার্থে বিভিন্ন রাষ্ট্রের যড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ডকে জনসমক্ষে প্রকাশ করা এবং এর মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।

জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মতো একক ব্যক্তির পক্ষে দানব রাষ্ট্রদের কর্তৃত্ববাদী কাঠামোটি ভাঙা সম্ভব নয়। আরো অনেক অ্যাসাঞ্জ এখন সময়ের দাবি। তাকে ফৌজদারি অপরাধে বেঁধে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো দেখাতে চাইছে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এবং জনস্বার্থে গোপন তথ্য ফাঁস একটা অপরাধ। অ্যাসাঞ্জের ক্ষেত্রে তারা সফল হলে বিশ্বজুড়েই সাংবাদিকতা ও স্বাধীন মতপ্রকাশের বিষয়টি আরো কঠিন হয়ে যাবে।


আরো সংবাদ



premium cement