২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ইমরান খান এবং ইসরাইল

ইমরান খান এবং ইসরাইল - ছবি : সংগ্রহ

এটি একটি পুরনো বিতর্ক, যা নয়া পাকিস্তানে নতুন একটি পক্ষ থেকে দ্বিতীয়বার শুরু হয়েছে। সাধারণ জনগণ এ বিতর্ক সম্বন্ধে কিছুই জানে না। কেননা, এটা প্রশাসনের চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সাম্প্রতিক উত্তেজনার পর প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন, যাকে কেন্দ্র করে শুধু পাকিস্তানে নয়, ভারতেও তার প্রশংসা করা হচ্ছে। কেননা, ওই পদক্ষেপগুলোর মাধ্যমে বিশ্বে পাকিস্তানের অবস্থান আরো উন্নত হয়েছে।

পাকিস্তানকে শুধু ভারত নয়, বরং আরো কয়েকটি দেশের ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করতে হচ্ছে। ওই দেশগুলোর তালিকার শীর্ষে রয়েছে ইসরাইল। ২৬ ফেব্রুয়ারি বালাকোটের সন্নিকটে জাব্বায় ভারতীয় বিমানবাহিনীর হামলার পর থেকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এ তথ্য ঘুরপাক খাচ্ছে যে, ওই হামলায় ভারত ইসরাইলের তৈরি করা অস্ত্র ব্যবহার করেছে। নির্ভরযোগ্য সূত্র এ কথাও বলছে যে, ভারত ইসরাইলের সহযোগিতায় রাজস্থানের রুট দিয়ে পাকিস্তানের ওপর একটি বড় হামলার পরিকল্পনা নিয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ওই হামলার আগাম তথ্য পেয়ে যায় এবং পাকিস্তান ভারতকে এ বার্তা প্রেরণ করে যে, আমাদের ভূখণ্ডে যদি দ্বিতীয়বার হামলা করা হয়, তাহলে মোক্ষম জবাব দেয়া হবে। আর এভাবেই ভারতের এ হামলা থেমে যায়। ভারত ও ইসরাইলের এই ‘পাকিস্তান শত্রু ঐক্যের প্রেক্ষাপটে কিছু দিন ধরে ইমরান খানকে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে, আমাদের ভারত ও ইসরাইলের ঐক্য ভাঙার জন্য ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করা উচিত। ইমরান খানকে এ পরামর্শ ২৬ ফেব্রুয়ারি ভারতের হামলার আগেও দেয়া হয়েছিল এবং এ হামলার পরেও দেয়া হয়েছে।

পরামর্শদাতাদের বক্তব্য, যদি ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার প্রতিনিধি ইসরাইলের সাথে আলোচনা করতে পারেন, যদি ইসরাইলের সাথে মিসর, জর্দান ও তুরস্কের কূটনৈতিক সম্পর্ক হতে পারে, তাহলে পাকিস্তানেরও ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক করা উচিত। এভাবেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ইসরাইল ও ভারতের ঐক্য শেষ হয়ে যাবে। এ পরামর্শে ইসরাইল নয়, বরং পাকিস্তানের স্বার্থ পরিলক্ষিত হচ্ছে। ইমরান খান এ পরামর্শ গ্রহণের ইঙ্গিত দিয়ে দিলেই সমগ্র পশ্চিমের হিরো হয়ে যেতে পারবেন। তবে এ পরামর্শের পরিপ্রেক্ষিতে তার সরল জবাব ছিল, ‘মন মেনে নিচ্ছে না।’

পরামর্শদাতাদের বক্তব্য, ‘মনের কথা’ নয়, প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ‘জ্ঞানের কথা’ মেনে নেয়া উচিত। তবে ইমরান খান বলেন, ‘ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলের জুলুমকে সমর্থন করতে পারি না।’ পরামর্শদাতাদের সদিচ্ছা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, তবে ইমরান খানের জবাব শুনে মন প্রশান্তি লাভ করল যে, অনেক ত্র“টিসত্ত্বেও ইমরান খান কোনো চাপ বা ভয়ে কাবু হওয়া রাজনীতিবিদ নন। তার ‘ইউটার্ন’ নেয়ার রাজনীতি নিয়ে অনেক সমালোচনা করেছি। তবে আমি আশাবাদী, তিনি ইসরাইলের বিষয়ে ইউটার্ন নেবেন না।

কেননা ইসরাইলের সাথে সম্পর্কের বিষয়টি আগের চেয়ে অনেক জটিল হয়ে গেছে। ইসরাইলের সাথে সম্পর্কের বিষয়ে আলোচনা জেনারেল জিয়াউল হকের শাসনামলে শুরু হয়েছিল, যে সময় আমেরিকা ‘অপারেশন সাইক্লোন’-এর মাধ্যমে আফগানিস্তানে রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী মুজাহিদদের অস্ত্র সরবরাহ করার জন্য পাকিস্তানের পাশাপাশি ইসরাইলেরও সহায়তা নিয়েছিল। ১৯৮৮ সালে বেনজির ভুট্টো ক্ষমতায় এলে তাকে ইসরাইলের সাথে সংলাপের চ্যানেল খোলার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। পরামর্শদাতা ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। ওই সময় নাসিরুল্লাহ বাবর বেনজির ভুট্টোর উপদেষ্টা ছিলেন। বাবর সাহেব এ পরামর্শের মধ্যে ষড়যন্ত্রের গন্ধ দেখতে পান। সুতরাং তিনি ওই সরকারি কর্মকর্তাকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেন। ১৯৯০ সালে ওই কর্মকর্তা প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসহাক খানের সাথে হাত মিলিয়ে বেনজির ভুট্টোর সরকার ভেঙে দিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

নওয়াজ শরিফের সরকার ক্ষমতায় এলে তাকেও ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের পরামর্শ দেয়া হয়। ১৯৯৩ সালে বেনজির ভুট্টো দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হলে, তাকে প্রস্তাব দেয়া হয়, যদি তিনি ইসরাইলকে মেনে নেন, তাহলে পাকিস্তানের সব বৈদেশিক ঋণ মাফ হয়ে যেতে পারে। ১৯৯৪ সালে জেনেভায় ইয়াসির আরাফাতের সাথে তার সাক্ষাৎ ঘটে। তিনি আরাফাতকে বলেন, ‘আমাকে বলা হচ্ছে, যদি ইসরাইলের সাথে পিএলওর আলোচনা হতে পারে, তাহলে পাকিস্তান ও ইসরাইলের মধ্যে সংলাপ কেন হতে পারবে না?’ ইয়াসির আরাফাত উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। তিনি রুদ্ধ হয়ে আসা কণ্ঠে বললেন, আমাদের মেরে মেরে ইসরাইলের সাথে আলোচনায় বাধ্য করা হচ্ছে। ইসরাইল জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাব মানতে প্রস্তুত নয়। আলোচনার মাধ্যমে স্রেফ আমাদের গোলাম বানাতে চায়। যদি পাকিস্তান ইসরাইলের সাথে বন্ধুত্ব সম্পর্ক গড়ে তোলে, তাহলে আমরা আলোচনারও যোগ্য থাকব না। এ সাক্ষাতের পরের দিন আমি ডাভিসে ইসরাইলের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিমোন প্যারেজের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি পাকিস্তানের সাথে বন্ধুত্ব সম্পর্ক স্থাপনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তবে বেনজির সরকার এ বিষয়ে লাগাম টেনে ধরেছিল।

ইসরাইলের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনের খোলাখুলি প্রচেষ্টার সূচনা হয় জেনারেল পারভেজ মোশাররফের আমলে। যদি এমন চেষ্টা নওয়াজ শরিফ অথবা বেনজির ভুট্টো করতেন, তাহলে তাদের হত্যা করাকে আবশ্যক ঘোষণা করা হতো। মোশাররফ সরকারের পক্ষ থেকে ইসরাইলের সরকারের সাথে ব্যাপকভাবে যোগাযোগকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে হট্টগোল হয়েছিল। তবে গাদ্দারি ও কুফরের সার্টিফিকেট বিতরণকারীরা নীরব থাকেন। প্রকাশ থাকে যে, ইমরান খানসহ যেসব পাকিস্তানি ইসরাইলের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপনের বিরোধী, তারা ইহুদিদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের বিরোধী নন। ইহুদিদের সাথে সম্পর্ক আর ইসরাইলের সাথে সম্পর্কের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। বহু ইহুদিও ইসরাইলের ফিলিস্তিনিদের প্রতি শত্র“সুলভ পলিসির সমালোচনা করে থাকেন। যেভাবে ভারত কর্তৃক কাশ্মির সমস্যা বিষয়ে জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবগুলো মেনে চলা হচ্ছে না, একইভাবে ইসরাইলও ফিলিস্তিন বিষয়ে জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবাবলি অমান্য করে চলেছে ক্রমাগত। ইসরাইল ২০১৭ সালে তেলআবিবের পরিবর্তে জেরুসালেমকে (বায়তুল মুকাদ্দাস) তার রাজধানী বানানোর ঘোষণা দেয়, যা জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবের স্পষ্ট পরিপন্থী। আমেরিকা তো জেরুসালেমে তার দূতাবাস স্থানান্তরের ঘোষণা করেছে, পাকিস্তান কি জেরুসালেমে নিজের দূতাবাস স্থাপন করতে পারবে? পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ইসরাইলকে স্বীকৃতি প্রদানের পর কাশ্মির বিষয়ে পাকিস্তানের অবস্থান দৃঢ় হবে, নাকি দুর্বল হবে?

পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
হামিদ মীর : পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক
পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট,
প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)


আরো সংবাদ



premium cement