২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

পার্বত্য চট্টগ্রামে সঙ্ঘাতের রাজনীতি

- ফাইল ছবি

সপ্তদশ শতক থেকে এ দেশের পার্বত্য এলাকায় অভিবাসন প্রক্রিয়া শুরু। ১৪১৮ সালে কুকিরা আরাকানি চাকমা রাজা মওয়ানৎসুনিপের অত্যাচারে বার্মা থেকে বিতাড়িত হয়ে কক্সবাজারের রামু ও টেকনাফে আশ্রয় নেয়। ১৭৭৭ সালে কুকিরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে এক ব্যর্থ বিদ্রোহ করেছিল। ১৮৬০ সালে এই পার্বত্য অঞ্চলকে চট্টগ্রাম জেলা থেকে আলাদা করে স্বতন্ত্র জেলার মর্যাদা দেয়া হয়। ১৯০০ সালে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম বিধি’ পাস এবং ১৯২০ সালে হিলট্রাকসকে ‘বিশেষ অঞ্চল’ হিসেবে ঘোষণা করে ইংরেজ সরকার।

প্রায় ৩০০ বছর আগে পাহাড়ে কর আদায় অনুষ্ঠান রাজপুণ্যাহর প্রচলন। জুমচাষের ফসল ঘরে তুলে ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে রাজপুণ্যাহ অনুষ্ঠিত হয়। বোমাং রাজবংশ মিয়ানমারের পেগু রাজবংশের উত্তরসূরি। কালের পরিক্রমায় তারা বান্দরবানে বসতি স্থাপন করেন। রাজা খাজনা আদায় ছাড়াও সামাজিক বিভেদ মীমাংসা ও ভূমিবিরোধ বিষয়ে প্রতিবেদন দিতেন।

১৮৬০ সালে পাহাড়ে প্রথম অশান্তির বীজ বপন করে ইংরেজরা। ভারতবর্ষের মতো তারা এখানেও ‘উরারফব ধহফ জঁষব’পলিসি অনুসরণ করে। ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়েল অ্যাক্টের’ মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসন চালায়। পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘অনিয়ন্ত্রিত এলাকা’ (নন-রেগুলেটেড এরিয়া) আইনের মাধ্যমে বহিরাগতদের আগমন ও স্থায়ী বসবাস বন্ধ করে পারস্পরিক ঘৃণার বীজ ছড়ায়। তারা পার্বত্য এলাকাকে তিনটি সার্কেলে বিভক্ত করে রাজা, হেডম্যান ও কারবারিদের সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থা চালু করে।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব হলে পাহাড়িদের জমি কেড়ে নেয়া এবং নানাভাবে নির্যাতন করার রীতি শুরু হয়। পাহাড়িদের ধারণা ছিল, এ এলাকা ভারত বা বার্মার অন্তর্ভুক্ত হবে। সে কারণে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট রাঙ্গামাটিতে ভারতীয় পতাকা এবং বান্দরবানে বার্মার পতাকা উত্তোলিত হয়। ১৭ আগস্ট র‌্যাডক্লিফ রোয়েদাদ অনুযায়ী, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানের অংশ হয়েছিল। পাকিস্তানিরাও বাঙালিদের সাথে পাহাড়িদের বিরোধ সৃষ্টির কৌশল নেয়। কর্ণফুলী কাগজ মিল ও কাপ্তাই বাঁধের দরুন ক্ষতিগ্রস্ত ১৮০০ পরিবারের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনে অসঙ্গতি তার দৃষ্টান্ত।

’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পাহাড়িদের অবস্থান পক্ষ-বিপক্ষ দুই দিকেই কমবেশি ছিল। চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় (রাজা দেবাশিস্ রায়ের বাবা) ও মারমা রাজা অউং শু প্রু অনুগত প্রজাদের নিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন। তবে মঙ রাজা মাং প্রু সাইন চৌধুরী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। শেষ দিকে রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তানে পালিয়ে যান। এমনকি এম এন লারমা ও সন্তু লারমা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে লড়াই করেছেন বলে হুমায়ুন আজাদের বইতে উল্লেখ আছে। ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নকালে পাহাড়িদের দাবি ছিল, পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসন ও নিজস্ব আইন পরিষদ; ‘হিল ম্যানুয়েল অ্যাক্ট’ পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও রাজাদের দফতর সংরক্ষণ।

সংবিধান কমিটি এসব দাবি গ্রহণ করেনি। ফলে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে ১৯৭২ সালের ১৬ মে জনসংহতি সমিতি এবং ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারি খাগড়াছড়ির জঙ্গলে শান্তি বাহিনী গঠন করেন। আহমদ ছফার মতে, শান্তি বাহিনী অনেকটাই চরমপন্থী বাহিনী, ‘সর্বহারা পার্টি’ দ্বারা প্রভাবিত ছিল। ১৯৭৩ সালের প্রথম সংসদে এম এন লারমা ও চাইথোয়াই রোয়াজা সংসদে নিজেদের দাবিদাওয়া পেশ করেন। ১৯৭৫ সালে ‘বাকশাল’ গঠিত হলে লারমা বাকশালে যোগ দেন। ১৯৭৫-১৯৭৭ সালে শান্তি বাহিনী সামরিকভাবে সংগঠিত হয়। অভিযোগ আছে, শান্তি বাহিনী ভারতের ত্রিপুরায় ঘাঁটি গেড়ে সেখান থেকে অভিযান পরিচালনা করত। ১৯৭৭ সালে তারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি সাঁজোয়া বহরে হামলা চালায়। এতে সেনাবাহিনী ওই অঞ্চলে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা জোরদার করে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামকে ২৪তম ডিভিশনের জিওসির অধীনে আনা হয়। এরই সূত্র ধরে আশির দশক থেকে জনসংহতি সমিতি ১৩টি পৃথক জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে ‘জুম্ম জাতীয়তাবাদ’ নামে পাহাড়িদের একটি নতুন পরিচিতি তুলে ধরে (আমেনা মহসিন)।

জিয়া সরকার ‘পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদ’ রুখতে কৌশল হিসেবে সমতল থেকে ভূমিহীনদের পাহাড়ে পুনর্বাসন করে। এতে বিচ্ছিন্নতার প্রবণতা কমলেও নতুন সমস্যা দাঁড়ায় ভূমিবিরোধ। বলা হয়, তখন সমতলের চার-পাঁচ লাখ লোক নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পাহাড়ে। তাদেরকেই বলা হয় ‘সেটেলার’। পরে তাদের ওপর হামলা হলে আলাদা গুচ্ছগ্রাম করা তৈরি করা হয়। গুচ্ছগ্রামেও হামলা হতো। বাঙালিদের সংগঠনের দাবি ছিল, পাহাড়িদের সংগঠন নিষিদ্ধ করা হোক। পাহাড়িদের পাল্টা দাবি, এসব বাঙালিকে সরিয়ে নেয়া হোক। আশির দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে তিনটি জেলা করা হয়। ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর শান্তিবাহিনীর একটি অংশের হাতে নিহত হন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। তারপর দায়িত্ব নেন তার ছোট ভাই জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় সন্তু লারমা। শান্তিবাহিনীর অব্যাহত সশস্ত্র কর্মকাণ্ডে বরকলের ভূষণছড়ায় একরাতেই চার শ’ থেকে হাজার (মতান্তরে) লোক নিহত হয়েছিল।

সশস্ত্র কর্মকাণ্ড চলাকালে এরশাদ আমলে প্রথম আলোচনা শুরু হয়। সেই সময় বেশ কিছু শান্তিবাহিনী সদস্য আত্মসমর্পণ করে। গঠিত হয় ‘স্থানীয় সরকার পরিষদ’। বিএনপির প্রথম আমলেও শান্তিবাহিনীর সাথে আলোচনা হয়। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় এলে আলোচনা ফলপ্রসূ হয় এবং ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত হয় পার্বত্য শান্তিচুক্তি। চুক্তিতে কার্যক্রম দেখার জন্য একটি উপজাতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও আঞ্চলিক পরিষদ গঠন, উপজাতিদের নির্ধারিত ভূমি ফিরিয়ে দেয়া, মালিকানা নির্ধারণে ভূমি জরিপ, চুক্তির অধীনে পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক বাহিনী ও ক্যাম্প থাকার কথা ছিল। তবে অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার করা হবে বলে জানানো হয়।

গঠিত হয় পার্বত্য জেলা পরিষদ। আত্মসমর্পণকারী শান্তিবাহিনীর সদস্যদের প্রায় ৮০০ জন পেলেন সরকারি চাকরি। বাকিদের বিভিন্নভাবে পুনর্বাসন করা হয়। শান্তিবাহিনীর রাজনৈতিক সংগঠন ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’ প্রকাশ্যে রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। চুক্তি সম্পাদনের পর পাহাড়ে স্থিতিশীলতা আসতে শুরু করলেও এ অবস্থা এক বছরও টেকেনি। এরই মধ্যে সন্তু লারমার বিরোধিতা করে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর তাদের ছাত্রসংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ প্রসিত খীসার নেতৃত্বে গঠন করে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। এর পর থেকে পাহাড়ে মেরুকরণ শুরু। সন্তু লারমার প্রতি তার দলের একটি অংশ আস্থা হারাতে থাকে।

২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে দায়িত্ব পান চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার রাজা দেবাশিস রায়। ওই সময়ই ভাঙন দেখা দেয় জনসংহতি সমিতিতে। ২০১০ সালে গঠন করা হয় ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এম এন লারমা)। ফলে বিরোধ বেড়ে ত্রিপক্ষীয় সঙ্ঘাত শুরু হয়। সম্প্রতি রাঙ্গামাটির ননিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তিনি ছিলেন সন্তু লারমার দল থেকে বেরিয়ে যাওয়া জেএসএস (এম এন লারমা) শীর্ষ নেতা। ২০১৭ সালে ইউপিডিএফও ভাঙনের কবলে পড়ে। ওই দল ভেঙে গঠিত হয় ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)। দলটির প্রতিষ্ঠাতা তপন জ্যোতি চাকমাসহ পাঁচজনকে সম্প্রতি গুলি করে হত্যা করা হয়। পাহাড়িদের চারটি সংগঠন রয়েছে। অনেকে এদের সন্ত্রাসী সংগঠনও আখ্যা দেয়। এ অঞ্চলে অস্থিরতা, হত্যা, চাঁদাবাজি ও অপহরণের জন্য এসব আঞ্চলিক দল পরস্পরকে দায়ী করে। চুক্তির পরে বাঙালিরাও সংগঠন গড়ে তোলে। তাদের সাথেও পাহাড়ি দলগুলোর তীব্র মতভেদ ও সঙ্ঘাত রয়েছে।

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেয়নি জনসংহতি সমিতি। নিজেরাই প্রার্থী দিয়ে পরাজিত হয়। দশম সংসদে রাঙ্গামাটিতে জনসংহতি সমিতির ঊষাতন তালুকদার জয়ী হন। ইউপিডিএফ (প্রসিত) ও জনসংহতি সমিতির (এম এন লারমা) মধ্যে বন্ধুত্ব যখন শত্রুতায় রূপ নিচ্ছিল, তখনই সন্তু লারমার জেএসএস ‘জানিদুশমন’ প্রসিত খীসার নেতৃত্বাধীন ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের সাথে সমঝোতা হয়। ১৯৯৭ সালের পর থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এ দুই সংগঠনের পাল্টাপাল্টি হামলায় অন্তত এক হাজার নেতাকর্মী নিহত হলেও সমঝোতার পর আর কোনো সঙ্ঘাত হয়নি।

ইউপিডিএফ (প্রসিত) থেকে বহিষ্কৃত ও বেরিয়ে যাওয়া নেতাকর্মীদের একটি অংশ ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর তপন জ্যোতি চাকমার নেতৃত্বে ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক নামে আরেকটি দল গঠন করে। নতুন দলটির সাথে সখ্য গড়ে ওঠে পর্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এম এন লারমা)। আঞ্চলিক চারটি দল ঘিরে এখন পাহাড়ি জীবন। গত বছরের মার্চে ইউপিডিএফের সহযোগী সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের শীর্ষ দুই নেত্রী দয়াসোনা চাকমা ও মন্টি চাকমাকে অপহরণ করে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)। পরে এ দুই নেত্রী মুক্তি পান।

এসব ঘটনায় শক্তিমান ও তপন জ্যোতি হয়ে ওঠেন ইউপিডিএফের (প্রসিত) মূল শত্রু। গত বছর ৩ মে জেএসএস (এম এন লারমা) কেন্দ্রীয় সভাপতি শক্তিমান চাকমাকে হত্যা করা হয়। তার ২৪ ঘণ্টা না পার না হতেই শক্তিমান চাকমার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের পথে হত্যা করা হয় তপন জ্যোতি চাকমাকে। এভাবে পাহাড়ের মেরুকরণে কয়েক দশকে হাজার হাজার মানুষ মারা গেলেও বেশ কিছু দিন কিছুটা শান্ত ছিল পরিস্থিতি। কিন্তু ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে পাহাড় উত্তাল হয়ে উঠেছে। গত উপজেলা নির্বাচনেও তার নিদর্শন পাওয়া যায়।
এ দিকে চুক্তির ২১ বছর পরে সরকার দাবি করছে, চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়েছে; ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত এবং ৯টি ধারার বাস্তবায়ন চলছে। জেএসএসের মতে, চুক্তির মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়ন হয়েছে; ১৩টি ধারা আংশিক বাস্তবায়ন হলেও ৩৪টি ধারা অবাস্তবায়িত রয়েছে।

পাহাড়ের অরাজকতা ও সহিংসতার পেছনে মূল কারণ অর্থের জোগান, আধিপত্য বিস্তার ও ক্ষমতালিপ্সা। শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন হওয়া না হওয়া নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। সবার প্রত্যাশা, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় নিরাপত্তা অটুট রেখে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করা হবে। ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও সংহতি নিশ্চিত করে সঠিক সাংবিধানিক পদ্ধতিতে হাঁটতে হবে সরকারকে। পাহাড়ি জনগণ এবং উপজাতীয় সংস্কৃতি যেন বিলীন না হয়, সে দিকেও লক্ষ রাখতে হবে। এখন আরেকটা চুক্তি করতে হবে, তা পাহাড়িদের নিজেদের সাথে নিজেদের। এ জন্য হয়তো মধ্যস্থতা করতে হবে সরকারকে।

লেখক : শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement