২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মামলার দীর্ঘসূত্রতা ন্যায়বিচারের অন্তরায়

- ফাইল ছবি

একটি আধুনিক রাষ্ট্রে আইনের শাসন কেমন তা বোঝার জন্য আইনের বড় বড় বই পড়তে হয় না। দেশটির গণতান্ত্রিক কাঠামোর চরিত্রই বলে দেয় আইনের শাসনের নমুনা কেমন। তবে গণতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদ একসাথে চলতে পারে না। কারণ এদের অবস্থান দুই মেরুতে। গণতন্ত্র মানে জনগণের শাসন। আর কর্তৃত্ববাদী শাসন হলো কোনো ব্যক্তির ইচ্ছামাফিক শাসন। গণতন্ত্রের ক্রটি-বিচ্যুতি থাকলেও গণতন্ত্রকে উদার শাসননীতি বলা হয়। যেসব দেশে গণতন্ত্র নেই সেসব দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম যেমন লক্ষ করা যায়, তেমনি গণতন্ত্রের মোড়কে কর্তৃত্ববাদী শাসনের বৈশিষ্ট্যও অনেক দেশে দেখা যায়। কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা উন্নয়নের আফিমে জাতিকে বুঁদ রেখে সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে নেয়। আইন প্রয়োগকারী বাহিনী ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে দুর্বল করে দেয় এবং বিরোধী মতাবলম্বীদের ওপর দমনপীড়নের স্টিম রোলার প্রয়োগ করতে কুণ্ঠা বোধ করে না।

গত ৪ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্য ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টসের (ডব্লিউজেপি) জরিপে দেখা গেছে বৈশি^ক আইনের শাসন সূচকে বাংলাদেশ তালিকার নিচের দিকে অর্থাৎ অবনতির দিকে যাচ্ছে। তবে এ সত্যটি ক্ষমতাসীন দল স্বীকার করতে নারাজ। ডব্লিউজেপির অনুসন্ধানে গত বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১৩টি দেশের মধ্যে ১০২তম। সংস্থাটির জরিপে চলতি বছরে নতুন আরো ১৩টি দেশ যুক্ত হয়ে মোট ১২৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২তম স্থানে এসেছে। সূচকের শীর্ষে ডেনমার্ক, নরওয়ে ও ফিনল্যান্ড। সূচকের নিচে আফগানিস্তান, কম্বোডিয়া ও ভেনিজুয়েলা। ডব্লিউজেপি সরকারের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, দুর্নীতির অনুপস্থিতি, উন্মুক্ত সরকার, মৌলিক অধিকার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা- এই বিষয়গুলোকে ভিত্তি করে সূচক তৈরি করেছে। কিন্তু এই অপরিহার্য উপাদানগুলোর প্রতি বাংলাদেশের কোনো সরকারই মনোযোগ দেননি।

মৌলিক অধিকার ও নিরাপত্তার সূচকে বাংলাদেশের ক্রমাবনতি সাধারণ মানুষকে উদ্বিগ্ন করে। অথচ সরকারের আইনমন্ত্রী ডব্লিউজেপির জরিপকে পক্ষপাতমূলক হিসেবে অভিহিত করেছেন। যে দেশের রাজনীতিতে বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করার অধিকার নেই, সে দেশে জনগণের মৌলিক অধিকার নিয়ে উচ্চবাচ্য করার সাধ্য কার? যারাই ক্ষমতায় থাকে তারা দেশী বা বিদেশী কোনো সংস্থার সূচকে ইতিবাচক থাকলে লুফে নেয়। এমনকি ঢোল পিটিয়ে প্রচার করে। কিন্তু সূচকে নেতিবাচক থাকলে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। সত্যকে গ্রহণ করতে যেমন হৃদয় কাঁপে তেমনি মিথ্যার আশ্রয় নিতেও কুণ্ঠা বোধ করে না। এটাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবেচেয়ে বড় দেউলিয়াত্ব।

মামলার জট কিংবা নিষ্পত্তিহীন মামলার সংখ্যাটা বড় ব্যাপার নয়। সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি তা হচ্ছে, মামলার দীর্ঘসূত্রতা বাদি ও বিবাদি উভয়ের জীবনকেই বিষিয়ে তোলে। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় বছরের পর বছর একজন নির্দোষ মানুষকেও জেলখানার বন্দিজীবন কাটাতে হয়। যে কেউ অপরাধী হলে চূড়ান্তে বিচারে তার শাস্তি হবে এটাই তো স্বাভাবিক? কিন্তু চূড়ান্ত বিচার হওয়ার আগেই কাউকে আটকে রাখা কি জুলুম নয়! মামলার কারণে মানুষের জীবন থেকে যে মূল্যবান সময় হারিয়ে যাচ্ছে তা পৃথিবীর কোনো ব্যাংক নোট দিয়ে কি শোধ করা সম্ভব? মানুষের অধিকার যখন ভূলুণ্ঠিত হয় তখন মানুষ ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় আদালতের শরণাপন্ন হয়। কিন্তু আদালতের কাছ থেকে কাক্সিক্ষতমানের সেবা মানুষ কতটুকু পাচ্ছে তা দেখার বিষয়। দৈনিক সমকালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, মাত্র এক বছরে দুই লাখ ১৫ হাজারের বেশি নতুন মামলা অনিষ্পন্ন রয়ে গেছে। সব মিলিয়ে অনিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা এখন প্রায় ৩৬ লাখ।

দেশে ফৌজদারি মামলার সংখ্যা ও মামলার জট কেন বাড়ছে তা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। সামাজিক মূল্যবোধ ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে মামলার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। পাশাপাশি মামলার জট বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে বিশেষ কতগুলো কারণ নিহিত রয়েছে। যেমন : মামলার তদন্ত রিপোর্ট দিতে দেরি হওয়া, সাক্ষীর অনুপস্থিতি, সাক্ষ্যগ্রহণে বিলম্ব, দীর্ঘ সময় নিয়ে শুনানি মুলতবি ও উচ্চ আদালতে মামলার অনুপাতে বিচারক ও বেঞ্চ সঙ্কট, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর জুলুম-নির্যাতনে মামলার সংখ্যা বাড়ছে। একশ্রেণীর পুলিশের অতি উৎসাহী মনোভাবের কারণে মামলার সংখ্যা বাড়ছে। দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে দেখা যায় বাদি বা বিবাদি সারা জীবন ধরে এমনকি বংশপরম্পরায় মামলা চালিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে। তবে ফৌজদারি মামলা বেড়ে যাওয়ার পেছনে যতগুলো কারণ নিহিত রয়েছে তার মধ্যে প্রধানতম কারণ হলো ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা সব সরকারেরই আমলে কম-বেশি আজ্ঞাবহ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। অধস্তন আদালত থেকে উচ্চ আদালতে আসার পর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও মামলাগুলো নিষ্পত্তি হয় না বিচারক সঙ্কটের কারণে। বাংলাদেশে মামলার তুলনায় বিচারকের সংখ্যা খুবই কম। প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য বিচারক মাত্র একজন। পরিসংখ্যানে দেখা যায় বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখ লোকের বিপরীতে যেখানে বিচারক ১০ জন, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রে ১০৭ জন, কানাডায় ৭৫ জন, ইংল্যান্ডে ৫১ জন, অস্ট্রেলিয়ায় ৪১ জন এবং ভারতে ১৮ জন। এসব কারণে বিচারপ্রার্থী মানুষ যথাসময়ে বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

একটি মামলা দীর্ঘায়িত হওয়ার পেছনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভূমিকাও থাকে। ইচ্ছাকৃত না হলেও একটি মামলা ঝুলে থাকা মানে মামলাজট আরো প্রকট হওয়া। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের ভেবে দেখা প্রয়োজন। কোনো মামলা ইচ্ছাকৃতভাবে ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে কি না তা উচ্চ আদালতের খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

গত ২৭ মার্চ দৈনিক যুগান্তরের শেষ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত হয়েছে সুপ্রিম কোর্ট থেকে গায়েব হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ নথি। ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে যদি নথি গায়েব হয়ে যায় তাহলে তো মামলার জট বাড়বেই। পত্রিকাটির রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, প্রায়ই গুরুত্বপূর্ণ মামলার নথি উধাও এবং ইচ্ছে করে নথি লুকিয়ে রাখা হচ্ছে। টাকা দিলে তা বের করে দেয়ার অভিযোগও আছে। মামলার নথি এভাবে উধাও হয়ে যাওয়ায় বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। মামলার ফাইল গায়েব হলে বিচারপ্রার্থী যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে তেমনি ন্যায়বিচার থেকেও বঞ্চিত হবে। সে জন্য সংশ্লিষ্ট মহলের উচিত নিম্ন আদালত থেকে যত ফাইল ঊর্ধ্বতন আদালতে যাবে তা স্ক্যান করে মামলার তারিখ বাদি বিবাদির নামে ইমেল ইস্যু করে ঊর্ধ্বতন আদালতে পাঠানো। যাতে করে হার্ডকপি হারিয়ে গেলেও ডাটা বের করা সম্ভব হয়।

২০১৮ সালের মাঝামাঝি সুপ্রিম কোর্টও মামলাজট নিরসনে দেশের সব নিম্ন আদালত ও ট্রাইব্যুনালকে পাঁচ বছরের অধিক পুরনো মামলা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছেন। ওই সময় সুপ্রিম কোর্টের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় দেশের অধস্তন আদালতগুলোতে বর্তমানে ২৮ লাখেরও বেশি মামলা বিচারাধীন এবং ক্রমেই এই মামলার জট বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিচারাধীন মামলার মধ্যে পাঁচ বছরের অধিক পুরনো মামলার সংখ্যাও কম নয়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অধঃস্তন আদালতগুলো যথাযথভাবে পালন করলে মামলার জট অনেকাংশে কমে যেত।

গত ২১ জানুয়ারি দৈনিক ইনকিলাবে মুদ্রিত হয়েছে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৫,০৭,৮৯৮টি। এর মধ্যে ওই বছরের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রুজু করা মামলার সংখ্যা ৫৪,৫৪৫টি। এর মধ্যে দেওয়ানি মামলার সংখ্যা হচ্ছে ১৩,৯৭,৩৫৪টি, ফৌজদারি মামলার সংখ্যা হচ্ছে ১৯,৬৭,১৬৫টি এবং অন্যান্য মামলার সংখ্যা হচ্ছে ৮৮,৮৩৪টি। তবে আইন মন্ত্রণালয়ের ভাষ্যমতে, দেশের নিম্ন আদালতে বিচারাধীন ফৌজদারি মামলার সংখ্যা হচ্ছে ১৭ লাখ ১১ হাজার ৬১৮টি। তবে দুই লাখ ২৯ হাজার ৭৭৪টি মামলা বিগত পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন রয়েছে। মামলা নিষ্পত্তি করার সময়সীমা দেয়া থাকলেও বছরের পর বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও মামলার নিষ্পত্তি সম্ভব হচ্ছে না।

হাইকোর্টে আগাম জামিনের জন্য গাঁওগেরাম থেকে আসা হাজারো মানুষের করুণ ছবি পত্রিকা খুললেই দেখা যায়। মামলার সংখ্যা বেড়ে যাওয়া নিশ্চয় সুলক্ষণ নয়; বরং বলা চলে কুলক্ষণ। আইনের শাসনের ব্যত্যয় ঘটলেই মামলার সংখ্যা বেড়ে যায়। সবাই যদি আন্তরিকভাবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ দুর্নীতিকে না বলতে পারি তাহলে মামলার জট অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মহল উদ্যোগী ভূমিকা পালন করবে, এমনটিই দেশবাসীর প্রত্যাশা।


আরো সংবাদ



premium cement