‘খুঁটি’ সমাচার
- সারওয়ার মো: সাইফুল্লাহ্ খালেদ
- ০৯ এপ্রিল ২০১৯, ১৭:৫৮
‘খুঁটি’ শব্দটির সাথে পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। আমার সর্বজন শ্রদ্ধেয় পুণ্যাত্মা নিঃসন্তান বড় চাচাকে দেখতাম জলচৌকিতে বসে আটচালা ঘরের মাঝের খুঁটিতে হেলান দিয়ে পিতলের হুঁকা কাঠের নলে টেনে, আয়েশ করে তামাক সেবন করতেন। এ ঘরটি বাড়ির সামনের লম্বা দালানের পশ্চিমে তিনটি আটচালা ঘরের একটি। বাড়ির ভেতরে প্রবেশের জন্য দালানের দু’পাশে বিশাল আকৃতির দু’টি কপাটহীন খোলা গেট। দুই গেটের দুই পাশের দেয়াল বাড়িটিকে সুরক্ষিত করেছে। বাড়ির পশ্চিমপাশে জঙ্গল। আটচালা ঘরগুলোর খুঁটি ছিল প্রায় এক ফুট ব্যাসের গোলাকৃতির মসৃণ গজারি কাঠের। প্রচণ্ড ঝড়-ঝাপ্টায়ও যেন ঘরগুলো ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, এজন্য খুঁটিগুলো ছিল খুব মজবুত। এর কারণে প্রচণ্ড ঝড়-ঝাপ্টাও ঘরগুলোকে কাবু করতে পারেনি। আরো চারখানা চারচালা ঘর বাড়ির ভেতর ছিল। সেগুলোর খুঁটি অপেক্ষাকৃত কমজোর হলেও সেগুলোকেও তুমুল ঝড় কাবু করতে দেখিনি। বাঁশের খুঁটির রান্না ঘরগুলোর খুঁটির জোর কম হওয়ায় কখনো কখনো ঝড়ে ভেঙে যেতো। আমাদের বাড়ির দুই পাশে অনেকেরই বাঁশের খুঁটির ঘরেরও ওই দশা হতো। আমাদের দালানের সামনে, বাড়ির বাইরের লম্বা দুই ঘর। গোয়াল ঘরটির গজারি কাঠের খুঁটি কমজোর হওয়ায় সেটাও ঝড়-ঝাপ্টায় মাঝে মধ্যে ভেঙে পড়ত। ঝড়-বাদলে ঘর খাঁড়া রাখতে হলে খুঁটির জোর চাই। তাই ছোটবেলা থেকেই জানি, ঘর টিকে খুঁটির জোরে। এ খুঁটির নিচের অংশ মাটির নিচে পুঁতে দেয়া।
এমনো কোনো কোনো অঞ্চল আছে যেখানে ঘরের খুঁটি মাটির নিচে গেড়ে দেয়া হয় না। এ ক্ষেত্রে ঘরের ভিটি তৈরির পর খুঁটির নিচে পাথরের মজবুত পাটা রাখা হয়। এতে সুবিধা হলো, প্রচণ্ড ঝড়-বাদলে পাটার উপরের ঘরটি খুঁটিসমেত উড়ে যায় না এবং জানমালের ক্ষতি হয় না বললেই চলে। এ পদ্ধতিতে নির্মিত ঘর খুঁটির জোরেই টিকে থাকে। এই খুঁটি রক্ষকের ভূমিকা পালন করে, ভক্ষকের নয়। পক্ষান্তরে মাটির নিচে পোঁতা খুঁটির ঘর ঝড়-বাদল খুব প্রচণ্ড হলে খুঁটিসমেত ঘরটি ভিটির উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে জানমালের ক্ষতি করতে পারে। এ খুঁটি দিয়ে ঝড়ের তীব্রতাভেদে গৃহবাসী অনিশ্চিত নিরাপত্তা পেলেও গৃহের বাসিন্দা ও অস্থাবর সম্পত্তির জন্য সব সময় নিরাপদ নয়। পাটার ওপর দাঁড়ানো খুঁটিকে ঘরের বাসিন্দা ও আসবাবপত্রের নিরাপত্তার অধিক উপযোগী বললে ভুল হবে না।
আরেক প্রকার খুঁটি গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি চরাবার সময় ব্যবহার করা হয়। পশুদের ঘাসক্ষেতের সীমানার ভেতর আটকে রাখার জন্য গলায় দড়ি বেঁধে খুঁটির সাথে বেঁধে রাখা হয়। গরু-মহিষ জাতীয় পশুর মধ্যে যেগুলো বলদ তারা গোবেচারার মতো খুঁটির বাঁধন মেনে নিয়ে মাথা নত করে শান্তভাবে ঘাস খায়। তাই খুঁটিতে তেমন টান পড়ে না। ছাগল ও ভেড়ার ক্ষেত্রেও সাধারণত সে রকমই দেখেছি। তবে মাঝে মধ্যে গণ্ডগোল বাধায় ষাঁড় ও ছাগল। এরা খুঁটির বাঁধন মানতে চায় না। ষাঁড় প্রায়ই খুঁটি উপড়ে নিয়ে দৌড় দেয় এবং পাশের ক্ষেতের ফসল নষ্ট করে। ছাগল কমজোর হওয়ায় তা পারে না, তবে কুঁদে ওঠে। আশপাশের জমির ফসল খাওয়ার জন্য অথবা প্রতিপক্ষের প্রতি ক্ষেপে গিয়ে সে আস্ফালন করে বা কুঁদে। প্রতিপক্ষের শক্তি যাই হোক, সে বুঝে দড়ি ছেঁড়ার বা খুঁটি উপড়াবার সাধ্য তার নিজের নেই; তাই সে দ্বিগুণ উৎসাহে কুঁদতে থাকে। তার দড়ি ছেঁড়ার বা খুঁটি উপড়াবার যেহেতু ক্ষমতা নেই, তাই তার বিপদেরও সম্ভাবনা নেই। তাই সে কুঁদে কুঁদে ঘাড়ের চামড়া তুলে ফেলে। খুঁটিবদ্ধ ছাগলের এই কুঁদা থেকেই ‘ছাগল কুঁদে খুঁটির জোরে’ প্রবাদের উৎপত্তি। এ প্রবাদের ব্যাপ্তি মানুষের আচরণের ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে পড়ে। রূপকার্থে মানুষও ক্ষেত্র বিশেষে কুঁদে এমন খুঁটির জোরে।
মানব সমাজে বা চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে মামার জোর, চাচার জোরসহ বিভিন্ন ধরনের জোরের কথা আমরা অহরহ শুনে থাকি। এমন খুঁটির জোর থাকলে সমাজে এবং কর্মজীবনে ব্যাপক প্রভাব প্রতিপত্তি লাভ করা যায়। ইদানীং রাজনীতিতেও এ জাতীয় খুঁটির জোরের তেলেসমাতি দেখা যাচ্ছে। বাবা, মা, ভাই, বোন এবং স্বামী-স্ত্রী অনেকের ক্ষেত্রে খুঁটি শক্তি জোগাচ্ছে। এসব খুঁটির জোরে জীবনে অনেকে ঝড়-ঝাপ্টা উতরে চলা যায়। এ দেশের রাজনীতিতে হালে এর চল শুধু ব্যাপক নয়, দস্তুর মতো মহামারী আকার ধারণ করেছে। এরা নিয়ম-কানুন মানে না। ‘খুঁটি’কে সেলাম করে (রবি ঠাকুরের ভাষায়) বলার চেষ্টা করে ‘ন্যায়-অন্যায় মানিনে মানিনে, শুধু তোমারে মানি’। জীবনে তরক্কি বা সাফল্য লাভের ক্ষেত্রে খুঁটির জোরই সর্বেসর্বা। তাই সবাই হন্যে হয়ে খুঁটি লাভের সাধনায় ব্যস্ত। এটা শুধু জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রেই নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যেমন ইসরাইলের ‘খুঁটি’ যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব। এ খুঁটির জোরে ক্ষুদ্র ইসরাইল বিশাল মধ্যপ্রাচ্যকে সন্ত্রস্ত করে রেখেছে। এমনকি মাঝে মধ্যে খুঁটি উপড়ে ওরা পাশের কোনো কোনো দেশে অকারণেও অন্যায়ভাবে হানা দেয়। আন্তর্জাতিক চাপে এর মনিবেরা ‘রে রে’ করে উঠে। তখন ক্ষান্ত হয় ইসরাইল। তাইওয়ানও খুঁটির জোরে বিশাল চীনকে টেক্কা মেরে দীর্ঘদিন জাতিসঙ্ঘের ভেটো পাওয়ার ভোগ করেছিল। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এ ধরনের আরো উদাহরণ টানা যায়।
যেকোনো সভ্য দেশের সরকারের খুঁটি সে দেশের জনগণ। সরকারের এ খুঁটি পাটার ওপর নির্মিত ঘরের খুঁটির মতো। গণজোয়ারে সরকার উড়ে যায়; কিন্তু জনগণ ও তাদের স্বার্থ অক্ষুণ্ন থাকে। ব্রিটেনের গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সরকার এ রকম সরকারের আদর্শ উদাহরণ। জনগণ নামক খুঁটির জোরে সেখানে সরকার টিকে থাকে, আবার জনগণের জানমাল অক্ষুণ্ন রেখেই প্রয়োজনে সরে পড়ে। পশ্চিমা জগতের দেশগুলোর প্রায় সর্বত্রই সেরকম দেখা যায়। কিন্তু আমাদের মতো দেশের সরকার প্রায়ই মাটিতে পোঁতা খুঁটির জোরে টিকে থাকে। যখন সরকার পড়ে, জনগণের ওপর হুমড়ি খেয়ে পতিত হয়। কারণ জনগণ এদের আসল খুঁটি নয়। এদের খুঁটি হলো দলীয় কর্মী এবং রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনী। এমন কি বহির্বিশ্বের কোনো কোনো শক্তিধর দেশও তাদের খুঁটি হিসেবে কাজ করে। তাই এ ধরনের সরকার যখন পড়ে তখন রাজপথে জনগণের লাশ ও রক্তের দাগ রেখে যায়। পাটার ওপর খুঁটির ঘরের মতো গণচাপে আলগোছে উড়ে যায় না। আমাদের দেশে এ দুই ধরনের সরকারেরই উদাহরণ আছে।
নিকট অতীত ও বর্তমান সরকারের কথাই বলি। ১৯৯৬ সালে বিএনপি দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনে জিতে পরে গণরায়ের মুখে, পাটার ওপর স্থাপিত খুঁটির ঘরের মতো আলগোছে উড়ে গেছে। জনগণ বা জানমালের কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে ২০০৬ সালে বিএনপি ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার প্রাক্কালে রাজপথে রক্তপাত হয়েছে। পাটার ওপর স্থাপিত খুঁটির ঘরের মতো আলগোছে উড়ে যেতে পারেনি। আবার ২০১৪ সালের এবং ২০১৮ সালের প্রশ্নবিদ্ধ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার মাটিতে পোঁতা খুঁটির ঘরের মতো এমনভাবে গেড়ে বসেছে যে, তাদের পতন হলে নিজেদেরই ভাষায় ‘পাঁচ লাখ লোক’ মারা পড়বে। এদের খুঁটি দলীয় কর্মী বহর, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনী এবং পাশের একটি। এদের খুঁটি দেশের জনগণ নয়, কারণ ওই দু’টি নির্বাচনে জনগণকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করে তারা ক্ষমতায় এসেছেন। তাই তাদের ভয়, ক্ষমতা হারালে তাদের ‘পাঁচ লাখ লোক’ প্রাণ হারাবে। তাই শ্রমিকসহ নানাপেশার মানুষ, ছাত্র ও বিভিন্ন শ্রেণীর লোকদের অভাব-অভিযোগ নিয়ে প্রতিনিয়ত নানামুখী আন্দোলন সংগ্রাম এবং দেশব্যাপী অরাজকতার মুখে রাষ্ট্র পরিচালনায় অযোগ্যতার পরিচয় দিয়েও তারা খুঁটির জোরে জনগণকে দমন করে হলেও ক্ষমতায় টিকে আছে। এ অবস্থায়, বঞ্চিত জনগণের হা-হুতাশ করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। দেশে এটা এক অগণতান্ত্রিক শ্বাসরুদ্ধকর ব্যবস্থা, যাকে তারা গলাবাজির জোরে ‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা’ বলে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অনেকের বচন-বাচনভঙ্গি শুনলে প্রখ্যাত সাংবাদিক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার জবানিতে বলতে ইচ্ছে করে, ‘উহাদের মুখে বিলাই মুতিয়া দিয়া গিয়াছে’।
আল্লাহ্ তায়ালা এই পৃথিবী গ্রহকে খুঁটির জোরে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় সচল রেখেছেন। আল কুরআনের অন্তত ৯টি সূরা যেমন- সূরা আল হিজর ১৫-আয়াত ১৯, সূরা আন নহল ১৬-আয়াত ১৫, সূরা ত্বাহা ২০-আয়াত ১০৫-১০৭, সূরা আল আম্বিয়া ২১-আয়াত ৩১, সূরা লোকমান ৩১-আয়াত ১০, সূরা হা-মীম ৪১-আয়াত ১০, সূরা ক্বাফ ৫০-আয়াত ৭-৮, সূরা আন নাবা ৭৮-আয়াত ৬-৭ এবং সূরা কারি’আ ১০১-আয়াত ৩-৫ প্রভৃতির মধ্যে মহান আল্লাহ্ এ কথা উল্লেখ করেছেন। সূরা লোকমানে উল্লেখ আছে, ‘তিনি আকাশমণ্ডলী নির্মাণ করেছেন স্তম্ভ ব্যতীত, তোমরা যা দেখছ- তিনিই পৃথিবীতে স্থাপন করেছেন পর্বতমালা যেন এটা তোমাদের নিয়ে ঢলে না পড়ে এবং তাতে ছড়িয়ে দিয়েছেন সর্বপ্রকার জীবজন্তু’। এ খুঁটি কেয়ামত পর্যন্ত সর্বপ্রকার জীবজন্তু ও উদ্ভিদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের জন্য। কেয়ামতকালে এসব খুঁটি থাকবে না, ‘মহাপ্রলয় সম্বন্ধে তুমি কি জান? সে দিন মানুষ হবে বিক্ষিপ্ত পতঙ্গের মতো আর পর্বতগুলো হবে ধুনে ফেলা রঙিন পশমের মতো’ (সূরা কারি’আ ১০১, আয়াত ৩-৫) - সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে।
এভাবে পৃথিবীকে নিজের যাবতীয় সম্ভার নিয়ে টিকে থাকার জন্য আল্লাহ্ নির্মিত খুঁটির ওপর নির্ভর করে। আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে আল্লাহ্ ব্যতীত মানুষ যে খুঁটিকে অবলম্বন করে তার সাথে এর পার্থক্য নির্ণয় করা যায়। ইহজগতে চলার পথে আল্লাহ্কে খুঁটি মানার অর্থ আল্লাহ্ প্রদর্শিত পথই অনুসরণ করে চলা। সেটিই ইহকাল ও পরকালের জন্য কল্যাণকর। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, ‘কল্যাণ তোমার যা হয় তা আল্লাহ্র তরফ থেকে এবং অকল্যাণ যা তোমার হয় তা তোমার নিজের কারণে’ (সূরা নিসা ৪, আয়াত ৭৯)। আল্লাহ্ আরো বলেন, ‘সব কিছুই আল্লাহ তরফ থেকে। এ সম্প্রদায়ের কী হলো যে, এরা একেবারেই কোনো কথা বোঝে না!’
(সূরা নিসা ৪, আয়াত ৭৮)। কুরআন হাদিসের পথই সার্বিক মুক্ত ও কল্যাণের পথ। নতুবা ‘যারা আমার সাক্ষাতের আশা পোষণ করে না, তাদের আমি তাদের অবাধ্যতায় উদ্ভান্তের মতো ঘুরে বেড়াতে দেই’ (সূরা ইউনুস ১০, আয়াত ১১)। সুতরাং জীবনে চলার পথে আল্লাহ্কে একমাত্র খুঁটি মানাই বুদ্ধিমানের কাজ। তখন আর ইতর প্রাণী ছাগলের মতো জাগতিক খুঁটির জোরে কুঁদে কুঁদে শেষে পস্তাতে হয় না।
লেখক : অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক,
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা