২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

যেখানে সেখানে ইটভাটা নয়

- ছবি : সংগৃহীত

নগরায়ণের ফলে নতুন নতুন ইমরাত নির্মাণ হওয়াই স্বাভাবিক। আর ইমারত নির্মাণের অপরিহার্য উপাদান ইট। ইট তৈরি হয় ইটভাটায়। তবে মাত্রাতিরিক্ত ও নিয়মবহির্ভূত ইটভাটা স্থাপন দিন দিন পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পরিবেশ অধিদফতরের যে আইন রয়েছে, গুটিকয়েক ভাটা মালিক ছাড়া কেউ এর তোয়াক্কা করেন বলে মনে হয় না। দেশের নানা প্রান্তে অবাধে গড়ে উঠছে ইটভাটা। কৃষিজমি, পরিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা, বন, অভয়ারণ্য ইত্যাদি এলাকায় ইটভাটা স্থাপন নিষিদ্ধ। কিন্তু ওই সব জায়গায় গড়ে উঠছে ইটভাটা। বেশির ভাগ জায়গায় কৃষিজমিতে গড়ে উঠছে ভাটা।

এর মূলে রয়েছেন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তির প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদদ। ব্যবসায়িক মনোভাবের কারণেই নিয়ম ভেঙে গড়ে উঠেছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ইটভাটা। ফলে কৃষিজমি, পরিবেশ এবং প্রতিবেশ পড়ছে হুমকিতে। ইট তৈরির প্রধান কাঁচামাল মাটি। ভাটা মালিকেরা মাটি সংগ্রহ করছেন আশপাশের কৃষিজমি থেকে। আর টাকার লোভে জমির মালিকেরা না বুঝে ক্ষেতের উপরিভাগের ৪-৫ ফুট গভীরতায় মাটি বিক্রি করে কৃষিজমি পরিণত করছেন নিম্নভূমিতে। অথচ এটি আইন পরিপন্থী। ওই সব জমিতে প্রায় সারা বছর পানি জমে থাকায় আগের মতো দুই তিন ফসলের পরিবর্তে এখন একটি ফলনই দায় হয়ে উঠেছে। তাছাড়া বিক্রি করা মাটি বহনকারী ট্রাক্টর গ্রামগঞ্জের রাস্তা ও উপজেলা শহরের সাথে সংযোগকারী রাস্তা দিয়ে চলাচল করায় এক দিকে যেমন সড়কগুলো ভেঙে খানাখন্দের সৃষ্টি হচ্ছে; অন্য দিকে রাস্তাঘাটে চলাচলকারী পথচারী, স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী এবং গ্রামের মানুষজন মাঝে মধ্যেই দুর্ঘটনার শিকার হন।

বর্ষাকালে এসব সড়কে চলাচলকারী লোকজনের দুর্ভোগের সীমা পরিসীমা থাকে না। তাছাড়া ট্রাক্টর চলাচলে সৃষ্ট ধুলাবালি ও কালো ধোঁয়ায় অনেকেই শ্বাসকষ্টসহ নানা রকম অসুখে পড়ছেন। এসব দেখেও যেন নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন।

 

পরিবেশ অধিদফতরের আইন অনুযায়ী, ইটের ভাটায় জ্বালানি হিসেবে কয়লা ব্যবহারের কথা বলা হয়ে থাকলেও অনেক জায়গাতেই প্লাস্টিক বর্জ্য পোড়ানো হচ্ছে। কয়লার দাম বাড়ায় স্থানীয় ভাটা মালিকেরা জ্বালানি খরচ কমিয়ে আনতে কয়লার সাথে বিপুল পরিমাণে বর্জ্য প্লাস্টিক ব্যবহার করছেন। এতে করে সরকারের পরিবেশবান্ধব ইটভাটা স্থাপনের পরিকল্পনা ব্যাহত হচ্ছে। তবে প্লাস্টিকের আগুন থেকে নির্গত ধোঁয়ায় পরিবেশগত ক্ষতি বেশি। ইটভাটার নির্গত কালো ধোঁয়া মানুষের ফুসফুসের জন্য হুমকি। ইটভাটার কালো ধোঁয়া থেকে কার্বণ নিঃসরণ হওয়ায় বায়ুমণ্ডলে এক ধরনের গ্যাসের সৃষ্টি হয়, যা প্রাণ ও প্রকৃতিক জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি। তাছাড়া কার্বন নিঃসরণে পরিবেশ হুমকিতে পড়ছে। এরও অন্যতম কারণ ইটভাটার নির্গত কালো ধোঁয়া।

বুয়েটের এক গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে পরিবেশ অধিদফতরের স্থানীয় সূত্র জানায়, দেশের বায়ুদূষণে শতকরা ৩৫ ভাগের জন্য দায়ী ইটভাটা। কৃষিজমি, পাহাড়, টিলা থেকে মাটি কেটে ইটের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও দেশের দক্ষিণাঞ্চল ও পার্বত্য এলাকার ইটভাটার মালিকেরা তাই করছেন। জ্বালানি হিসেবে গাছ ও ডালপালা ব্যবহার করছেন।

ফলে সেখানকার পরিবেশ ও প্রাণীবৈচিত্র্য পড়েছে হুমকিতে। বিভিন্ন এলাকায় নীতিমালা লঙ্ঘন করে বাংলা ড্রাম চিমনি ও পাকা চিমনির মাধ্যমে কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো হচ্ছে। এমনকি কোনো ধরনের চিমনি ছাড়াও ইট পোড়ানো হয়। ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩-এ হাইব্রিড হফম্যান, জিগ-জ্যাগ, ভার্টিক্যাল শ্যাফট কিলন অথবা পরীক্ষিত নতুন প্রযুক্তির পরিবেশবান্ধব ইটভাটা করার কথা থাকলেও এ আইন অমান্য করা হচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন অথবা পরিবেশ অধিদফতরের কোনো তৎপরতা নেই বললেই চলে। তাছাড়া ওই সব ভাটার বেশির ভাগ মালিক সরকারের নির্ধারিত ভ্যাটও পরিশোধ করছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। পরিবেশ অধিদফতরের নির্দেশনা মোতাবেক ইটভাটাগুলোতে ১২০ ফুট উচ্চতার ফিল্টারযুক্ত চিমনি লাগানোর কথা থাকলেও খুব কম মালিক এ আইন মানছেন। কম উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ফিল্টারবিহীন চিমনি থেকে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়ায় ভাসমান বস্তুকণা কার্বন-মনোঅক্সাইড ও সালফার-ডাইঅক্সাইড বাতাসে মিশে পরিবেশ দূষিত করছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী দেশে ইটভাটার সংখ্যা ছয় হাজার ৯৩০টিরও বেশি। বছরে দেশে ইটের চাহিদা দেড় হাজার কোটি। এ ইট প্রস্তুত করতে ১২৭ কোটি সিএফটি মাটির দরকার হয়। যার বেশির ভাগই কৃষিজমি থেকে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে।

তবে আশার কথা, পরিবেশ দূষণ কমিয়ে ইটের চাহিদা পূরণে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২০ সালের মধ্যে ইট তৈরিতে মাটির ব্যবহার শূন্যের কোটায় নামিয়ে এনে বিকল্প কাঁচামাল ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হয়েছে। ইটভাটা পরিবেশ দূষিত করে এটা যেমন সত্য; ঠিক তেমনিভাবেই প্রায় সব ধরনের নির্মাণ কাজেই আমরা ইটের ওপর নির্ভরশীল। তাই পরিবেশ সংরক্ষণ যেমন জরুরি, তেমনি ইটের প্রয়োজনীয়তাও অস্বীকার করা যায় না।
প্রাণিজগৎ ও পরিবেশকে দূষণ থেকে রক্ষা করতে শুধু আইন প্রণয়ন নয়, বরং এর সঠিক প্রয়োগে সরকারকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

লেখক : প্রকৌশলী
ই- মেইল : হধুসঁষযঁংংবহ@ুধযড়ড়.পড়স


আরো সংবাদ



premium cement