২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

নির্বাচনে জয়ের জন্য দুই রকম পন্থা কেন?

-

১৯৮২ সাল থেকে অদ্যাবধি যে তিনটি দল দেশ শাসন করেছে এবং এখনো করছে, তারা সরকারি দলে থাকাকালে নির্বাচনে জয়লাভের জন্য একরকম পন্থায় বিশ্বাস করেন, বিরোধী দলে থাকাকালে সম্পূর্ণ বিপরীত পন্থা বিশ্বাসী কেন? তাদের এই দুই রকম পন্থার অনুসরণের কারণে নাকাল এ দেশের জনগণ। সামরিক শাসক এরশাদের অধীনে ৭ মে ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচন ও ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ সংসদ নির্বাচন এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন একই পন্থায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে দুই বছর বয়সী জাপার কাছে ৩৭ বছর বয়সী আওয়ামী লীগের পরাজয় ঘটেছিল। এ কারণে ১৯৮৮ সালের নির্বাচন অন্যান্য দলের সাথে আওয়ামী লীগও বর্জন করেছিল। তবে এরশাদ ওই নির্বাচনে যে পন্থার অনুসরণ করেছিলেন, তারই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে। রাজনীতির এই খেলার নির্মম পরিহাস হচ্ছে- ২০১৪ সালে ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ ও সহযোগী হিসেবে ছিল জাপা। নির্বাচনী রাজনীতির এই খেলা থেকেই বর্তমান সঙ্কটের উদ্ভব ঘটেছে।

১৯৯০ সালের গণ-আন্দোলনে এরশাদের পতনের পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহম্মদের নেতৃত্বাধীন অস্থায়ী সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে সবাইকে অবাক করে দিয়ে বর্তমানের মতো ‘ভাঙাচোরা’ বিএনপি আওয়ামী লীগ পরাজিত করে সরকার গঠনে সক্ষম হয়েছিল। কথিত আছে, ১৯৮৬-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ জনগণের কাছে মনোপূত ছিল না বিধায় ১৯৯১ সালের নির্বাচনে এরূপ ফলাফল হয়েছিল। ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে বিরোধী দল থেকে নির্বাচনের আগেই নিজেদের জয় নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগ, জাপা ও জামায়াতসহ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ১৯৯৪ সালেই সংসদ থেকে পদত্যাগ করে ১৯৯৬ সালের মার্চ পর্যন্ত ১৭৩ দিন হরতাল পালন করেছিল।

এ ছাড়া মহিউদ্দিন খান আলমগীরের নেতৃত্বে সরকারি কর্মচারীদের ‘বিদ্রোহ’ ঘটিয়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে নির্বাচিত বিএনপি সরকারকে ওই দাবি মেনে ৩০ মার্চ ১৯৯৬ পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। ’৯৬ সালের ১২ জুন সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪৬, বিএনপি ১১৬, জাপা ৩২, জামায়াত দুই, জাসদ রব এক ও স্বতন্ত্ররা তিনটি আসনে জয়ী হয়। এরপর আওয়ামী লীগ, জাপা এবং জাসদ রব কোয়ালিশন সরকার গঠন করে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকলেও তাদের আসন সংখ্যা ২০০-এর কম হওয়ায় সংবিধান সংশোধন করতে সক্ষম হয়নি। ফলে ১৯৯৬-০১ শাসনামল খুবই অস্বস্তিতে কাটে। ২০০১ সালের নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান ছিলেন তাদের নিয়োগকৃত প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান। নির্বাচন কমিশনও তাদের নিয়োগকৃত ছিল।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন গোপালগঞ্জের লোক এবং সাবেক সিএসপি আবু সাঈদ, আর রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহম্মেদ। সে নির্বাচনে পরাজিত হয়ে কারচুপিপূর্ণ নির্বাচনের অভিযোগে প্রধান উপদেষ্টা ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে অভিযুক্ত করে ওই নির্বাচনের ফলাফল বাতিলের জন্য তৎকালীন রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ জানিয়েছিল আওয়ামী লীগ। রাষ্ট্রপতি তা প্রত্যাখ্যান করায় তাকে ‘বেঈমান’ বলা হয়েছিল। এক বছর পর তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ওই নির্বাচনে বিএনপিকে ভারতের ‘র’ ক্ষমতায় এনেছে মন্তব্য করেন। ২০১৭ সালের মার্চে ফার্মগেটে যুব মহিলা লীগের সম্মেলনে এবং মাগুরার একটি জনসভায় তিনি একই কথা বলেছেন।

২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিরোধী দলে থাকাকালে ২০০৭ সালের প্রস্তাবিত নির্বাচনে সংসদের ২০০ আসনে জয় নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচনকালীন পরিবর্তনের জন্য হরতাল, অবরোধ ও ভাঙচুরের আন্দোলনের মাধ্যমে জেনারেল মইনের ওয়ান-ইলেভেন নাটকের প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয়েছিল। এ নাটক সফলভাবে মঞ্চস্থ করায় ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৬৫টি আসন দখল করা সম্ভব হলো। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়ে ভবিষ্যতে যাতে নির্বাচনে পরাজয়বরণ করতে না হয়, সেজন্য ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে জয় নিশ্চিত করতে ৩০ মাস আগেই ৩০ জুন ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকারের খোলনলচে পাল্টে ফেলে। যেমন ‘নির্বাচনকালীন সরকার হতে হবে দলীয় এবং এমপিরা স্বপদে বহাল থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন’ অথচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়রদের পদত্যাগের আইন তারাই পাস করেছেন।

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ-জাপা বিরোধী দলে থাকলে নির্বাচনকালীন সরকার হতে হবে ‘শতভাগ নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ’ আর ক্ষমতাসীন থাকলে হতে হবে ‘শতভাগ দলীয়’। এই দ্বৈতনীতিই দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টির মূল কারণ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের জন্য সুপ্রিম কোর্টের যে রায়ের কথা বলা হয়, ওই রায়ে দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টার পদে বিচারবিভাগ বহির্ভূত কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বকে নিয়োগের ভার সংসদের ওপর অর্পণের উল্লেখ ছিল। ১৪ দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ’৯৪ সালে পদত্যাগ করে হাইকোর্টে রিটের মাধ্যমে ওই পদত্যাগপত্র স্পিকারকে গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিল। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের প্রস্তাব সংসদে উত্থাপন এবং এর পক্ষে ভোটদানের সুযোগ ১৪ দলের ছিল না।

এই প্রেক্ষাপটে প্রধান বিচারপতি ১১ মে ২০১১ সালে তার কাস্টিং ভোটে, চার-তিন সংখ্যাগরিষ্ঠতার রায়ে তা উল্লেখ করেছিলেন। যে চারজন বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন, তারা ’৯৪-’৯৬ সালে ওই দাবিতে আওয়ামী লীগের সাথে আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। ওই সময় তারা কেউই বিচারপতি ছিলেন না। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ তাদের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয় এবং ২০০৯ সালে পুনরায় ক্ষমতায় গিয়ে তাদের পদোন্নতি দিয়ে আপিল বিভাগে নিয়োগ দেয়া হয়। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল সংক্রান্ত রিটের আপিল শুনানিতে তাদের অংশগ্রহণ সুপ্রিম কোর্টের রেওয়াজ বিরোধী বলে জানা যায়।

এখন ক্ষমতাসীনদের বুলি হচ্ছে- ‘সংবিধান মোতাবেক সব ক্ষমতার মালিক জনগণ।’ তারা শুধু ‘জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে সেই ক্ষমতা জনগণের কল্যাণে প্রয়োগ করছেন।’ বলা হচ্ছে- যা কিছু হবে সংবিধান মোতাবেক হতে হবে এবং ২০০১ সালের মতো নির্বাচন আর হবে না।’ আসলে তারা ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়ী হতে পারেননি, তাই ওই রূপ নির্বাচন তাদের কাম্য নয়। কিন্তু ১৯৯৬ সালের ১২ জুন বা ২০০৮ সালের নির্বাচনে তো তারা নিজেরাই জয়ী হয়েছেন। ওই দু’টি নির্বাচনের কথা উল্লেখ করা হয় না কেন? ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অন্তত ওই রূপ হলে আজকে সঙ্কট দেখা দিতো না এবং আগামী নির্বাচন অনুরূপ করার ঘোষণা দিলে রাজনৈতিক উত্তাপের পারদ নিম্নগামী হতো পারে। ক্ষমতায় থাকতে নির্বাচনকালীন সরকারের তরিকা এক রকম আর বিরোধী দলে থাকলে অন্য রকম হতে পারে না। উভয় দল থেকে পাঁচজন করে ১০ সদস্যের নির্বাচনকালীন সরকার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠনের জন্য স্যার নিনিয়ানের ’৯৪ সালে প্রদত্ত প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, ওই রূপ ফায়সালা যাতে কার্যকর না হতে পারে, তজ্জন্য ১৯৯৪ সালের সংসদ থেকে কারা পদত্যাগ করেছিলেন?

রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্ব পালন করলে ‘নির্বাচন প্রভাবিত হবে’ বলে জেনারেল মইনকে ক্ষমতা দখলের সুযোগ দেয়া হলো। অথচ বিশেষ দল বা জোটের সরকার ও এমপিরা ক্ষমতায় থেকেই নির্বাচন করলে ‘নির্বাচন প্রভাবিত হবে না’- এটা কোন ধরনের যুক্তি? বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ২০১৩ সালের ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি সাথে সাক্ষাৎ করে রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে তাকে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার অনুরোধ জানায়। জবাবে তিনি জানান, সংবিধান তাকে সেই ক্ষমতা দেয়নি। দেশের নাগরিকদের সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার যা প্রতি পাঁচ বছর অন্তর তারা একদিন পায়, সে অধিকার রক্ষার ক্ষমতা সংবিধান যদি রাষ্ট্রপতিকে না দেয়, তা হলে ওই সংবিধান জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষায় কোনো কাজে আসবে কি? নির্বাচন নিয়ে জনগণকে ‘হাইকোর্ট ও সংবিধান দেখানো’ তো বর্তমান ক্ষমতাসীনেরা ’৯৪ সালে শুরু করেছেন।

বিরোধী দলে থাকাকালে যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সংসদ থেকে পদত্যাগ করা বৈধ হয়, তা হলে ক্ষমতায় থাকাকালে তা বাতিল করা বৈধ হতে পারে কোন নৈতিক যুক্তিতে? বিরোধী দলে থাকাকালে ওই দাবিতে ১৭৩ দিন হরতাল পালন গণতান্ত্রিক ‘অধিকার’ হলে সাম্প্রতিক কোটাবিরোধী আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্র’ হতে পারে কিভাবে? সরকারের সমর্থক ব্যতীত আর সবাই যদি নাশকতাকামী, ষড়যন্ত্রকারী, রাষ্ট্রবিরোধী, মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবী হয়ে থাকে, তাহলে তার দায় কি সরকারের ওপরও বর্তায় না। কারণ একটানা ১০ বছর ‘সুশাসন’ চালানো হলে তো এমনটা হওয়ার কথা নয়। ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে দু’টি বাসের পাল্লায় স্কুল ও কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনার প্রতিবাদে কিশোর ছাত্রছাত্রীদের গড়ে তোলা আন্দোলনে ভীত সরকার কেন তাদেরও প্রতিপক্ষ ভেবেছে? কারণ একটাই, সুষ্ঠু নির্বাচনে যাতে ক্ষমতা হাত থেকে চলে না যায়।


আরো সংবাদ



premium cement
গাজায় সাহায্য বাড়াতে ইসরাইলকে নির্দেশ আইসিজের দিল্লি হাইকোর্টে কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে জনস্বার্থ মামলা খারিজ বস্ত্র-পাট খাতে চীনের বিনিয়োগ চায় বাংলাদেশ জামালপুরে সাব রেজিস্ট্রারকে হত্যার হুমকি মামলায় আ’লীগ নেতা গ্রেফতার গাজায় অনাহার যুদ্ধাপরাধ হতে পারে : জাতিসঙ্ঘ ‘প্রত্যেককে কোরআনের অনুশাসন যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে’ মতলব উত্তরে পানিতে ডুবে ভাই-বোনের মৃত্যু প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের শেষ ধাপের পরীক্ষা শুক্রবার লম্বা ঈদের ছুটিতে কতজন ঢাকা ছাড়তে চান, কতজন পারবেন? সোনাহাট স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করলেন ভুটানের রাজা বছরে পৌনে ৩ লাখ মানুষের মৃত্যু দূষণে

সকল