২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বাংলাদেশের কী লাভ?

-

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি নয়া দিগন্তে ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের প্রসঙ্গে শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক এবনে গোলাম সামাদের একটি উপসম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছে। ওই কলমের এক জায়গায় তিনি লিখেছেন ‘১৯৬২ সালে চীন হিমালয় সীমান্তে ভারতকে আক্রমণ করে।’ গত ৩ মার্চ লেখকের ওই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন একজন পাঠক। যা হোক, বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের গুরুত্ব অপরিসীম। ভারতের অরুনাচল প্রদেশকে চীন নিজেদের বলে দাবি করছে। হিমালয় অঞ্চলে চীন ও ভারতের সীমান্তবিরোধের মীমাংসা আজো হয়নি।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যদি চীন এবং ভারতের মধ্যে আবার যুদ্ধ বাধে তাহলে বাংলাদেশের মাটি ও আকাশ বাংলাদেশের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ‘বাফারল্যান্ড’ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে ব্যাপক। এদিকে চীনের মদদপুষ্ট মিয়ানমার রোহিঙ্গা নিধন ও বিতাড়নের পাশাপাশি সেন্টমার্টিন দ্বীপকে নিজেদের দেশের অন্তর্ভুক্ত বলে দাবি করে বাংলাদেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে রেখেছে। বাংলাদেশের জন্য পরিস্থিতি ক্রমেই উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। সর্বোপরি, কাশ্মিরের পুলওয়ামার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান বিমানযুদ্ধের ফলে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে উপমহাদেশ। এই প্রেক্ষাপটেই ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধের প্রসঙ্গ আলোচিত হওয়ার দাবি রাখে।

সে যুদ্ধে ভারত পরাজিত হয়েছিল। চীনা ফৌজ ভারতের অরুনাচল প্রদেশসহ অনেকখানি জায়গা দখল করে নিয়েছিল এবং পাঁচ হাজার ভারতীয় সৈন্য আটক করেছিল। পরে পরাজয় মেনে শান্তি চুক্তিতে সই করে ভারত বেদখল হওয়া ভূখণ্ড ও বন্দী সেনাদের ফেরত পায়। এই অসম্মানজনক পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল ভারতের জিওসি ইস্টার্ন কমান্ড লেফটেন্যান্ট জেনারেল হেন্ডারসন ব্রুকসকে। তিনি যথাসময়ে রিপোর্টটি পেশ করেন। ওই রিপোর্টে তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী কৃষ্ণ মেনন, চিফ অব জেনারেল স্টাফ ইন আর্মি হেডকোয়ার্টার্স জেনারেল বিএম কল, আর্মি চিফ জেনারেল প্রাণনাথ থাপার এবং খোদ প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরুর হীনতাব্যঞ্জক ভূমিকার বিষয়ে উল্লেখ ছিল। ওই রিপোর্ট- বিশেষ করে নেহরুর ভূমিকার বিষয়টি গোপন রাখার জন্য এবং সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে যাওয়ার দোহাই দিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে ‘ক্লাসিফাইড’ ফাইল হিসেবে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। দীর্ঘ বায়ান্ন বছর পরে ২০১৪ সালে ওই রিপোর্ট ইন্টারনেটে ফাঁস হয়ে যায়। তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের অনেক দূরভিসন্ধিমূলক কার্যকলাপের বিবরণ ওই রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে।

বিশেষ করে পুনরায় আলোচনায় এসেছিল ‘নেহরু ডকট্রিন’ এর বিষয়টি। ইতিহাস ও রাজনীতি সচেতন সবাই ‘নেহরু ডকট্রিন’ সম্পর্কে অবগত আছেন। এখানে শুধু এইটুকু বলা যায় যে, ‘নেহরু ডকট্রিন’এর মূল কথা হলো আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকে শুরু করে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশসহ সমগ্র উপমহাদেশ এবং মিয়ানমার থাইল্যান্ড হয়ে সুদূর লাওস ও কম্বোডিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূভাগকে ভারতের পতাকাতলে এক করে দিল্লির মসনদে বসে একটি বিশাল ‘সাম্র্রাজ্য’ শাসন-শোষণ করা। মনে করা যায়, এ লক্ষ্যেই ১৯৬২ সালে চীনের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল ভারত। অস্ট্রেলীয় সাংবাদিক নেভিল ম্যাক্সওয়েল ষাটের দশকে রচিত ‘ইন্ডিয়াস চায়না ওয়ার্স’ গ্রন্থে এই যুদ্ধের বিষয়ে সম্যক আলোচনা করছেন। তথ্য-উপাত্ত পেশ করে তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, চীন কখনোই প্রথমে ভারতের বিরুদ্ধে অস্ত্র প্রয়োগ করেনি। বরং জওয়াহেরলাল নেহরুর 'ill conceived forward policy'-ই এই যুদ্ধের জন্য দায়ী। নেহরুর ওই নীতির নেপথ্যে ছিল তার ‘ডকট্রিন’।

বর্তমানে ভারতীয় থিংক ট্যাংকদের অনেকেই মনে করেন, নেহরুর মস্তিষ্কে এই আগ্রাসী ধারণার উদ্ভব হয়েছিল দুইজন কুশীলবের ক্রমাগত প্ররোচনার ফলে। তারা হলেন- চিফ অব জেনারেল স্টাফ ইন আর্মি হেডকোয়ার্টার্স জেনারেল বি এম কল এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভিকে কৃষ্ণ মেনন। শেষোক্তজনে প্রতি নেহরুর ছিল অন্ধ বিশ্বাস। এই বিশ্বাসকে হাতিয়ার করে মেনন হয়ে উঠেছিলেন অহঙ্কারী, ক্ষমতাশালী ও দুর্নীতিপরায়ণ। সেই সময়ের খবরের কাগজে মেনন সম্বন্ধে লেখা হতো 'A man of monumental arrogance'। মূলত মেননের বুদ্ধিতে চলতে গিয়েই নেহরু চীনের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। ওই যুদ্ধে ভারত শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। নেহরু বাকি জীবন এই পরাজয়ের আগুনে দগ্ধ হয়েছেন।

১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধে চীন পরাজিত হলে ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে যেত। হয়তো মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলো বিলীন হয়ে যেত ভারতীয় সাম্রাজ্যে। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে চীন উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হতে থাকলে এবং জাতিসঙ্ঘের ভেটো পাওয়ার অর্জন করলে ভারত আর সেই পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার কথা ভাবতে সাহস পায়নি। চীনকে ডিঙিয়ে মিয়ানমার অভিযান অসম্ভব। কারণ মিয়ানমারের ‘রক্ষাকর্তা’ স্বয়ং চীন। পূর্ব দিকের থাইল্যান্ড লাওস কম্বোডিয়া আরো দূরের দেশ। চীনের শক্তিমত্তার কথা মাথায় রেখে ভারতীয় থিঙ্ক ট্যাঙ্করা সে দিকে অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনা মুলতবি রেখেছেন। মধ্যখানে অবস্থিত, মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশকে পাকিস্তানের পরেই 'second concern' হিসেবে ভারত গণ্য করে। তাই বাংলাদেশের রাজনীতি বিদেশনীতি অর্থনীতি ইত্যাদি সব কিছুতেই কর্তৃত্ব ফলানোকে তার একটা দায়িত্ব মনে করে।

এই লক্ষ্যেই ভারত অতীতে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিপথগামীদেরকে অস্ত্র ও ট্রেনিং দিয়ে ‘শান্তি বাহিনী’ বানিয়ে তিন দশক ধরে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে রেখেছিল। ভারতের সাথে চুক্তি করার পরেও বাংলাদেশ শুকনো মওসুমে পদ্মায় সব সময় কম পানি পেয়েছে এবং তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় তিস্তার পানি থেকে বঞ্চিত রয়েছে। অথচ বাংলাদেশের কাছ থেকে আদায় করে নেয়া হয়েছে সর্বাধিক বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা। সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলন্ত ফেলানীকে গুলি করে মারার অনেক আগে থেকেই বিএসএফ বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা করে চলেছে। বাংলাদেশ যখন দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরাণার্থী নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে, মোদি তখন সফরে গিয়ে মিয়ানমারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বন্ধুত্ব চুক্তি করে পরোক্ষভাবে হলেও রোহিঙ্গা নিধনকে সমর্থন করে এসেছেন। তিনি মিয়ানমার থেকে ফিরতে না ফিরতেই ভারত আসামের তিরিশ লাখ বাঙালি মুসলিমকে বাংলাদেশে ‘পুশব্যাক’ করার হুমকি দিয়েছে। এখনো সেই প্রক্রিয়া চলছে।

এবনে গোলাম সামাদ ৯ মার্চ ২০১৯ তারিখে নয়া দিগন্তে তার ‘মহাচীন নিয়ে কথা’ শীর্ষক কলামে এক জায়গায় চীন কর্তৃক বাংলাদেশের রংপুর পর্যন্ত দখল করা প্রসঙ্গে লিখেছেন। তার বক্তব্যকে সম্পূর্ণ সমর্থন করে ভারতের আদৃত ও আশ্রিত বঙ্গভূমিওয়ালাদের কথাও বলা যায়। তারা এক সময় বাংলাদেশের এক-চতুর্থাংশ দখল করার ঘোষণা দিয়ে কথিত বঙ্গভূমির মানচিত্র প্রকাশ করেছিল।

২০১৪ সালে ভারতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের একনেতা বাংলাদেশের তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড ছিনিয়ে নেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। একটা কথা বলা যায়- আগ্রাসনকারীরা কোনো দিন কোনো চুক্তি, যুক্তি বা ঐতিহাসিক হিসাব-নিকাশের তোয়াক্কা করে না। তারা নির্ভর করে নিজেদের আগ্রাসী আর ধ্বংসাত্মক শক্তির ওপরে। তারা পরিচালিত হয় নিষ্ঠুরতা ও অপরিসীম দম্ভ দ্বারা। যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার এক ঝটকায় ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া হয়ে পোল্যান্ড পর্যন্ত দখল করে নিয়েছিলেন। জাপান এবং চীনের মাঞ্চুরিয়া প্রদেশ দখল মিয়ানমার অতিক্রম করে ব্রিটিশাধীন ভারতবর্ষকে পদানত করতে এগিয়ে এসেছিল। ইতিহাসে আছে এমন ভুরিভুরি নজির। বিনীত জিজ্ঞাসা, চীন-ভারত যুদ্ধে কোন দেশ প্রথমে আক্রমণ করেছিল, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা কি খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন? যেখানে দুই দেশই পরস্পরকে দায়ী করে বিষয়টাকে বিতর্কিত করে রেখেছে, সেখানে ওই প্রশ্নে অযথা বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে আমাদের কী লাভ?


আরো সংবাদ



premium cement
আমতলীতে কিশোরীকে অপহরণ শেষে গণধর্ষণ, গ্রেফতার ৩ মহানবীকে কটূক্তির প্রতিবাদে লালমোহনে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ক্রিমিয়া সাগরে বিধ্বস্ত হলো রুশ সামরিক বিমান জর্ডান আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশী বিচারক এবারের আইপিএলে কমলা ও বেগুনি টুপির লড়াইয়ে কারা সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে সন্ত্রাসনির্ভর হয়ে গেছে : রিজভী রাশিয়ার ৯৯টি ক্ষেপণাস্ত্রের ৮৪টি ভূপাতিত করেছে ইউক্রেন আওয়ামী লীগকে ‘ভারতীয় পণ্য’ বললেন গয়েশ্বর দক্ষিণ আফ্রিকায় সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে দাগনভুঞার যুবক নিহত কাশ্মিরে ট্যাক্সি খাদে পড়ে নিহত ১০ অবশেষে অধিনায়কের ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছল পাকিস্তান

সকল