২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

আলজেরিয়ায় স্বৈরশাসকের পতন কি আসন্ন

-

স্বৈরশাসকেরা আজীবন ক্ষমতায় থাকতে চায়। আজকের আলজেরিয়া তার জ্বলন্ত উদাহরণ। দেশটির ৮২ বছর বয়সী প্রেসিডেন্ট আবদুল আজিজ বুতেফ্লিকা কয়েক বছর আগে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। এমনকি তিনি কথা বলার ক্ষমতাও হারিয়েছেন বলে মনে করা হয়। তিনি কয়েক বছর ধরে জনসমক্ষে আসছেন না এবং জাতির উদ্দেশেও কিছু বলছেন না। বুতেফ্লিকা ’৯৯ সাল থেকে ক্ষমতায় রয়েছেন। আগামী এপ্রিল মাসে আলজেরিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। অসুস্থ প্রেসিডেন্ট পঞ্চম মেয়াদে প্রার্থী হতে চাওয়ায় দেশটির জনগণ ফুঁসে উঠেছে। বুতেফ্লিকার দীর্ঘ ২০ বছরের শাসনের বিরুদ্ধে গত শুক্রবার রাজধানী আলজিয়ার্সসহ দেশের বিভিন্ন শহরে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। বুতেফ্লিকার প্রার্থিতা ঘোষণার পর থেকেই আলজেরিয়ার আবালবৃদ্ধবনিতা রাস্তায় নেমে এসেছে।

জনতার বিক্ষোভ দেখেই স্বৈরশাসক বুঝতে পেরেছেন তার ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেয়াটা এবার কঠিন হবে। তাই তার পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেয়া এক ঘোষণায় প্রতিজ্ঞা করা হয়, একটি সার্বজনীন জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে কিভাবে পরবর্তী নির্বাচন করা যায় তা নির্ধারণ করা হবে। সেই নির্বাচনে বুতেফ্লিকা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। বুতেফ্লিকা মেয়াদ শেষে সসম্মানে চলে যেতে পারবেন। কিন্তু তিনি সোজা পথে না হেঁটে মনে হয় বন্ধুর পথই বেছে নিয়েছেন। সে জন্য তাকে নিঃসন্দেহে কঠিন মূল্য দিতে হবে এবং হতে পারে তিনি জনগণের নিন্দা ও ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়ে অপমানজনকভাবে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হবেন।

পেছনে ফিরে তাকালে দেখতে পাব আফ্রিকা মহাদেশের এই দেশটির ইতিহাস খুবই সমৃদ্ধ। আলজেরিয়া ১৮৩০ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ফরাসি উপনিবেশ ছিল। ১৮৭৫ সালে ফরাসি উপনিবেশবাদীরা পুরো আলজেরিয়া দখল করে নেয়। ১৮২৫ থেকে ১৮৪৭ সাল, এর মধ্যে ৫০ হাজার ফরাসি নাগরিক আলজেরিয়ায় বসতি স্থাপন করে। আলজেরিয়ার প্রকৃত নাগরিকদের জমি বাজেয়াপ্ত করে ফরাসিদের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। উপনিবেশে রূপান্তরের এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে মুসলমানদের মধ্যে অসন্তোষ ধূমায়িত হয়ে ওঠে। পরে তা বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার দাবিতে পরিণত হয়। ফরাসি সৈন্যদের বিরুদ্ধে ১৯৪৫ সালে রক্তাক্ত অভ্যুত্থান সঙ্ঘটিত হয়। জাতীয় মুক্তিফ্রন্টের নেতৃত্বে ১৯৫৪ সালে আলজেরিয়ায় স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। ওই যুদ্ধে আলজেরিয়ার লাখ লাখ নাগরিক নিহত হয়। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ২০ লাখেরও বেশি মানুষ তাদের ভিটেমাটি হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়ে। ১৯৬২ সালে অনেক ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে আলজেরিয়া স্বাধীনতা অর্জন করে।

মুক্তিফ্রন্ট নেতা আহমেদ বেনবেল্লা ছিলেন আলজেরিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট। পরে হুয়ারি বুমেদিনের নেতৃত্বে এক অভ্যুত্থানে বেনবেল্লা ক্ষমতা হারান। বুমেদিন ছিলেন বেনবেল্লারই প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। বেনবেল্লা আলজেরিয়াকে ক্রমান্বয়ে সমাজতান্ত্রিক এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে এগিয়ে নিয়েছিলেন। বুমেদিনও একই ধারা অব্যাহত রাখেন। তিনি ১৯৬২ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত দেশ শাসন করেন। আহমেদ বেনবেল্লার সরকারে বর্তমান প্রেসিডেন্ট বুতেফ্লিকা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। আলজেরিয়ার শীর্ষ কূটনীতিকের দায়িত্ব পালন করার সময় তার বয়স ছিল মাত্র ২৬ বছর। বুমেদিনের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের সময় বেনবেল্লার পাশে ছিলেন বুতেফ্লিকা। বেনবেল্লা ১৯৭৮ সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। বুমেদিনের সময় বুতেফ্লিকা পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন।

বুতেফ্লিকার শাসনামলে আলজেরিয়ার পররাষ্ট্রনীতি জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তখন জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় দেশের তালিকায় ছিল ভারত, যুগোশ্লাভিয়া এবং মিসর। সে সময় আফ্রিকা, এশিয়া, লাতিন আমেরিকায় জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন জনপ্রিয়তা লাভ করে। উপনিবেশ-পরবর্তী রাষ্ট্রগুলো এবং উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনে সর্বাত্মক সমর্থন জানানোর ব্যাপারে আলজেরীয় নীতির তিনি ছিলেন রূপকার। আন্তর্জাতিক বিপ্লবী চে গুয়েভারা থেকে নেলসন ম্যান্ডেলা ও ইয়াসির আরাফাত পর্যন্ত দেখা যায় তারা প্রশিক্ষণ, তহবিল সংগ্রহ এবং সমর্থনের জন্য সব সময় আলজেরিয়ার ওপর নির্ভর করতেন। বলা হয়ে থাকে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে আলজেরিয়ার বিপ্লবী যুদ্ধ দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসকে অনুপ্রাণিত করে। আলজেরিয়া ১৯৬০, ৭০ ও ৮০-এর দশকব্যাপী ফিলিস্তিনি আন্দোলনের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিল। জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতি হিসেবে ১৯৭৪ সালে বুতেফ্লিকা ইয়াসির আরাফাতকে সাধারণ অধিবেশনে বক্তব্য রাখার আহ্বান জানান।

সেটা ছিল ফিলিস্তিনিদের স্বার্থের পক্ষে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিকে জোরদার করার এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। আলজেরিয়ায় ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ইসলামী সলভেশন ফ্রন্ট নামে গঠিত একটি ইসলামী দল পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ইসলামপন্থী দলের জয়লাভের প্রেক্ষিতে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রে সামরিক বাহিনী নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে ক্ষমতা দখল করে। ১৯৯২ সালের ১১ জানুয়ারি নির্বাচন বাতিল করা হয়। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বুমেদিনের উত্তরসূরি শাদলি বেনজাদিদ পদত্যাগ করেন। পরে ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্টকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ফলে দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ওই গৃহযুদ্ধে এক লাখ মানুষ প্রাণ হারায়।

১৯৯৯ সালে সাজানো এক নির্বাচনের মাধ্যমে আবদুল আজিজ বুতেফ্লিকাকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করা হয়। ক্ষমতায় আসার পর বুতেফ্লিকা সাধারণ ক্ষমা এবং পুনর্বাসনের ঘোষণা দিয়ে দেশে পুনরায় শান্তি ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেন। তখন থেকে বুতেফ্লিকার শাসন আলজেরিয়ায় অব্যাহত রয়েছে। আরব বসন্তের সময় ২০১০ সালের ডিসেম্বরে আলজেরিয়ায় ও গণবিক্ষোভ দেখা দেয়। বুতেফ্লিকার শাসনামলে দীর্ঘ দিন দেশটিতে জরুরি অবস্থা জারি ছিল। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জরুরি শাসনের অবসান ঘটে। বুতেফ্লিকা অধিকতর সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু ওই সব প্রতিশ্রুতি অগ্রাহ্য করে তিনি আলজেরিয়ায় কর্তৃত্ববাদী শাসনই সব সময় অব্যাহত রাখেন।

আলজেরিয়া সব সময় সামরিক বাহিনী ও এলিটদের একটি সিন্ডিকেটে পরিচালিত হয়ে আসছে। বুতেফ্লিকা ছিলেন তাদের পুতুল। কিন্তু এবার দেশটির জনগণ যেভাবে এই অযোগ্য, ও পঙ্গু প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে জেগে উঠেছে- তাতে মনে হয় তার কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটবে। তবে মিসরের আরব বসন্ত যেভাবে ব্যর্থ হয়েছে- আলজেরিয়ায়ও তার পুনরাবৃত্তি ঘটে কিনা তা সময়ই বলে দেবে।


আরো সংবাদ



premium cement
নারায়ণগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ ওসি আহসান উল্লাহ ‘ট্রি অব পিস’ পুরস্কার বিষয়ে ইউনূস সেন্টারের বিবৃতি আনোয়ারায় বর্তমান স্বামীর হাতে সাবেক স্বামী খুন, গ্রেফতার ৩ ফতুল্লা প্রেস ক্লাবের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত বদরের শিক্ষায় ন্যায়-ইনসাফের সমাজ প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে : সেলিম উদ্দিন ইসলামের বিজয়ই বদরের মূল চেতনা : ছাত্রশিবির পরিবেশ দূষণে বাংলাদেশে বছরে ২ লাখ ৭২ হাজার মানুষের মৃত্যু : বিশ্বব্যাংক নোয়াখালীতে ল’ইয়ার্স কাউন্সিলের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত ‘আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ল’ ইয়ার্স কাউন্সিল কাজ করে যাচ্ছে’ পুকুরে পাওয়া গেল ১০০ ইলিশ অবন্তিকার আত্মহত্যা : জবির সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের জামিন আবারো নামঞ্জুর

সকল