২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান বীর

কবি আল মাহমুদ - ফাইল ছবি

প্রিয় কবি আল মাহমুদ আমাদের মাঝে আর নেই। একসময় তিনি নয়া দিগন্তে ‘দশ দিগন্তে উড়াল’ শিরোনামে নিয়মিত এক কলাম লিখতেন। তার প্রতিটি লেখা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ি। তার এ গদ্য রচনার সাহিত্য মূল্য সম্পর্কে বলার অপেক্ষা রাখে না। কবি এসব লেখায় একদিকে ব্যক্তিগত অনুভব, বিশ্বাস যেমন প্রকাশ করেছেন, তেমনি দেশ, স্বজাতি ও রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি নিয়েও মাঝে মধ্যে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কিছু অভিমত ব্যক্ত করেন।

তার মতো সর্বজনীন শক্তিমান কবির অনুভূতি ও স্বপ্নগুলো হৃদয় দিয়ে উপলব্ধির চেষ্টা করি। বাংলা সাহিত্যে বিশ্বমানের এরূপ একজন কবিকে দেখতে পাওয়া এবং প্রতিনিয়ত তার ভাবনাগুলো কাছ থেকে অনুভব করতে পারার সুযোগ পাওয়া নিঃসন্দেহে দুর্লভ।

কবিরা বেঁচে থাকেন মানুষের চেতনা ও অনুভবে। কবিতার শব্দগুলো বইয়ের পাতায় বন্দী থাকলেও পাঠকের চিন্তা ও চেতনায় তা মুক্তবিহঙ্গের মতোই বিচরণ করে। এটাই বোধহয় কবিদের বড় সাফল্য। কবিরা এক একটা জাতির ক্রান্তিকালে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেন এবং সঙ্কট উত্তরণে দিকনির্দেশনা দেন। তারা সাধারণ মানুষের মতোই আহার-বিহার সংসার জীবনের চিরায়ত আচরণে অভ্যস্ত। সঙ্কট-সমস্যা আর চ্যালেঞ্জও তাদের জীবনের অনিবার্য বাস্তবতা। তবে কবিরা দার্শনিক, সেহেতু তাদের হৃদয় ও মননে থাকে আলাদা একটা শক্তি; আর সে শক্তির নাম হচ্ছে ‘বিশ্বাস’।

কবি আল মাহমুদ ছিলেন সত্যিকারের ‘দশ দিগন্তে উড়াল’ দেয়া এক দার্শনিক কবি। তিনি মানব জীবনের অনস্বীকার্য ক্ষেত্রগুলোতে অবাধ বিচরণ করেছেন। গ্রামগঞ্জের প্রাকৃতিক দৃশ্য, পাখ-পাখালি, আর নর-নারীর প্রাত্যহিক চিত্র থেকে শুরু করে মানব জীবনের নিগূঢ় রহস্যের অনুসন্ধানেও তিনি মনোনিবেশ করেছেন। সব কবিরাই সম্ভবত কম-বেশি সেটা করে থাকেন।

কবি আল মাহমুদের কথা আলাদা। বিশেষত, বাংলা ভাষার অন্য কবিদের বিবেচনায়। আরো সংক্ষিপ্ত পরিসরে সমসাময়িক কবিদের কথা বলতে গেলে আল মাহমুদ ছিলেন আমার বিবেচনায়, ঐশী আলোক প্রভায় উদ্ভাসিত একটি ধ্রুবতারা। কবিদের অনেকেই ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনা প্রবাহে ভাঙা-গড়ার মুখোমুখি হন। রবীন্দ্রনাথের জীবনে খুব একটা বৈচিত্র্য দেখা যায়নি; তবে বিদ্রোহী কবি নজরুলের জীবনটাই ছিল চড়াই-উতরাইয়ের বিস্ময়কর নাটক।

ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ঘটনাগুলো একজন কবির চিন্তার জগতে প্রভাব ফেলে এবং এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার নানা রচনায়। কবির বিবিধ চিন্তার মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় তার জীবন দর্শন। আমার মনে হয়েছেÑ কবি আল মাহমুদের সাহিত্য-প্রতিভার পূর্ণতা ঘটেছে তার প্রকৃত জীবনদর্শন উদঘাটনে। তার সমসাময়িক কবিদের অনেকেই বা প্রায় সবাই যখন বিভ্রান্ত দর্শন ও ঘোলাটে সংস্কৃতির সয়লাবে খাবি খাচ্ছেন, তখন আল মাহমুদ বাহু আর পাঁজরে শক্তি যুগিয়ে স্রোতের উল্টোদিকে সাঁতার কেটেছেন। তিনি স্রোতের গতিকে ঘুরিয়ে দেয়ারও চেষ্টা করে গেছেন।

কেউ কেউ আল মাহমুদকে কবি শামসুর রাহমানের সাথে তুলনা করতে প্রয়াস পান। আমার মনে হয়, এই দুই কবি মূলত এই ভুবনের দুই বাসিন্দা। এদের দুইজনকে নিশ্চয়ই সাহিত্যের মানদণ্ডে তুলনামূলক বিচার করা যেতে পারে। কিন্তু মানব জীবনের স্বচ্ছ ও আলোকোজ্জ্বল দার্শনিক প্রভা যিনি দিতে পারেন, তিনিই হচ্ছেন পাঠক সমাজের প্রকৃত বন্ধু। কবি শামসুর রাহমান প্রচুর লিখেছেন।

কাব্যমানে উত্তীর্ণ কবিতার সংখ্যাও তার অনেক। মানবজীবনের বিশাল পরিধির খুঁটিনাটি বিষয়কেও তার রচনা স্পর্শ করেছে। প্রাকৃতিক জগৎ ও তার সৌন্দর্য নিয়েও তার ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। এসব বিষয় কবি আল মাহমুদের রচনায়ও সমানভাবে উপস্থিত। এ দুইজনের পার্থক্যটি যেখানে ধরা পড়ে, সেটি হলো : আল মাহমুদ মানবমুক্তির সহজ-সরল রাস্তাটি আবিষ্কার করতে পেরেছেন, যেটি শামসুর রাহমান পারেননি। শামসুর রাহমান সবুজ-শ্যামল অরণ্যে বিচরণ করেছেন, কিন্তু মুক্তির উপত্যকায় হাজির হতে পারেননি।

সহজ কথায়, শামসুর রাহমান এবং তার মতো কবিদের জীবনাদর্শ স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ নয়- কিছুটা ধোঁয়াটে। তারা পাঠকদের অনেক আনন্দ দিয়েছেন, চিন্তার খোরাক দিয়েছেন, কিন্তু আলোকবর্তিকা দিতে পারেননি। তারা পাঠকদের অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছেন। কিন্তু সে স্বপ্নের ওপর শক্তভিত্তির ইমারত গড়ে দিতে পারেননি।

আল মাহমুদ এমন স্বপ্নের কথা বলেছেন, যা মানুষের প্রত্যয়কে মহাকাশের মতো উঁচু হয়ে দাঁড়াতে শেখায়। কবি তার নিজ সত্তা, জীবনের অস্তিত্ব, স্রষ্টার শ্রেষ্ঠত্ব ও মানবতার পরিণতি সম্পর্কে অভিজ্ঞান লাভ করেছিলেন এবং তাকে একটি ঐশী আলো হিসেবে বিবেচনা করে দার্শনিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। এ জন্য তিনি অবশ্যই পাঠকের মাঝে দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকবেন, তাদের শ্রদ্ধাভাজন হয়ে থাকবেন।
আর্থিক মানদণ্ডে, আল মাহমুদ সাধারণ মানুষের কাতার থেকে এসেছেন।

মধ্যবিত্ত গ্রামীণ সমাজের মধ্যে তিনি লালিত-পালিত হয়েছেন। আবহমান বাংলার রূপ-রস-গন্ধ সবই তার অস্থিমজ্জায় বহমান। তার কবিতা, উপন্যাস ও গল্পে গ্রামীণ জীবনের সাদামাটা বৈচিত্র্য প্রকাশ পেয়েছে। সমাজের বঞ্চিত-লাঞ্ছিত মানুষের দুঃখের কাহিনী লিখেছেন। আবার সমাজের অসঙ্গতি ও বৈপরীত্য নির্মূল করার জন্য বিক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদী হয়েছেন। তিনি হতভাগ্য মানুষের মুক্তির কথা লিখেছেন। এ জন্য সাংবাদিকতা পেশায় তিনি নিয়োজিত হয়েছিলেন মজলুম মানুষের মুক্তির পথ খুঁজতে।

একপর্যায়ে সাম্যবাদী আদর্শের প্রতি প্রবলভাবে ঝুঁকে পড়েছিলেন। এর স্বপক্ষে লিখেছেন। সত্যের পক্ষে অবস্থান নিয়ে শক্ত হাতে লিখেছেন- এ জন্য হয়েছেন কারাগারের বাসিন্দাও। তিনি সহসাই উপলব্ধি করেন মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা; বুঝতে পারেন সীমিত মানবীয় জ্ঞানভিত্তিক ‘প্রেসক্রিপশন’ মানবমুক্তি আনবে না। বরং ঐশী প্রত্যাদেশে সিক্ত দর্শন ও আদর্শই মানুষের মুক্তি নিশ্চিত করতে পারে। কবি ফররুখের মতো কবি আল মাহমুদ সিন্দাবাদের একই জাহাজের যাত্রী হয়ে মহাসমুদ্রে পাড়ি জমাতে চান। কবি কাজী নজরুল ইসলাম হচ্ছে- তাদের পথিকৃৎ। বস্তুত, বাংলা সাহিত্যে নজরুল-ফররুখ-আল মাহমুদ যে ব্যতিক্রমী এক মহাসড়ক উন্মোচন করে গেছেন তা চির অম্লান হয়ে থাকবে।

আমরা জানি না, তাদের প্রদর্শিত মহাসড়কে ধাবিত হওয়ার জন্য নতুন প্রজন্মের মধ্যে কারা এগিয়ে আসবে। অসম্ভব নয় যে, কিছুকালের জন্য সড়কপথ আলো-আঁধারি অন্ধকারে থাকতে পারে। নিশ্চয়ই নজরুল-ফররুখ-মাহমুদের মশাল নিয়ে কেউ না কেউ এগিয়ে আসবেন। আল মাহমুদ এক লেখায় দুঃখ করে বলেছেন; ‘শিল্প-সাহিত্যের কথা বলতে গেলে আমাকে বলতেই হবে, এখানে কিছু নেই।

এখানে কিছু হচ্ছে না। অন্তত আমার বিবেচনায় আমি তো নতুন কোনো অসাধারণ প্রতিভার পদচারণা দেখতে পাচ্ছি না। সমস্ত শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে এক গাঢ় অন্ধকার নেমে এসেছে, যার অন্য নাম অবক্ষয়; পরাণুকরণ।...’ অবশ্য, কবি এ ক্ষেত্রে কিছুটা অসঙ্গতিরও পরিচয় দিয়েছেন।

তিনি ‘বাংলাদেশে কিছুই হচ্ছে না, এটা মানি না’ শিরোনামে এক কলামে লিখেছেন, ‘যারা বলেন, বাংলাদেশে এ সময়ের সাহিত্য অবক্ষয়ের কালিমা বহন করছে আমি সেটা অস্বীকার করি। কারো কারো নাম ও চেহারা আমার চোখে ভাসে, এই মুহূর্তে তাদের নাম উচ্চারণ না করলেও মনে মনে স্থির করেছি অচিরকালের মধ্যেই তাদের পরিচিতিসহ কাজের পর্যালোচনা আমার পক্ষে সম্ভব হবে।’ আমরা জানি না, কবি আল মাহমুদের পরে কত ব্যবধানে আরেকটি প্রতিভার উদ্ভব হবে।

আল মাহমুদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও কবিপ্রতিভা একাকার হয়ে আছে। তিনি বাংলাদেশের সাহিত্যজগতের প্রচলিত ধারার গড্ডালিকা প্রবাহ থেকে সন্তর্পণে বেরিয়ে এসে দোর্দণ্ড প্রতাপে ভিন্ন ধারার সব সৃষ্টি করেছেন। এটা ছিল অনেকের জন্যই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার বিষয়। পরশ্রীকাতর একদল দুর্বল লেখক তাই আল মাহমুদের ঔজ্জ্বল্যকে ছাইচাপা দিতে চেয়েছেন। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সে আলোকে নির্বাপিত করা যায়নি। বরং তা আরো উজ্জ্বল হয়ে সব দুর্বল আলোকে ছাপিয়ে গেছে।

এ জন্য আল মাহমুদের মধ্যে ছিল এক ধরনের দুঃখবোধ। পাশাপাশি আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান এক মহাপুরুষ হিসেবে তিনি হয়েছেন বিজয়ী বীর। কতটা সৎসাহস ও দৃঢ়চেতনা থাকলে তিনি বলতে পারেন, ‘আমি সাহিত্যের লোক বলেই একটা কথা সব সময় হৃদয়ে জাগিয়ে রাখি, পরাজিত হবো না। পরাজিতের লাঞ্ছনা আমাকে স্পর্শ না করুক।

কাছের মানুষ যদি ছদ্মবেশী শত্রু হয়ে থাকে, তাহলে বিপর্যয় অবশ্যই আমাকে একদিন আঘাত করবে। সে জন্য আমার একটি প্রস্তুতি আছে। সেই প্রস্তুতির নাম হলো ‘ঈমান’: অবশ্যই ঈমানের এক ধরনের তেজ আছে। সেই তেজের মধ্য থেকে আলো বিচ্ছুরিত হয়। সে আলোতে বিশ্বাসী কবিরা পথ চলেন। আমি নিজেও সে আলোতে এতদূর এসেছি।’

কবি আল মাহমুদ দেশপ্রেমে উজ্জীবিত একজন গর্বিত সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। ব্যক্তি মানসের এ পটভূমিতে কবি সর্বদাই সোচ্চার হয়েছেন অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে। তিনি মূলত মজলুম মানুষকে আশার বাণী শুনিয়ে থাকেন। তিনি লিখেছেন, ‘... তবে আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রচনায় আমার বুদ্ধিবৃত্তিক অংশীদারিত্ব সব সময় আমি দাবি করে এসেছি। সেই দাবির বলেই তরুণ কবি-সাহিত্যিকদের দেশপ্রেমের আহ্বান জানিয়ে থাকি।’

‘আমি সব গ্লানিকর বিষয়কে মুক্তিযোদ্ধার মতোই পা উঁচু করে পার হয়ে এসেছি। এর জন্য কোনো প্রতিদান, পুরস্কার বা সম্মাননার তোয়াক্কা করিনি। আমার সৃষ্টিই তো আমার পুরস্কার। কত কথা লিখেছি। কত খুঁটিনাটি বিষয়কে আমার রচনায় ধরতে চেষ্টা করেছি। এর বেশি একজন কবি কী আর করতে পারে। আমার সূচনা শুভ ছিল। এখন আমার সমাপ্তি আমার প্রভু যদি শুভ ও মঙ্গল দিয়ে আচ্ছাদিত করে দেন, তাহলেই শান্তি।’

কবির চেতনায় তার সামগ্রিক জীবনের সৃষ্টি সাফল্যে এক তৃপ্তির আভা পরিলক্ষিত হচ্ছে। কতজন মানুষ তার কর্মজীবন নিয়ে এরূপ পরিতৃপ্ত হতে পারেন? একজন নিঃস্বার্থ মানুষ শুধু আশার বাণী আর আলোর পরশ দিয়ে এভাবে একটা সমাজ ও জাতিকে জাগিয়ে তুলতে পারেন। কবির জীবনে সত্যানুসন্ধানে সাফল্যের ফল্গুধারায় বিশ্বাস ও মূল্যবোধের যে পরিবর্তনকে ধারণ করেছেন, তা নিয়ে তাকে সইতে হয়েছে বহু নিন্দা।

তাকে নিন্দুকেরা তথাকথিত ‘মৌলবাদী’ বলে আখ্যায়িত করতেন। আমাদের দেশে এমন এক একটি শ্রেণী আছে, যারা তাদের অন্ধগলিতে যাতায়াত করে না এমন সব আলোকিত মানুষকে অপদস্থ করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। কিন্তু আল মাহমুদ ওই নিন্দুকদের থোড়াই কেয়ার করেছেন। তিনি নিজ বিশ্বাসের ওপর ভর করে শির উঁচু করে চলেছেন। কবির সে কী সাহসী উচ্চারণ- ‘...মুক্তিযোদ্ধারা হলো সৈনিক। তাদের চলার বেগ অব্যাহত রেখেই পা উঁচু করে ঘৃণা-বিদ্বেষ ও পরাজিতকে অতিক্রম করে চলে যেতে হবে।

সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমি ব্যক্তিগতভাবে এই অতিক্রমের কাজটি সার্থকভাবে পার হয়ে এসেছি, যদিও আমাকে কুৎসার মেঘে আবৃত করে রাখার অনেক চেষ্টা হয়েছে। এখনো যে একেবারে হয় না, তাও নয়। কিন্তু সময়ের আবর্তনে আমাকে নিয়তি নির্ধারিত কবিত্বশক্তির একটা উচ্চতায় তুলে রেখেছে। আমি আমার দায়িত্বভার পালন করে চলেছি। কোনো অবস্থাতেই সংঘর্ষ ও হিংস্রতাকে প্রশ্রয় দিইনি।

আমার কাজ হলো, তারুণ্যের বুকের মধ্যে দেশপ্রেমের বীজ উপ্ত করা। সেটা কি আমার মতো কবির জন্য কর্তব্য ছিল না? সে কর্তব্যই তো এতদিন পালন করে এসেছি। আমার বিরুদ্ধে যারা এতদিন নানাবিধ কুৎসা রটনা করেছেন, তাতে তাদের কোনো উপকার হয়নি। এরা বড়জোর আমাকে এতদিন ‘মৌলবাদী’ বলে আখ্যায়িত করে আমার ঈমানের ওপর আঘাত হানতে চেষ্টা করেছেন। ওই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। আমি আমার দেশপ্রেম, কবিত্বশক্তি তদুপরি মুক্তিযোদ্ধার গৌরব নিয়ে বেঁচে আছি।’ কবি আরো লিখেছেন, ‘...কুৎসার মেঘে আমার চেহারা কিছুকালের জন্য বিমর্ষ করা গেলেও, আমার কবিতাকে নিষ্প্রভ করার ক্ষমতা তাদের নেই।’

কবির জীবনাবসানে বাংলা কাব্যের একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটবে। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদের যুগ শেষ হয়ে বাংলা কাব্যের স্রোতধারা নতুন বাঁকে মোড় নেবে। সেটি হয়তো হবে আধুনিকতম। কবি জীবিত থাকতেই তা উপলব্ধি করেছেন। সেজন্যই তিনি বলেছেন- ‘সম্ভবত আমিই আধুনিক কবিতার মুখ দেখার পথে সর্বশেষ বাধা। আমার জীবনাবসানের সাথে সাথে আগল ভেঙে পড়বে। তখন শুরু হবে এক নতুন আধুনিকতম কাব্যের ধারা।’

আল মাহমুদ জীবনের ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়েও মহাকালের যাত্রী হিসেবে প্রস্তুতি গ্রহণে ব্যস্ত থেকেছেন। শেষ মুহূর্তের প্রয়োজনীয় কাজগুলো যেন তিনি সেরে নিয়েছেন। তিনি বলেছেন- ‘আমার কাজ তো আমি করে গেছি। ঈমানদার কবিরা অতীতে যেভাবে জীবন কাটিয়েছেন, আমি তাদের অনুসরণ করতে চেষ্টা করেছি। পেরেছি কি না, তার হিসাব এই পৃথিবীতে হবে না।

যেখানে হবে সেখানে আমি জানি, আমাকে খালি হাতে ফেরানো হবে না। সব কবিরই শেষ পর্যন্ত সাধ্যের একটা সীমা থাকে। আমারও আছে। এর বাইরে তো আর যেতে পারি না। আমার এখন নিরন্তর চেষ্টা কারো ক্ষতি না করে আমার নির্ধারিত আয়ুষ্কালকে পূর্ণ করা। আমার প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য এখনো অক্লান্ত পরিশ্রম করছি। ভয় হয়, আমার সব প্রতিশ্রুতি হয়তো বা পূর্ণ করে যেতে পারব না। এখন আমার একান্ত চেষ্টা হলো, সমাপ্তিকালের অর্থাৎ শেষের বা অবসানের কবিতা লেখা।’

কবির প্রত্যাশা পূরণ হোক সে কামনা তার ভক্তদের। ‘দশ দিগন্তে উড়াল’ দিয়ে তিনি যে অসাধারণ গদ্য লিখেছেন, তাতে শুধু তার ব্যক্তিগত কৈফিয়ত নয়, সমসাময়িক সাহিত্যজগৎ, সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কেও তিনি জাতিকে কিছু মূল্যবান চিন্তার খোরাক দিয়ে গেছেন। তরুণ প্রজন্ম এর দ্বারা উদ্বেলিত হবে, উদ্বুদ্ধ হবে। আল মাহমুদের কবিতা সত্যিই রক্তে ঝড় তোলে-

মাঝে মাঝে হৃদয় যুদ্ধের জন্য হাহাকার করে ওঠে
মনে হয়, রক্তই সমাধান, বারুদই অন্তিম তৃপ্তি;
আমি তখন শব্দের ভেতর জেহাদ জেহাদ বলে জেগে উঠি।

বিশ্বময় জুলুম-নির্যাতনের সে খড়গ কৃপাণ মানবজাতির উপর

হিমালয় পর্বতের মতো চেপে বসেছে, তা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?

কবির স্বপ্ন রূপায়িত হোক নকিবের উদ্ভবে।
ঢাকো তোমার মুখ। কারণ
নগরের নকিবেরা এখন দাজ্জালের আগমন শিঙায় ফুঁক দিচ্ছে।
ঢাকো তোমার বুক। কারণ
সত্য ও মিথ্যার লড়াইয়ে আমরা
হকের তালিকায় লিপিবদ্ধ।
এসো, অপেক্ষা করি সেই ইমামের
যিনি নীল মসজিদের মিনার থেকে নেমে আসবেন আমাদের মাঝে।
তার সফেদ পোশাক থেকে
মেশকের সুরভি ছড়িয়ে পড়বে
পৃথিবীর দুঃসহ বস্তিতে।

লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার


আরো সংবাদ



premium cement