২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

পথ হোক শান্তির, মরণের নয়!

-

একটি জীবন কেবল একজন মানুষের একক জীবন নয়! এর সাথে জড়িয়ে আছে আরো অনেক মানুষের জীবন। তাই তো একটি জীবন বিচ্ছিন্ন হলে অন্য জীবনেও দুঃসহ যন্ত্রণার আঁধার নেমে আসে। তবে চিরসত্য মরণকে অস্বীকার করা যায় না। মরণ তো আসবেই, তবে এভাবে কেন? স্বাভাবিক মৃত্যুর বেদনা যেখানে সহ্য করা যায় না, সেখানে মানবসৃষ্ট অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনার মৃত্যু কি মানা যায়? তবু দেশে প্রতিদিন গড়ে ২০ জন মানুষ সড়কে প্রাণ হারাচ্ছে। কারো কারো কাছে হয়তো ২০ জন মানুষ নিহত হওয়ার বিষয়টি তুচ্ছ মনে হতে পারে! কিন্তু যার যায় সে বোঝে স্বজন হারানোর বেদনা কত কষ্টের, কত নির্মম। সড়ক-দুর্ঘটনা একটি জাতীয় সমস্যা হলেও কোনো সরকারই সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। সড়কে বের হওয়ার অর্থই মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো আজ যেন একেকটি মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে।

শাসকেরা প্রায়ই বলেন, সব কিছু ঠিক আছে। অথচ সড়ক-মহাসড়কে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার নামে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়ে কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কিংবা যাত্রী কল্যাণ সমিতি কথা বললেই শাসকেরা চড়ে গিয়ে বলেন, সব কিছ্ইু অপপ্রচার। সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। অথচ সড়কের মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কথা লিখলে সমাপ্তি টানা যাবে না। নিকট অতীতে ঘটে যাওয়া কিছু মর্মান্তিক ঘটনা আমাদের দেশের সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহ পরিস্থিতিরই পরিচয় বহন করে। গত বছরের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে দুই বাসের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে হাজার হাজার শিক্ষার্থী সে দিন রাজপথে নেমে এসেছিল। ওদের প্রতিবাদী স্লোগানে কোনো উত্তাপে অশ্রুঝরা কান্নার আওয়াজ ইথারে ইথারে ভেসেছিল। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত ছিল সারা দেশ।

আমরা ৯ টাকায় এক জিবি চাই না, নিরাপদ সড়ক চাই, লাশের গন্ধ বাতাসে, কে সে নরপিশাচ আজো হাসে; ঘুরে বেড়ায় অপরাধী, মার খায় প্রতিবাদী। একপর্যায়ে তারা ট্রাফিক পুলিশের কাছ থেকে সড়ক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিয়ে নেয়। শিক্ষার্থীরা সরকারের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল- কিভাবে সড়ক নিরাপদ রাখতে হয়। অথচ পুলিশ ও সরকারি দলের লোকজন বল প্রয়োগের মাধ্যমে স্কুলপড়–য়া শিক্ষার্থীদের বিতাড়িত করেছে। তাদের ‘অপরাধ’? তারা একের পর এক বেপরোয়া সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিকার না পেয়ে রাস্তায় নেমেছিল।

আমাদের দেশে অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনা। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পেরিয়ে গেলেও সড়ক ব্যবস্থাপনায় প্রশাসনিক দুর্নীতি, অনিয়ম আর চাঁদাবাজি রয়ে গেছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলেও তা আমাদের দেশের তুলনায় খুবই কম। বাইরের দেশে লাইসেন্স অর্জন করা যত কঠিন, লাইসেন্স টিকিয়ে রাখা তার চেয়ে বেশি কঠিন। অথচ সরকারের এক মন্ত্রী বলেছিলেন- গরু-ছাগল-ভেড়া চিনতে পারলেই ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া যায়। একটি দিনও দুর্ঘটনা থেকে বাদ যাচ্ছে না। শাসকেরা বিরোধী দলের রাজনীতিকে যেভাবে মোকাবেলা করে তার ছিটেফোঁটাও যদি সড়কের দিকে দিত, তাহলে বাসের চাপায় মানুষের জীবন বিপন্ন হতো না। দণ্ডবিধির ৩০৪ খ ধারায় বলা হয়েছে- বেপরোয়া যান বা অশ্ব চালিয়ে মৃত্যু ঘটালে তিন বছর পর্যন্ত যেকোনো বর্ণনায় কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ডসহ বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান থাকলেও বাস্তবে কার্যকর না থাকায় চালকেরা বেপরোয়া। চালকেরা জানে, গাড়িচাপায় মানুষকে মেরে ফেললেও তাদের কোনো সাজা হবে না।

কারণ তাদের গাড়ির মালিক কিংবা শ্রমিক নেতার ‘হাত অনেক লম্বা’। সব উন্নত ও গণতান্ত্রিক দেশে আইনের ব্যত্যয় ঘটলে জেল-জরিমানার বিধান যেভাবে কার্যকর হয়, সেভাবে যদি আমাদের দেশে কার্যকর করা হয়; তাহলে মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ঘটনা অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব। নিরাপদ সড়ক চাইর (নিসচা) এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে সড়কে প্রাণ গেছে ৪৪৩৯ জনের। আহত হয়েছেন সাত হাজার ৪২৫ জন। সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা প্রায় তিন হাজার ১০৩টি। গত ২৫ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি জানিয়েছে, বিদায়ী ২০১৮ সালে পাঁচ হাজার ৫১৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় সাত হাজার ২২১ জন নিহত ও ১৫ হাজার ৪৬৬ জন আহত হয়েছে। এ সময় রেলপথে ৩৭০টি দুর্ঘটনায় ৩৯৪ জন নিহত ও ২৪৮ জন আহত হয়। নৌপথে ১৫৯টি দুর্ঘটনায় ১২৬ জন নিহত, ২৩৪ জন আহত ও ৩৮৭ জন নিখোঁজ হয়েছে এবং আকাশপথে পাঁচটি দুর্ঘটনায় ৫৫ জন নিহত ও ৩২ জন আহত হয়েছে। সড়ক, রেল, নৌ ও আকাশপথে মোট ছয় হাজার ৪৮টি দুর্ঘটনায় সাত হাজার ৭৯৬ জন নিহত এবং ১৫ হাজার ৯৮০ জন আহত হয়েছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে প্রতিদিন ২০ জন মারা গেছে।

সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে ২০১৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় দুই হাজার ৩৭৬ জন মারা গেছে। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ২০১৬ সালে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২৪ হাজার ৯৫৪ জন মারা গেছে। তবে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে নিচে উল্লিখিত বিষয়গুলো বিবেচনা করা যেতে পারে। সড়ক অব্যবস্থাপনা, পরিবহন চালকদের অদক্ষতা, বেপরোয়া মনোভাব, ফিটনেসবিহীন চালকদের দৌরাত্ম্য, ফুটপাথ দখল, ওভারটেকিং, হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো, রাস্তার মোড়, গাড়ির ত্রুটি, যাত্রীদের অসতর্কতা, মোবাইল ফোনে কথা বলা, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো বন্ধ করা। রাস্তার চাঁদাবাজি বন্ধ করা। মালিকদের বেঁধে দেয়া ট্রিপ কমানো। গাড়ির হেলপার এবং ড্রাইভারদের নৈতিকতা বাড়ানোর জন্য তাদের নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার ব্যবস্থা করা।

এমনকি যারা কম শিক্ষিত, তাদের স্বশিক্ষিত করে গড়ে তোলা। হাইওয়ের রাস্তাগুলোর গতি কমানো। ফুটওভারব্রিজ ও জেব্রা ক্রসিং বাড়ানো। রাস্তার পাশের অবৈধ ঝুপড়িগুলো অপসারণ করা। হাইওয়ে ট্রাফিক পুলিশের জনবল আরো বাড়ানো প্রয়োজন। বুলগেরিয়ায় একটি যাত্রীবাহী বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গিরিখাদে পড়ে ১৭ যাত্রীর মৃত্যু হলে জনবিক্ষোভের চাপে দেশটির পরিবহনমন্ত্রীসহ তিন মন্ত্রীকে বরখাস্ত করা হয়। জবাবদিহির এমন দৃষ্টান্ত আমাদের দেশে স্থাপিত হলে দুর্ঘটনার হার অনেকটাই কমবে। আমরা আশা করি, রাষ্ট্র এ ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করবে, এমনটি দেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রত্যাশা।


আরো সংবাদ



premium cement