২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

তুজুকে তৈমুরি

-

সিকান্দারে আজমের মতো বিশ্বজয়ের শখ ছিল আমির তৈমুরের। আজকের উজবেকিস্তানে তার উত্থান ঘটে এবং মিসর, সিরিয়া, ইরাক ও ইরান বিজয় করে তিনি হিন্দুস্তান পর্যন্ত পৌঁছে যান। তৈমুর যখন ইরান বিজয় করেন, তখন তিনি বিখ্যাত ফার্সি কবি হাফিজ সিরাজিকে ডেকে পাঠান। তৈমুর হাফিজের একটি কবিতা আবৃত্তি করে জানতে চান, তুমি কি এ কথা বলেছ, ‘আমি আমার প্রেমাস্পদের গালের তিলের বিনিময়ে সমরকন্দ ও বুখারা উৎসর্গ করে দেবো?’ জবাবে হাফিজ বললেন, ‘হ্যাঁ, রাজাধিরাজ, এ কবিতা আমারই।’

তৈমুর এ মহাকবিকে বললেন, আমি তরবারির জোরে বেশ কষ্ট করে সমরকন্দ জয় করেছি। এরপর নগরের পর নগর জয় করে চলেছি। কিন্তু তুমি তো এ সমরকন্দকে সিরাজের কোনো এক সাধারণ তরুণীর গালের তিলের বিনিময়ে উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত। হাফিজ কয়েক মুহূর্ত নীরব রইলেন। এরপর মুচকি হেসে তিনি বললেন, হে আমির, এমনই ভুলের কারণে আজ আমি দরিদ্রতার শিকার। হাফিজের উপস্থিত জবাবে তৈমুর হেসে দিলেন এবং কবিকে উপঢৌকন দিয়ে ও সম্মান জানিয়ে বিদায় করেছিলেন। তৈমুর শুধু একজন যুদ্ধবাজ ছিলেন না, বরং তিনি শিক্ষা ও সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগীও ছিলেন। ইরান বিজয়ের আগেই হাফিজ সিরাজির বহু কবিতা তার মুখস্থ ছিল। চাটুকারদের সাথে সময় কাটানোর পরিবর্তে বেশির ভাগ সময় তিনি ইবনে খালদুনের সাথে আলোচনা পর্যালোচনা করতেন। আমির তৈমুর চীন বিজয়ের চেষ্টাকালে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং জীবনের খেলায় হেরে যান।

তবে মৃত্যুর আগে তিনি স্বরচিত লেখা মলাটবদ্ধ করে গেছেন, যা ‘তুজুকে তৈমুরি’ নামে খ্যাতি লাভ করেছে। ওই গ্রন্থে তৈমুর দাবি করেন, তার যুদ্ধবিগ্রহের উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর দ্বীন ও শরিয়তে মুহাম্মদির উৎকর্ষ সাধন। তার এ দাবির সাথে দ্বিমত পোষণের অবকাশ রয়েছে। কেননা তৈমুর মুসলমানদের বিরুদ্ধে অনেক যুদ্ধে লড়েছেন। তিনি হাজার হাজার নয়, বরং লাখ লাখ মুসলমানকে হত্যা করেছেন। তবে এ গ্রন্থের মধ্যে তৈমুর তার অভিজ্ঞতার আলোকে শাসন পরিচালনার কিছু নিয়ম-নীতি বর্ণনা করেছেন, যা বর্তমানের শাসকদের জন্যও ভাবনার।

‘তুজুকে তৈমুরি’তে বলা হয়েছে, ভালো শাসক সর্বদা পরামর্শ ও দূরদর্শিতার সাথে কর্ম সম্পাদন করা উচিত। শত্র“-মিত্র উভয়ের সাথে সদাচরণ করা উচিত। অভ্যাসে পরিণত করা উচিত নমনীয়তা, উদারতা, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতাকে। তৈমুর লিখেছেন, যে ব্যক্তি আমার বিশ্বস্ত ছিল এবং দুঃসময়ে আমার পাশে থেকেছে, সর্বদা তার চাহিদাকে সম্মান জানিয়েছি। জনগণকে আমি ন্যায়বিচার উপহার দিয়েছি। জনগণের সাথে মারাত্মক কঠোর ব্যবহার করিনি, যেন তারা আমার প্রতি অসন্তুষ্ট না হয়। আবার তাদের এতটা স্বাধীনতাও দিইনি যে, তারা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। তৈমুর লিখেছেন, আমি সর্বদা মজলুমের সহায়তা করেছি এবং জালিমকে শাস্তি দিয়েছি। তাদেরও ক্ষমা করে দিয়েছি, যারা সর্বদা আমার সাথে ওয়াদা ভঙ্গ করেছে। তৈমুর লিখেছেন, আমি সর্বদা উলামা-মাশায়েখকে আমার কাছে রেখেছি। মন্দ ও দুষ্ট লোকদের থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করতাম। নিজের কৃষকদের অবস্থা সম্পর্কে চেষ্টা করতাম ওয়াকিবহাল থাকার।

তৈমুর একাধিকবার লিখেছেন, যে আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছে, অবশ্যই তার প্রতিদান চুকিয়ে দিয়েছি। তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা লিখেছেন, আমি শত্র“ সেনার এমন সৈনিকের বেশ কদর করতাম, যে তার মনিবের প্রতি অনুগত ও বিশ্বস্ত। এর বিপরীতে, যে সৈনিক তার মনিবকে ধোঁকা দিয়ে আমার কাছে চলে আসত, তাকে আমার নিকৃষ্ট শত্র“ ভাবতাম। তৈমুর লিখেছেন, একজন ভালো শাসকের কথার সাথে কাজের মিল থাকা উচিত। তিনি যে আইন অন্যের ওপর জারি করবেন, তা নিজেকেও মেনে চলতে হবে। ভালো শাসক স্বতন্ত্র স্বভাবের হওয়া উচিত। তিনি মন্ত্রীদের বক্তব্যগুলো চোখ বন্ধ করে মেনে নেবেন না; বরং তা যাচাই করবেন। ভালো শাসককে যার-তার কথাকে বিশ্বাস করা উচিত নয়।


‘তুজুকে তৈমুরি’তে আমির তৈমুর বলেছেন, ভালো শাসকের এমন ব্যক্তিদের মন্ত্রী বানানো উচিত, যারা শাসনকার্য নিষ্ঠা ও সদাচারের মাধ্যমে পরিচালনা করবেন। কপটতার কথা বলবেন না। কাউকে মন্দ বলবেন না, কারো মন্দ শুনবেন না। তৈমুর এমন মন্ত্রীদের বরখাস্ত করতেন, যারা বেশির ভাগ সময় অন্যের ক্ষতি করতেন। তিনি লিখেছেন, ঈর্ষাপরায়ণ, হিংসুক ও বদমেজাজি লোক যদি মন্ত্রী হয়, তাহলে সে যেকোনো সময় শত্র“র সাথে যোগসাজশ করতে পারে। সুতরাং সৎ লোকদের মন্ত্রী বানানো উচিত, যাতে আল্লাহর সৃষ্টির উপকার হয়।

‘তুজুকে তৈমুরি’ পড়ছি আর ভাবছি, আমির তৈমুর ভালো শাসক ও ভালো মন্ত্রীদের যে বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন, এটা আজকালের শাসনপদ্ধতির পুরো উল্টো। আমাদের বেশির ভাগ শাসক তো বিদ্বানের পরিবর্তে জালিমের পরিবেষ্টনে থাকেন। আজকালের শাসকেরা বিশ্বস্ত নন, বিশ্বাসঘাতক লোকদের বেশি পছন্দ করেন, যাদের জনগণ বদনাও বলে থাকে। আমাদের শাসকেরা ‘বদনা’কে যথাস্থানে না রেখে মাথার ওপর রাখেন। এ জন্য তাদেরকে ‘বদনাওয়ালা সরকার’ বলা হয়। আমাদের দেশের কিছু মন্ত্রীকে দেখতেই ঈর্ষাপরায়ণের মতো লাগে। তারা সর্বদা খারাপ কথা বলেন এবং বিরোধী দলের কাছ থেকে খারাপ কথা শোনেন। তৈমুর ভালো, সচ্চরিত্র, বাহাদুর ও বিশ্বস্ত লোকদের মন্ত্রী বানিয়ে সাম্রাজ্যের পরিধি বাড়িয়েছেন। আমাদের শাসকদের সাম্রাজ্য ও ক্ষমতা দিন দিন হচ্ছে সীমিত।

বাহ্যত তাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট বলা হয়, অথচ রাজধানীতে কিংবা দুয়েকটা প্রদেশে তাদের ক্ষমতা চলে। বাকি প্রদেশগুলোতে গঠিত হয় অন্য কারো সরকর। আর ওখানকার শাসকও কেন্দ্রের শাসকদের চেয়ে ভিন্ন হয় না। রাজনীতির বৈপরীত্য এবং লড়াইয়ের কারণে ছড়িয়ে পড়া নৈরাশ্য শাসনপদ্ধতি পরিবর্তনের প্রস্তাবকে আবারো জোরালো করছে। অর্থাৎ আবারো একবার পার্লামেন্ট ব্যবস্থা পরিত্যাগ করে প্রেসিডেন্ট শাসিত ব্যবস্থার দিকে ফিরে যাও, যাতে কেন্দ্রের শাসক সহজেই পুরো দেশের শাসক হয়ে যেতে পারেন। এ প্রস্তাবকারীদের বোঝা উচিত, লড়াই ও নৈরাশ্যের কারণ শাসনব্যবস্থা নয়, বরং কিছু ব্যক্তি, যারা শাসনের রীতিনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন; অথচ শাসক হয়ে বসে আছেন। হাফিজ তার প্রেমাস্পদের তিলের খাতিরে সমরকন্দ ও বুখারা উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু আমাদের শাসকেরা তাদের ব্যক্তিগত অহমিকার জন্য সংবিধানকে উৎসর্গ করতেও প্রস্তুত। আমির তৈমুর লিখেছেন, ব্যক্তিগত অহমিকায় আবদ্ধ শাসকের পরিণাম হয় খুব খারাপ।
পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ২৮ জানুয়ারি, ২০১৯ সংখ্যা থেকে ভাষান্তর, ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
মাটির নিচে পাওয়া গ্রেনেড মাইন মর্টার শেল নিষ্ক্রিয় করল সেনাবাহিনী অনির্দিষ্টকালের জন্য অনলাইন ক্লাসে যাচ্ছে জবি, বন্ধ থাকবে পরীক্ষা কুড়িগ্রামে রেলের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদ ক্রিকেট খেলতে অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে দেওয়ানগঞ্জের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী শিহাব কিশোরগঞ্জে বৃষ্টির জন্য বিশেষ নামাজ সাতক্ষীরা বৈদ্যুতিক খুটিতে ধাক্কা লেগে মোটরসাইকেলআরোহী নিহত বার্সেলোনাতেই থাকছেন জাভি চতুর্থ দফা ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি : এবারের তাপদাহ শেষেই বৃষ্টিপাতের আশা ফরিদপুরে বৃষ্টির জন্য নামাজে হাজারো মুসুল্লির কান্না পোরশার নোচনাহারে আগুনে ৩টি দোকান পুড়ে গেছে খুলনা বিভাগ ও ৬ জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপপ্রবাহ

সকল