২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নাইজেরিয়ায় গণতন্ত্র কি সঙ্কটের মুখে?

-

আফ্রিকার মুসলিম দেশ নাইজেরিয়ায় আগামী শনিবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। দেশটিতে সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতন্ত্র নিয়ে নানা সমালোচনা ও বিতর্ক রয়েছে। দেশটির আসন্ন নির্বাচন কি অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে?

বিগত ২৫ জানুয়ারি নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বুখারি দেশটির প্রধান বিচারপতি ওয়াল্টার ওনোগহেনকে বরখাস্ত করে একজন অস্থায়ী প্রধান বিচারপতিকে তার স্থলাভিষিক্ত করেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে প্রধান বিচারপতির মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে কেন এই পরিবর্তন? আমরা জানি, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিচার বিভাগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ওনোগহেন নাইজেরিয়ার স্বাধীন বিচার বিভাগের প্রধান হিসেবে অতীতের নির্বাচনগুলোতে নির্বাচনী বিরোধ নিষ্পত্তিতে সহায়তা করেছিলেন। ওই নির্বাচনের কয়েকটিতে সহিংসতা ও ভোট কারচুপির সুস্পষ্ট অভিযোগ উঠেছিল। তিনি ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনেও কোনো বিতর্ক দেখা দিলে তা সমাধান করার জন্য একই ধরনের ভূমিকা পালন করবেন বলে আশা করা হয়েছিল। আসন্ন নির্বাচন ঘনিয়ে আসার প্রাক্কালে প্রধান বিচারপতিকে বরখাস্ত করায় গোটা নাইজেরিয়ায় হইচই শুরু হয়েছে। নাইজেরিয়ার বার অ্যাসোসিয়েশন দুই দিনের ধর্মঘট পালন করে এবং প্রধান বিরোধী দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী আতিকু আবুবকর প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তকে ‘স্বৈরাচারী তৎপরতা’ আখ্যায়িত করে এর নিন্দা করেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও সরকারের নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক বিচার বিভাগের ওপর অন্যায় হস্তক্ষেপে বিস্ময় প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিচারপতি অপসারণের এই সিদ্ধান্ত ‘নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপর বিরূপ প্রভাব’ ফেলবে বলে মন্তব্য করেছে।

মাত্র চার বছর আগে ২০১৫ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সাবেক প্রেসিডেন্ট গুডলাক জোনাথন তৎকালীন বিরোধীদলীয় প্রার্থী বুখারির কাছে পরাজয় স্বীকার করে নেন। এটা ছিল নাইজেরিয়ায় প্রথম একজন ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের পরাজয় মেনে নেয়ার ঘটনা। জোনাথন স্বেচ্ছায় নির্বাচনে যে পরাজয় মেনে নিয়েছিলেন- সেটা কেবল নাইজেরিয়ায় নয়, গোটা আফ্রিকা মহাদেশের জন্য একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। এ ঘটনায় নাইজেরিয়ার ভোটারেরা বুখারির ওপর আস্থা আনার ব্যাপারে উৎসাহিত হয়েছিলেন। বুখারি হচ্ছেন পূর্বকালের একজন স্বৈরশাসকÑ যিনি নিজেকে ‘একজন সংস্কারবাদী গণতান্ত্রিক’ হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন। জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য তিনি নিজেকে একজন সংস্কারবাদী গণতান্ত্রিক হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন।

আমরা জানি, গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতা পৃথকীকরণ নীতির ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করে থাকে। নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করে। গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোতে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের মাধ্যমে চমৎকারভাবে স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধতিকে উপেক্ষা করে দেশ পরিচালনা করে। তাই প্রধান বিচারপতিকে বরখাস্ত করে বুখারি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা লঙ্ঘন করেছেন। তার এই সিদ্ধান্তে যারা প্রেসিডেন্টকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী বলে মনে করতেন, তাদের অনেকেই হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। যাই হোক না কেন, এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, প্রধান বিচারপতিকে বরখাস্ত করার ঘটনা বুখারি প্রশাসনের এ ধরনের প্রথম ঘটনা- যেটার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট বুখারি নাইজেরিয়ায় ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতিকে অচল করে দিয়ে গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিলেন।

বুখারি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এ পর্যন্ত ফেডারেল সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে বারবার বাগাড়ম্বর করেছে। একই সাথে বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বিরোধীপক্ষকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য তাদের ভয়ভীতি ও হুমকি প্রদানের পথ বেছে নিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ফেডারেল সরকার সাবেক নিরাপত্তা উপদেষ্টা সামবো দাসুকিকে মুক্তি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে দুর্নীতির অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। নাইজেরিয়ার হাইকোর্ট তাকে জামিন দেয়া সত্ত্বেও তিনি মুক্তি পাননি। অধিকন্তু, প্রেসিডেন্ট বুখারি তার প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় থাকাকালীন জাতীয় স্বার্থকে আইনের ঊর্ধ্বে রাখার জন্য খোলামেলাভাবে যুক্তি দেখিয়েছেন। এসব তৎপরতার মাধ্যমে তিনি আইনের ঊর্ধ্বে উঠে কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছেন।

বুখারির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় শুধু বিচার বিভাগের ওপরই আঘাত আসেনি, বরং বুখারি প্রশাসন আইন সভার সদস্যদের ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্যও নানা পথ বেছে নেয়। ২০১৮ সালের আগস্টে সশস্ত্র মাস্কধারী কর্মকর্তারা স্টেট সার্ভিস থেকে পার্লামেন্টে অবরোধ করে রাখে। বিশিষ্ট সিনেটর যারা বিরোধী দলকে সমর্থন করেন- তাদের বাড়িতে পুলিশি অভিযান চালানো হয়। সিনেট প্রেসিডেন্ট বুকুলা সাঘানি এবং তার প্রধান মিত্র ডিনো মেলাইকে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগে পুলিশ নাজেহাল করে। পার্লামেন্ট, সুপ্রিম কোর্ট, স্বাধীন মিডিয়া এবং সিভিল সোসাইটি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা থাকলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে ওই সব প্রতিষ্ঠানও সেখানে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে।

নাইজেরিয়ায় গত তিন বছরের সংবাদপত্র তথা মিডিয়ার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ক্রমাবনতি ঘটেছে। এ ধরনের একটি পরিস্থিতিতে নাইজেরিয়ার নির্বাচন কি দেশটিতে কোনো আশার সঞ্চার করতে পারবে, নাকি দেশটিতে গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে স্বৈরতন্ত্রের পথই উন্মুক্ত হবে?


আরো সংবাদ



premium cement