২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

শ্রী শ্রী সরস্বতী পূজা

-

‘নারায়ণং নমস্কৃত্য নরবৈষ্ণব নরোত্তম। দেবীং সরস্বতীং ব্যাসং ততো জয়মুদীরয়েৎ’। আজ শ্রী শ্রী সরস্বতী পূজা। বিদ্যা ও জ্ঞানের দেবী সরস্বতী। বিদ্যা মায়ের আরাধনায় নিমগ্ন বিদ্যার্থীরা। বিদ্যাদায়িনী মায়ের জ্ঞানই শক্তি। তিনি কুন্দফুল, ইন্দু, তুষার ও মুক্তামালার মতো শুভ্র। তিনি শ্বেত বস্ত্রপরিহিতা যার হস্ত বীণার বরদণ্ডে শোভিত। তিনি শ্বেত পদ্মের ওপর উপবিষ্টা। তিনি ব্রহ্মা, বিষ্ণু। মহেশ্বর দেবতাদের দিয়ে সর্বদা বন্দিতা। অশেষ জাত্যবিনাশকারী পণ সরস্বতী রক্ষা কর। বীণা ও পুস্তকধারিণী মুরারী বল্লভ সর্বশুক্লা সরস্বতী জিহ্বা ও কণ্ঠে অধিষ্ঠিতা হোন। সরস্বতী বাণীরূপিণী বাগদেবী। হাতে তার পুস্তক ও বীণা। পুস্তক বেদ শব্দ ব্রহ্মাবীণা সুরছন্দের শারদা ব্রহ্ম। শুদ্ধ-স্বত্বগুণের মূর্তি। তাই সর্বশুক্লা শ্বেতকর্মটি প্রকাশাত্মক। সরস্বতী শুদ্ধ জ্ঞানময়ী প্রকাশস্বরূপ। জ্ঞানের সাধক দেহ মণপ্রাণে শুদ্ধ শুচি। প্রাগৈতিহাসিক যুগেও ভারতবর্ষে শক্তি পূজা ছিল প্রচলিত। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো নগরে দেবীর পূজা হতো। সরস্বতী সারদা, বাগেশ্বরী, ব্রাহ্মণীবাদিনী ও ব্রতচারিণীসহ ১৬টি নাম ব্রহ্মার। সরস্বতী বাংলায় মরাল বাহন; দাক্ষিণাত্যে সরস্বতী ময়ূরবাহন। বাংলার এ জনপ্রিয় দেবী বৌদ্ধতন্ত্রের সৃষ্টি।

প্রাচীনকালে ও সরস্বতী পূজার প্রচলন ছিল। সরস্বতী পূজা ছিল সনাতন ধর্মের মতো বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মেও। ছাত্রছাত্রীদের কাছে সরস্বতী বিদ্যাদায়িনী। তিনি মায়ের জ্ঞান ও শক্তি। দিবারাত্রি অজপা মন্ত্রে সিদ্ধি তিনি। তিনিই হংসধর্ম। মানুষ সুস্থ শরীরে দিবারাত্রির মধ্যে একুশ হাজার ছয় ’শ হংস এই অজপামন্ত্র জপরূপে শ্বাস-প্রশ্বাস করে থাকে। মানুষ যত দিন স্বাভাবিক জপও উপলব্ধি করতে না পারে, তত দিন হংসধর্ম হতে পারে না; ব্রহ্মা বিদ্যারও সন্ধান পায় না। হাঁস জলে বাস করে, তবে তার গায়ে জল লাগে না। সে রূপ পরম হংস সংসারে বাস করেন বটে, কিন্তু সংসার তাদের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। হাঁসের বৈশিষ্ট্য হলো, হাঁসের সামনে দুধ ও জল দিলে, সে জল ত্যাগ করে দুধ খাবে। হাঁসের গতি দেখেছেন কি? এক দিকে সোজা চলে যাবে তারা। বিবেকবান মানুষ নিত্য অনিত্য সংসার থেকে নিত্যাসারাংশ গ্রহণ করে থাকে। গতি ঈশ্বরের দিকে থাকে। সে ব্রহ্মাবিদ্যা লাভে, ঈশ্বর দর্শনে কৃতকার্য হয়। এভাবে দেবী সরস্বতীর পূজা প্রচলিত হলো। মহাসরস্বতী চিতে মহালক্ষ্মী সদরূপা এবং মহাকালী আনন্দরূপা। তত্ত্বজ্ঞান লাভের জন্য তোমাকে হৃদয়পদ্মে ধ্যান করি।

আজ যখন সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তখন সারা দেশে বহু জ্ঞানপাদপীঠ রক্তাক্ত। ছড়িয়ে পড়ছে হিংসা, হানাহানি ও সন্ত্রাস। একে একে জীবন দিচ্ছে বিদ্যার্থীরা। অনেকে পরিণত হচ্ছে সন্ত্রাসী, খুনি এবং দুর্বৃত্ত। এদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না নারী শিশুসহ নিরীহ নাগরিক। শিশু হত্যা ছাড়াও পথচারী বিশ্বজিৎসহ আরো অসংখ্য প্রাণের সংহার ঘটেছে। অকারণ প্রতিহিংসার শিকার হয়ে চরম মূল্য দিতে হচ্ছে ওইসব পরিবারকে, যারা হারিয়েছে তাদের প্রাণপ্রিয় সন্তানকে। ছাত্ররাজনীতির নামে চলছে বর্বরতা। শিক্ষা নিয়ে কেন অনৈতিক বাণিজ্য? শিক্ষাঙ্গনের সব স্তরে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এ অবস্থায় প্রকৃত শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জন করতে পারছে না। প্রশ্নপত্র ফাঁস যেকোনো পরীক্ষায়।

যারা বহু আশা নিয়ে সন্তানকে পাঠিয়েছেন জ্ঞানার্জনের জন্য। কিন্তু আজ তারা ভীতসন্ত্রস্ত। না জানি, কখন সন্তান লাশ হয়ে ফিরে আসে মায়ের কোলে। এটা তো কোনো স্বাধীন দেশে হওয়ার কথা নয়। রাজনীতির নামে হিংস্রতা চলছে, যা জাতির জীবনে চরম নৈরাজ্য ডেকে আনছে। যার অন্তরে মায়া নেই, ধর্মের স্পর্শ নেই- সে জন্মভূমিকে ভালোবাসতে পারে না, হতে পারে না দেশপ্রেমিক। শিক্ষার পরম লক্ষ্য মনুষ্যত্বের অধিকারী হওয়ার জন্য জ্ঞান দান করা। শিক্ষা একজনকে প্রকৃত মানুষ করে তুললে বহু সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। শিক্ষার ভিত্তি হতে হবে সত্য, সুন্দর ও মাধুর্যপূর্ণ। প্রীতি, প্রেম, ভালোবাসা, সততা ও ন্যায়বিচার নিয়েই মানুষের জীবন এবং এটাই মূলত দর্শন ও জ্ঞান। সমাজ, দেশ ও জাতিকে সুখী ও সমৃদ্ধ করার প্রথম সোপান হলো একে অন্যের প্রতি মর্যাদা প্রদান। কিন্তু এটা এ দেশে প্রায় বিলুপ্ত হতে চলছে। সব শিক্ষারই উদ্দেশ্য হতে হবে মানুষকে প্রাপ্য মর্যাদা দেয়া। প্রথমেই নির্ধারণ করে নিতে হবে শিক্ষার লক্ষ্য ও আদর্শ। ভাবতে হবে আমরা এ পৃথিবীতে কেন এসেছি ? কী জন্য স্রষ্টা ধরণীতে আমাদের পাঠিয়েছেন?

এখানে আমাদের কী কাজ, কী করলে জীবন সার্থক হবে? এসব যদি ভাবতে না শিখি তাহলে মানুষ আর পশু সমান হয়ে যাবে। সেই শিক্ষা এর সমাধান দিতে পারে, যে শিক্ষা মানুষের গুণাবলিকে বিকশিত করে। মানুষ যতবড় বিদ্ব্যান বা ধার্মিক হোক না কেন, মানুষের সাথে মধুর ও ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার না করলে কেউ তাকে শ্রদ্ধা করবে না এবং ভালোবাসে না। ছাত্রসমাজকে উদ্বুদ্ধ হতে হবে নিষ্কলুষ চরিত্র গঠন, দেশের জন্য আত্মত্যাগ, পরিশ্রমকে মর্যাদা দান, সব ধর্মের প্রতি উদার ব্যবহার, আত্মনির্ভরশীলতা, ন্যায়নিষ্ঠ এবং সর্বজীবে দয়া প্রদর্শনের ব্রতে। আজ প্রয়োজন জ্ঞানের পাদপীঠগুলোর পর্যাপ্ত সংস্কার। দলীয় বিবেচনায় সব নিয়োগ বন্ধ করা সময়ের দাবি। রাজনৈতিক বিবেচনায় কমিটি গঠন বন্ধ করতে হবে। অর্থের লোভ বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে, অশুভ আকাক্সক্ষা জন্মেছে। প্রত্যেকেরই আকাক্সক্ষা হবে মহৎ। মানুষকে ভালোবাসতে হবে। সবার উপরে মানুষ সত্য- এ কথাকে তুলে ধরতে হবে। জীবনকে সফল করে তোলাই শিক্ষার উদ্দেশ্য। সব গুণের এবং সব মাধুর্যের প্রকাশই সভ্যতা। দেশ থেকে শ্রদ্ধাবোধ প্রায় অন্তর্হিত হয়েছে। যে শিক্ষায় ব্যক্তির সুখে সমাজ সুখী হতে হয়। এক সমাজের সুখ অন্য সমাজের সুখের পরিপন্থী যেন না হয়। তাই শিক্ষা যাতে মানুষের অন্তরের পূর্ণতা নিশ্চিত হয়। তাই শিক্ষা। বাংলাদেশ বিভিন্ন ধর্মের দেশ।

হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, সবাই এ দেশের অধিবাসী। সবারই লক্ষ্য হতে হবে দেশপ্রেমিক প্রকৃত মানুষ হওয়া। সব জাতির বিশ্বাস ধর্ম, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান রেখে প্রণয়ন করতে হবে শিক্ষার নীতিমালা। শিক্ষার উদ্দেশ্য যদি হয় স্রষ্টার আনুগত্য এবং মানুষের কল্যাণ ও দেশ সেবা, তাহলে এটা সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে। শিক্ষকসমাজ যেন দলীয় রাজনীতি থেকে বিরত থাকেন। অন্যথায় ছাত্রসমাজের জ্ঞানার্জন মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন হবে। দেশের প্রতিটি বিদ্যার্থী সত্যিকার মানুষ হবে এবং নতুন আলোকবর্তিকা নিয়ে সত্য পথের সন্ধান দেবে- দেশ ও জাতিকে এ প্রত্যাশা আজকের বাণী অর্চনায়। সব বিদ্যাদানকারী ও বিদ্যার্থীকে জানাই শুভ কামনা। বিদ্যা ও জ্ঞানের শ্রদ্ধাঞ্জলি সরস্বতী মায়ের প্রতি। ‘আলো দে মা আঁধার ঘরে। জ্ঞানের আলো দে মা অন্তরে।’ কত জ্ঞানী-গুনীজন তোমারে করেছে নিবেদন। মা শ্রী শ্রী সরস্বতী, তোমাকে জানাই হৃদয়ের ভক্তিপূর্ণ প্রণাম। সব ভক্তের প্রতি নমস্কার।
msnislamtransport@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement