২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

‘জিরো টলারেন্স’

‘জিরো টলারেন্স’ - ছবি : সংগৃহীত

নির্বাচনে কে হেরেছে আর কে জিতেছে, তা বড় কথা নয়। শেষ এবং মোদ্দাকথা, জিতেও যে জিতেনি, হেরেও যে হারেনি। পরাজয় হয়েছে গণতন্ত্রের। বলে রাখা ভালো, অঙ্কশাস্ত্রের ‘শূন্য’ সংখ্যাটির আবিষ্কারক প্রাচীন সভ্যতার ভারত। সেই ভারত অদ্যাবধি ‘জিরো টলারেন্স’-এর পর্যায়ে নির্বাচনকে মানসম্মত অর্থবহ হিসেবে বজায় রেখে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ হয়েও ‘টেকসই জিরো টলারেন্স’ সহনীয় পর্যায়ে সীমিত রাখতে সক্ষম রয়েছে। আমরা কি তা পারি না

জিরো টলারেন্সের বাংলায় অর্থ করতে গেলে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। যেমন- অর্থ হতে পারে ‘ছাড়হীন’ বা ‘ছাড়-ছাড়া’ বা ‘ছাড়-শূন্য’ বা ‘শূন্য-ছাড়’ ইত্যাদি। যেমন- ‘টেবিল’কে যদি ‘মেজ’ বলি অনেকেই বুঝবেন না। আবার ‘টেবিল’ যেমন ইংরেজি শব্দ, ‘মেজ’ তেমনি ফারসি শব্দ অর্থাৎ ‘আমদানি করা’। বাংলার মৌলিক শব্দ নয়। তাই প্রবন্ধটিতে ‘জিরো টলারেন্স’ই সুবিধার্থে ব্যবহার করা হলো।

০+০+০=০ অঙ্কশাস্ত্রে প্রমাণিত সমীকরণ। ‘টলারেন্স’ শব্দটির পূর্বে ‘জিরো’ সংযোজন করায় শব্দটির অর্থের ব্যাপকতার পরিধি সীমিত করা হয়েছে বলেই প্রতীয়মান।

বাংলাদেশে এখন ‘জিরো টলারেন্স’ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে বাক্যে বা শব্দার্থের বিষয় বা ব্যাখ্যা আরো জটিল হয়ে যাচ্ছে। খাপে খাপ হয়েছে কি না দেখা হচ্ছে না। অথচ ‘জিরো টলারেন্স’ ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে আলাদা অর্থে প্রযোজ্য হওয়ার কথা। নিম্নে কিছু উদাহরণ দেয়া হলো- (ক) দুর্নীতিতে ‘জিরো টলারেন্স’ ব্যবহারে তার প্রকারভেদ বিবেচনায় রাখতে হবে। যেমন- অর্থবিষয়ক দুর্নীতি, চরিত্রে দুর্নীতি, ক্ষমতা ব্যবহারে দুর্নীতি ইত্যাদি। (খ) মুদ্রাস্ফীতিতে ‘জিরো টলারেন্স’ কথাটার ব্যবহার উল্টো ফল বয়ে আনতে পারে। যেমন- বাজেটে ‘জিরো টলারেন্স’ মুদ্রাস্ফীতির নীতিতে প্রবৃদ্ধিতে স্থবিরতা এসে যেতে পারে। আবার মুদ্রাস্ফীতির পরিবর্তে ‘জিরো টলারেন্স’-এর কারণে ‘মুদ্রাসঙ্কুচিত’ হলে প্রবৃদ্ধি দূরের কথা ক্রমাবনতি ঘটে যেতে পারে। অথচ পরিকল্পিত ও সুষম নিয়ন্ত্রণে মুদ্রাস্ফীতি ঘটলে আশানুরূপ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। (গ) জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যদি ‘জিরো টলারেন্স’-এর আওতায় আসে, তাহলে গড় আয়ু বেড়ে উৎপাদনশীলতায় ঋণাত্মক পরিস্থিতির উদ্ভব হবে। ‘টলারেন্স’ নমনীয়তাপ্রসূত ও বাস্তবসম্মত হতে হবে। আসল কথা ‘জিরো টলারেন্স’ টেকসই, বিশ্বাসযোগ্য, সুষম ও পরিকল্পিত হতে হবে। এ ক্ষেত্রে ‘টেকসই জিরো টলারেন্স’ই চাবিকাঠি। উল্লেখ্য, উদার মুদ্রাস্ফীতি ‘জিরো টলারেন্স’প্রসূত হয়ে এক দিকে যেমন অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিতে পারে, অপর দিকে ‘জিরো টলারেন্স’-এর সঠিক প্রয়োগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষণাবেক্ষণে সুশাসনের প্রসূতি হতে পারে।

প্রসঙ্গত, এবারের জাতীয় নির্বাচন যে সুষ্ঠু, সুন্দর ও নিরপেক্ষ হয়নি তা এখন সর্বজনবিদিত। দেশ-বিদেশের গণমাধ্যম ও জনমাধ্যমে আলোচনার বিষয়বস্তু। নতুন করে নিরপেক্ষ, সহনীয় ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই সময়ের দাবি।

নির্বাচন-পূর্ব এবং নির্বাচনের দিনে বহু অঘটন ঘটেছে, যার ফিরিস্তি অফুরন্ত। যেমন- পরোয়ানা ছাড়া বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, নির্বাচনী এজেন্ট ও কোনো কোনো প্রার্থীকেও গ্রেফতার করে ‘গায়েবি’ মামলায় অন্তর্ভুক্তি। এমনকি, ‘এফআইআর’-এ নাম নেই, কিন্তু পূর্বেকার মামলায় ‘গং’-এর স্থানে বর্তমানে নতুন নাম এন্ট্রি করে গ্রেফতার। একইভাবে পোলিং এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে কোথাও প্রবেশের অনুমতি না দেয়ার কৌশল নেয়া হয়েছিল। নির্বাচনের আগের রাতেই অর্ধেক ব্যালট বাক্স ভর্তি করার খবর বহুল আলোচিত। বাকি অর্ধেক নির্বাচনের দিন সকাল ও বিকেলে ভর্তি করে নির্বাচনের যবনিকাপাত ঘটানো, আবার বিশেষ ক্ষেত্রে বিরোধীদলীয় প্রার্থীর বাসা-ভবন অবরোধ, কারো কারো গাড়ি ভাঙচুর ও প্রার্থীকে আক্রমণসহ বহুবিধ ঘটনার অবতারণায় মনে হয়েছিল, যেন পুতুল খেলা চলছে। এগুলোর সার্বিক তদন্ত অদ্যাবধি হয়েছে বলে কেউ জানেন কি না, জানি না। তবে ধারণাপ্রসূত অভিব্যক্তি হলো- নিয়মবহির্ভূত উপরি উক্ত কর্মকাণ্ড সাধনে ‘জিরো টলারেন্স’ পদ্ধতির প্রণয়ন ও ব্যবহার স্বেচ্ছাচারিতায় পর্যবসিত হয়েছিল বলে মনে হয়। এ ধরনের দায়িত্বহীনতার জন্য নির্বাচন কমিশন, বেসামরিক প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন দায় এড়াতে পারে না। তবে সামরিক বাহিনী মোতায়েন সত্ত্বেও ‘ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা’ না থাকায় তাদের ভূমিকা পালনে জটিলতা দেখা দিয়েছিল বলে বোধগম্য হচ্ছে।

মনে হয়, বড় একটি মাস্টার প্ল্যান মোতাবেক এবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে অতি উৎসাহীদের আচরণে নির্বুদ্ধিতার কারণে ‘৯৭ শতাংশ বিজয়ে’ সব কিছু ম্লান হয়ে গেছে। এ ধরনের বড় বিজয়ে নৈতিকতার বড় পরাজয় ঘটে গেছে। কারণ খুবই স্পষ্ট, যেমন ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্বপ্রাপ্তদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা। ‘বস’দের কত খুশি করা যায় সে প্রতিযোগিতা, আবার কেউ কেউ পিছিয়ে পড়ার ভয়ে, এলোপাতাড়ি দৌড়ঝাঁপে সব এলোমেলো করে ফেলেছেন।

ফলে সময়ের দাবি হলোÑ সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ ও জনস্বীকৃত একটি নির্বাচন।
তবে আমার নিম্নোক্ত কিছু প্রস্তাব সত্বর সমাধানের জন্য ভেবে দেখা যেতে পারে। যথা- সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের জন্য আইন প্রণয়ন। জাতীয় সংসদকে এক কক্ষ বা একাক্ষিকের পরিবর্তে দ্বিকক্ষ বা দ্বিকাক্ষিক করে গঠন করতে হবে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে কেবল অনাস্থা প্রস্তাবের জন্য প্রযোজ্য করতে হবে। এমনকি বাজেট আলোচনাও উন্মুক্ত হবে। তা আলোচনা-উত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে গৃহীত হবে। সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ক্ষমতা প্রদানসাপেক্ষে, সংসদ নেতা ও বিরোধীদলীয় নেতার সম্মতিতে ন্যায়পাল নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। ওই সম্মতির ক্ষেত্রে মতানৈক্য দেখা দিলে বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে পাঠিয়ে আপিল বিভাগের মতামতের আলোকে ন্যায়পাল নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। ন্যায়পালের অফিসে একটি বলিষ্ঠ শাখা গঠন করে জাতীয় নির্বাচনের সব উল্লেখযোগ্য অভিযোগের তাৎক্ষণিক নিষ্পত্তি করতে হবে। সংসদে বিরোধীদলীয় ‘ছায়া মন্ত্রিপরিষদ’ থাকতে হবে। প্রয়োজনে একজন সদস্য একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হতে পারবেন। সংসদীয় দলের নেতা এবং প্রধানমন্ত্রী একই ব্যক্তি কেবল প্রথমবারের মতো হতে পারবেন। তারপর থেকে তিনি কেবল যেকোনো একটিতে থাকতে পারবেন।

উপসংহারে বলা যায়, বিগত নির্বাচনে কে হেরেছে আর কে জিতেছে, তা বড় কথা নয়। শেষ এবং মোদ্দাকথা, জিতেও যে জিতেনি, হেরেও যে হারেনি। পরাজয় হয়েছে গণতন্ত্রের। বলে রাখা ভালো, অঙ্কশাস্ত্রের ‘শূন্য’ সংখ্যাটির আবিষ্কারক প্রাচীন সভ্যতার ভারত। সেই ভারত অদ্যাবধি ‘জিরো টলারেন্স’-এর পর্যায়ে নির্বাচনকে মানসম্মত অর্থবহ হিসেবে বজায় রেখে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ হয়েও ‘টেকসই জিরো টলারেন্স’ সহনীয় পর্যায়ে সীমিত রাখতে সক্ষম রয়েছে। আমরা কি তা পারি না?

লেখক : চার্টার্ড গ্লোবাল ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট (সিজিএমএ), সাবেক প্রতিমন্ত্রী


আরো সংবাদ



premium cement