২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জুলুমের সৌন্দর্যায়ন

ইমরান খান - ছবি : সংগৃহীত

আজ আমার হৃদয়ের কী অবস্থা শোনাব? এ হৃদয় বেশ ক্ষত-বিক্ষত। এর পেছনে রয়েছে অসহায়ত্বের অনুভূতি। এটা অস্ত্রোপচারের উপকরণ হয়ে বারবার দুর্বল হৃদয়ের ওপর ক্ষত সৃষ্টি করে যাচ্ছে। শুধু আমার নয়, বেশির ভাগ দেশবাসীর হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত। যারাই শাহিওয়াল ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া তিন শিশুর চেহারায় দুঃখ ও অসহায়ত্বকে অনুভব করেছেন, তারা ওদের অসহায়ত্বের মধ্যে নিজেদের অসহায়ত্ব দেখতে পাবেন। যখনই কোনো নির্দোষ ব্যক্তিকে গুলি করার পর সন্ত্রাসী বা ডাকাত বলে আখ্যায়িত করা হয়, তখনই আমার চোখের সামনে ওইসব ঘটনা ঘুরতে থাকে, যেখানে আগে কোনো নির্দোষ ব্যক্তির ওপর জুলুম করা হয়েছে। এরপর ওই জুলুমের সৌন্দর্যবর্ধন করে কীর্তিমান একটি কাহিনী বানিয়ে দেয়া হয়েছে। শাহিওয়ালেও কিছুটা এমন হয়েছে। ১৯ জানুয়ারি দুপুর প্রায় ১২টার সময় সেখানে টোল প্লাজার কাছে কাউন্টার টেররিজমের (সিটিডি) সদস্যরা লাহোর থেকে আগত একটি কারের টায়ারে গুলি করে। কারটি যখন রাস্তার ধারে থেমে যায়, তখন এর ওপর তিন দিক থেকে গুলিবর্ষণ করা হয়। এ কারণে কারের মধ্যে থাকা নারী ও শিশুরা আর্তচিৎকার শুরু করে। রঙবেরঙ কাপড়ের পোশাক পরিহিত সিটিডির সদস্যরা কারের কাছে আসেন। কারের মধ্যে থাকা আহত খলিল বলেন, আমাদের তল্লাশি করুন। আমরা নিরস্ত্র এবং বিয়ের অনুষ্ঠানে যাচ্ছি। আপনারা যা নিতে চান, নিয়ে যান। আমাদের ছেড়ে দিন। এরপর তিনি বললেন, আমাদের গাড়িতে শিশু রয়েছে। এদের মারবেন না। একজন সিটিডি সদস্য খলিলকে বললেন, শিশুদের কার থেকে বাইরে বের করো। ওই সময় খলিল অজ্ঞান হয়ে পড়েন। সিটে বসা তার স্ত্রী নাবিলা ও ১৩ বছরের মেয়ে আরিবা নিশ্চুপ ছিল। দুইজন সিটিডি সদস্য পেছনের দরজা খুলে ১০ বছরের উমাইর, সাত বছরের মুনিবা ও চার বছরের হাদিয়াকে বের করেন এবং বেশ নির্দয়তার সাথে কারের মধ্যে থাকা দুইজন আহত নারী ও দুইজন আহত পুরুষের ওপর আরো গুলি বর্ষণ করেন, যাতে তাদের মধ্যে কেউ বেঁচে না থাকে।

সিটিডির সদস্যরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারে। তারা ওয়্যারলেসের পরিবর্তে ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে তাদের কর্মকর্তাদের বলছিলেন, জীবিত বেঁচে যাওয়া শিশু নিহতদেরকে তাদের মা-বাবা অভিহিত করছে। কর্মকর্তারা চাপ দিলেন, এ ভুলকে কীর্তিমান কাহিনী বানিয়ে ফেলো। সিটিডির সদস্যরা নিজেদের জুলুমের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য একটি কাহিনী সৃষ্টি করেন এবং দাবি করেন, নিহত নারী-পুরুষরা সন্ত্রাসী ছিল এবং সন্ত্রাসী সংগঠন আইএসআইএসের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিল।

সিটিডির সদস্যরা আহত শিশুদের একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। এখানে আগত সাংবাদিকরা ১০ বছর বয়সী উমাইরের সাথে কথা বললে জানা যায়, সিটিডির সদস্যরা মিথ্যা বলছেন। মিডিয়ায় যখন এ মিথ্যার মুখোশ উন্মোচন হয়, তখন সিটিডির সদস্যরা এক নতুন দাবি উত্থাপন করেন। তাদের বক্তব্য, কারের ড্রাইভার জিশান সন্ত্রাসী সংগঠনের কমান্ডার ছিল এবং কারে আরোহী অপর সদস্যদের জানা ছিল না সন্ত্রাসীদের সাথে তার সম্পর্ক রয়েছে। কারের কালো কাচের কারণে কারের ভেতরে থাকা নারী-শিশুদের দেখা যায়নি। একটি মিথ্যাকে লুকানোর জন্য সিটিডি মিথ্যার পর মিথ্যা বলে যাচ্ছে। জানা গেছে যে, জিশান মূলত খলিলের মহল্লার অধিবাসী ছিল এবং ভাড়ায় গাড়ি চালাত। সিটিডির দাবি, ওই কার থেকে তাদের ওপর ফায়ারিং করা হয় এবং জবাবি ফায়ারিংয়ে সন্ত্রাসী মারা যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, কারের আরোহীরা কোনো ফায়ারিং করেনি, ফায়ারিং যা হয়েছে সিটিডির সদস্যরাই করেছেন।

দুঃখজনক দিকটি হচ্ছে, মিডিয়াতে যখন সিটিডির মিথ্যার মুখোশ উন্মোচিত হয়, তখন পাঞ্জাব পুলিশ এক হ্যান্ড-আউটে বলে, শাহিওয়ালের সন্নিকটে চারজন সন্ত্রাসী মারা হয়েছে। যদি এ সন্ত্রাসী বাস্তবেই এতটা ভয়ঙ্কর ছিল, তাহলে সিটিডির সদস্যরা সালোয়ার, পাঞ্জাবি ও রঙবেরঙের ট্রাউজার পরে তাদের গ্রেফতার করতে গেল কেন? কেউই বুলেটপ্র“ফ জ্যাকেট পরিহিত ছিলেন না। মোবাইল ফোনে ধারণকৃত ১০ বছর বয়সী উমাইরের ভিডিও বক্তব্য যখন শোনার সুযোগ হলো, তখন পাঞ্জাব সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করেছি। সবারই জানা ছিল, সিটিডির সদস্যরা জুলুম করেছেন।

কেননা শাহিওয়ালের জেলা প্রশাসনও সিটিডির কাহিনীকে মিথ্যা অভিহিত করেছে। সিটিডির সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে পাঞ্জাব সরকার তদন্ত কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। এটা ওই সময়ের কথা, যখন পাঞ্জাব সরকারের মুখপাত্র ড. শাহবাজ গুল মুখ্যমন্ত্রী সরদার উসমান বাজদারের সাথে যোগাযোগ করে তাকে বলেছেন, সিটিডির মিথ্যা প্রতিহত করা সম্ভব নয়। এখন আপনারা সিটিডির সদস্যদের গ্রেফতারির ঘোষণা দিয়ে দেন। সরদার উসমান বাজদার মিয়ানওয়ালি সফরে ছিলেন। তার গাড়ি দীর্ঘ বহরে জ্যামারের কারণে আটকে ছিল, মোবাইল ফোন ছিল অকার্যকর। বাজদার পরিস্থিতির ভয়াবহতা ওই সময় অনুভব করেন, যখন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তার সাথে যোগাযোগ করে শাহিওয়াল ঘটনার ব্যাপারে কথা বলেন। মুখ্যমন্ত্রী সিটিডি সদস্যদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলেন। কিন্তু যখন তাকে বলা হলো, এ ঘটনা ভয়াবহ আকার ধারণ করলে ইমরান খান তার সহযোগিতার হাত গুটিয়ে ‘ইউটার্ন নিতে পারেন। তখন মুখ্যমন্ত্রী সিটিডির সদস্যদের গ্রেফতার করার নির্দেশ দেন। এ ঘটনার পরের সকালে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান একটি টুইট বার্তায় বলেন, ‘সিটিডি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, তবে আইন সবার জন্য সমান।’

তিনি এ কথা বলতে ভুলে গেছেন, ২৩ জুন, ২০১০ সালে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ সিআইডিকে সিটিডিতে রূপান্তর করেছিলেন। সিটিডি কিছুটা ভালো কাজ করে থাকবে, কেননা সন্ত্রাসীদের সাথে লড়াই করার জন্য তাদের বেতন দেয়া হচ্ছে। তারা জাতির প্রতি দয়া করছে না। তবে এটাও এক বাস্তবতা যে, সিটিডি বহু নির্দোষ ব্যক্তিকে কোনো প্রমাণ ছাড়াই গুম করেছে, কাউকে সাজানো মুখোমুখি হামলায় মেরে ফেলেছে, কাউকে অপর দফতরে হস্তান্তর করে ‘গুম’ হওয়া মানুষের মধ্যে শামিল করে দিয়েছে। ১৩ জানুয়ারি, ২০১৮ সালে করাচিতে নকিবুল্লাহ মেহসুদের সাথে নিহত মুহাম্মদ ইসহাকের বাড়ি পূর্ব আহমদপুরে। তাকেও সিটিডি পুরো এলাকাবাসীর সামনে তার ঘর থেকে গ্রেফতার করেছিল। জানা নেই সে করাচি কিভাবে পৌঁছল এবং রাও আনওয়ারের হাতে কিভাবে এল? আনওয়ারের দণ্ড হলে সম্ভবত সিটিডির সদস্যরা শাহিওয়ালে এক নিরপরাধ পরিবারের ওপর জুলুম করে তাকে নিজেদের কীর্তি হিসেবে অভিহিত করতেন না।

পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী উসমান বাজদার বলেছেন, তিনি শাহিওয়াল ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্ত বানাবেন। যখন খুনি পুলিশ সদস্যদের ব্যাপারে তদন্ত অন্য একজন পুলিশ অফিসার করবেন, তখন কোন ধরনের দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে? সর্বপ্রথম জুলুমের শোভা বর্ধন করে কীর্তিমান কাহিনী নির্মাণকারী পুলিশের প্রধান, পাঞ্জাবের আইজিকে বরখাস্ত করুন। এরপর দেখা যাবে, আপনি কাকে দৃষ্টান্তের প্রতীক বানাচ্ছেন। শাহিওয়ালের ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া শিশুদের অসহায়ত্ব হৃদয়ে যে ক্ষত সৃষ্টি করেছে, তা আমাদের চিৎকার করতে বাধ্য করেছে। আর মজলুমে বদদোয়া শাসকদেরকেও দৃষ্টান্তস্বরূপ বানাতে পারে।হ

পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ২১ জানুয়ারি, ২০১৯ সংখ্যা থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com

লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট, প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)


আরো সংবাদ



premium cement