২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ভাবনা : আত্মহত্যা ও সামাজিক রোগ

- সংগৃহীত

কথিত আছে মানুষ নাকি বাঁচার জন্য ভাসমান খড়কুটোও আঁকড়ে ধরে৷ তাহলে কেন আত্মহত্যার মতো একটি কাণ্ড অবলীলায় ঘটিয়ে ফেলে সেই মানুষ? ডাক্তার আকাশের আত্মহত্যা ও আত্মহত্যা নোট আমাদের আবার ভাবাচ্ছে৷

মানুষ কেন আত্মহত্যা করে? এর কোনো উত্তর নেই৷ জীবন শেষ করে দেওয়াকে অনেকেই বেশ সাহসী, অনেকে কাপুরুষোচিত কাজ বলে আখ্যা দেন৷ এগুলো নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়৷ এসব মতবাদ একপাশে সরিয়ে একটি নিরপেক্ষ স্থানে এসে ভেবে দেখবার সময় বোধ হয় চলে এসেছে– কেন ঘটছে আত্মহত্যা৷ মোটা দাগে সামাজিক অবক্ষয় বলে চালিয়ে দিতে পারলেও আদতেই কি এই একটিই কারণ?

ডাক্তার মোস্তফা মোর্শেদ আকাশ তার সুইসাইড নোটে স্ত্রীর পরকীয়া, ব্যাভিচারের কথা উল্লেখ করেছেন৷ তাঁর মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা আলাপ-আলোচনায় দেখা গেছে, ব্যক্তি হিসেবে তিনি সফল ও জনপ্রিয় ছিলেন৷ পারিবারিকভাবেও সমাজে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন৷ মানুষের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা অপরিসীম ছিল৷ তাহলে এমন একটি মানুষকে কেন স্ত্রীর পরকীয়ার কারণে মরে যেতে হলো? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা কি শ্রেয় নয়?

ডাক্তার আকাশ বারবার তাঁর স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘‘ছেড়ে চলে যাও, কিন্তু চিটিং করো না৷’’ আত্মবিশ্বাস কতটা ভঙ্গুর হলে নিজে ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া যায়? আমি যদি প্রশ্ন করি– ডাক্তার আকাশ কেন মিতুকে তালাক দেননি? তাহলে দেন মোহরের লাখ টাকা কারণ হিসেবে উত্থাপিত হবে এবং সঙ্গে দেনমোহর প্রথাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা হবে৷

যারা মনে করেন, দেনমোহরের ফাঁদে পড়ে ডাক্তার আকাশ নিজে তালাক দিতে পারেননি, তাদেরকেও জানিয়ে রাখতে চাই, দেনমোহর কোনো লোক-দেখানো বিষয় নয়৷ যখন ২৫ লাখ টাকা কাবিনের কথা ওঠে, তখন সেই সামর্থ নেই বলে বিয়ে না করে চলে যেতে পারেন৷ ডাক্তার আকাশ যখন যাননি, তখন ধরে নিতেই পারি, তিনি সেই পরিমাণ অর্থ দেওয়ার সামর্থ রাখতেন বলেই যাননি৷ কারণ, ইসলামে দেনমোহর আইনত স্বামীর উপর আরোপিত একটি দায়৷ ধর্মের বিধান মতে, মুসলমানদের বিবাহে একটি ধর্মীয় শর্ত, যা এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই৷ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহ চুক্তি দ্বারা স্ত্রীকে পণ্যের মতো ক্রয় করা হয় না বরং স্ত্রীর অর্থনৈতিক অধিকার পাকাপোক্ত করা হয়৷ যেহেতু এটি অবশ্যই পরিশোধযোগ্য, তাই পুরুষদের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সমাজ সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন স্ত্রী গ্রহণ করতে এবং পরিশোধযোগ্য দেনমোহরে বি‌য়ে করতে৷ সুতরাং আমরা বোধহয় এখন দেনমোহরের আলোচনা থেকে বের হয়ে আসতে পারি৷

এবার আলাপের বিষয় পরকী‌য়া ও দ্বিচারণ বা ডাক্তার আকাশের ভাষায় ‘চিটিং’৷ এখানে সামাজিক অবক্ষয়ের দায় অস্বীকার করার উপায় নেই৷ আকাশ মিতুর অবক্ষয়ের জন্য শ্বশুর-শাশুড়ি ও দুজন বন্ধুকে দায়ী করে গেছেন৷ আদৌ কি ঘটেছে সেই বিচার আদালত করবে৷ কিন্তু সম্পর্কে ঘাটতি থাকলে দুজনেরই সরে যাওয়ার কোনো সুযোগই কি ছিল না? গণমাধ‌্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আকাশের ছোটভাই জানিয়েছেন, তার ভাই মিতুর ওপর এতটাই ক্ষিপ্ত হয়েছিল যে, মারধরের চেষ্টাও করেন৷ সাগর বাঁধা দেন৷ সাগর জানান, তার ভাবিকে বাবা এসে নিয়ে যান এবং সেই ঘরে থাকা অষুধ লুকিয়ে ফেলেন৷ অর্থাৎ একটা আগাম ধারণা ছিল, ভাই আত্মহত্যা করতে পারে৷ এর আগেও কি এমন চেষ্টা করেছিলেন? কতটুকু হতাশা বা ‘ডিপ্রেশন’ নামক রোগে একজন মানুষ মরে যেতে পারে? চাঁদগাঁও থানার ওসি জানিয়েছেন, বাথরুম থেকে ইনসুলিনের অ্যাম্পুল উদ্ধার করা হয়েছে৷ অর্থাৎ অনেকদিন ধরেই তিনি প্রস্তুতি নিয়েছেন আত্মহত্যার৷ আত্মহত্যা করা বা চেষ্টা করা একটি কঠিন মানসিক রোগ৷ ডাক্তার আকাশ অসুস্থ ছিলেন৷ তার পরিপার্শ্ব তাকে অসুস্থ করে তুলেছিল– এই বক্তব্য দিলে সমাজ আমাকে তুলোধুনো করতে বসবেন৷ পাশাপাশি এও বলতে চাই, বহুগামিতাও মারাত্মক একটি অসুস্থতা৷

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেখানে মিতু স্বীকারোক্তি দিয়েছেন কার কার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল৷ সেই ভিডিও ডাক্তার আকাশ নিজেই পোস্ট করেছেন৷ নিজের স্ত্রীর এহেন স্বীকারোক্তির পরও সম্পর্কে আটকে থেকে মহান ভালোবাসার বাণী প্রচার করে আত্মহত্যা করাকে মহত্ত্ব বলবে সমাজ?

মিতুর পারিবারিক অবস্থা যথেষ্ট ভালো বলেই মনে হলো৷ তাহলে যদি ডাক্তার আকাশকে ভালোই না লাগে, আটকে থাকার কী দরকার ছিল? কারা বাধা দিয়েছে মিতুকে আকাশকে ছেড়ে যেতে? এসব প্রশ্নের উত্তর কি আদৌ পাওয়া যাবে, নাকি আত্মহত্যাকে সমাধান মনে করে আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকবো? আকাশের ফেসবুক আইডিতে মিতুর সঙ্গে গত ১৭ জানুয়ারিতেও ঘনিষ্ট ও হাসিখুশি পাওয়া গেছে৷ তার প্রোফাইল ও ফেসবুক কাভারেও মিতুর ছবিই বিদ্যমান৷ আকাশ-মিতুর ভালোবাসাকে যদি ভালোবাসা না বলে সামাজিক অসুস্থতা বলি, লোক দেখানো ফেসবুক স্ট্যাটাস দেওয়া সম্পর্ক বলি– তবে কি অস্বীকার করার উপায় আছে?

কিছুদিন আগে স্বামীকে ছয় টুকরো করে স্বীকারোক্তি দেওয়া একটি ভিডিও অনেকের চোখে পড়েছে৷ সেই নারী বলেছেন, তিনি আত্মহত্যা করতে পারতেন, কিন্তু তারপর আরেকটি নারী একই নির্যাতনের শিকার হতে পারতেন৷ আর সেদিন মারের চোটে আর থাকতে না পেরে পাল্টা মেরেছিলেন৷ এতে মরে যায় স্বামী৷ পরে তিনি কী করবেন ভেবে না পেয়ে আলমারিতে লুকিয়ে রাখেন এবং ছয় টুকরো করেন৷ সেই ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে নিতে বলবো না৷ কিন্তু ভাবার সময় এসেছে৷ সুস্থ-স্বাভাবিক সম্পর্ক কোনটি? কোন ধরনের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে কী ধরনের আচরণ প্রয়োজন?

এক তরুণী বলেছিলেন, ‘‘আমি ডিপ্রেশনে আক্রান্ত এই কথাটা চিৎতকার করে বললেও তোমরা চিকিৎসা করাবে না৷ কিন্তু আমার ক্যানসার বললে তোমরা ঝাঁপিয়ে পড়বে চিকিৎসায়৷’’ সমাজে যে লোক দেখানো সংস্কৃতি, নৈতিক অবক্ষয়, ডিপ্রেশন মাথা চাড়া দিচ্ছে– এসব নিয়ে আমরা কবে ভাববো? ভাবার সময় কবে আসবে?


আরো সংবাদ



premium cement